আম্পায়ারিং, স্ট্যাম্পে লাথি, পাতানো ম্যাচের গন্ধ, বিশৃঙ্খলা; সবমিলিয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ থেকে ক্রিকেটটাই হারিয়ে যেতে বসেছিলো।
সব ছিলো। কিন্তু ক্রিকেটীয় কারণে শিরোনামে আসতে পারছিলো না এবারের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের টি-টোয়েন্টি। অবশেষে সেই দায়িত্বটা তিনি পালন করলেন। হঠাৎ কোন এক ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে তাণ্ডব করলেন ব্যাট দিয়ে। হঠাৎ ব্যাটকে তরবারি বানিয়ে ঝলসে উঠলেন আধার থেকে বেরিয়ে এসে।
হ্যাঁ, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগকে ক্রিকেট দিয়েই শিরোনামে নিয়ে এলেন মুনিম শাহরিয়ার।
আর সাথে সাথেই প্রশ্ন উঠলো – কে এই মুনিম শাহরিয়ার?
এক কথায় বললে বলতে হয়, মুনিম হলেন ক্রিকেটের স্বর্ণভূমি ময়মনসিংহ থেকে উঠে আসা একজন তরুন তুর্কি। ঢাকায় ক্রিকেট নিয়ে সংগ্রাম চালাতে থাকা এক স্বপ্নবাজ। এবং দারুণ এক স্বপ্নের পেছনে ছোটা এক ওপেনার।
প্রথমেই একটা ডিসক্লেইমার দিয়ে নেওয়া যাক।
মুনিম এমন কিছু হাতি ঘোড়া এখনও মেরে ফেলেননি। এখনও সেরাদের সাথে আলোচনায় আসার জন্য তাকে অনেক পথ চলতে হবে। এবার লিগেরও সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় প্রথম দিকে তার নাম নেই। ৫০ বলে অপরাজিত ৯২ ও ৪০ বলে ৭৪ রানের দুটো ইনিংস খেলেছেন পরপর। খুব দুনিয়া কাঁপানো কোনো ব্যাপার নয়। তারপরও আমরা মুনিমের প্রশংসা করছি কারণ, তিনি নিজেও নেতিবাচক ঘটনার মধ্যেই ছিলেন লিগে। সেইসব আলোচনাকে সরিয়ে দিয়ে তিনি যে ব্যাট দিয়ে আলোচনায় এসেছেন, এটা বড় ব্যাপার।
মুনিমের এবার আবাহনীর হয়ে মাঠে নামারই কথা ছিলো না।
তাঁদের দলে ছিলেন জাতীয় দলের দুই ওপেনার লিটন দাস ও নাঈম শেখ। এর মধ্যে লিটনের অনুপস্থিতি তাঁকে পড়ে পাওয়া সুযোগ এনে দিলো। আর কানে খালেদ মাহমুদ সুজন দিলেন মন খুলে খেলার মন্ত্র। তাতেই আপাতত বাজিমাত। আপাতত স্বপ্নটা তার আবার ডানা মেলেছে।
মুনিমের এই স্বপ্নের শুরু ময়মনসিংহের নয়াপাড়া থেকে। মেডিকেল কলেজের উল্টো দিকের এই এলাকায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার। বাবা একটি বেসরকারী বীমা কোম্পানির চাকুরিজীবি ছিলেন। শুরুতে বাবার কাছ থেকেই ক্রিকেটার হওয়ার প্রেরণাটা পেলেন।
মুনিম তখন টিভিতে আর মাঠে খেলা দেখে এই ক্রিকেটের প্রেমে মজে গেছেন। বাবা ব্যাট-বল এনে দেন; মুনিম যত্রতত্র ব্যাটিং শুরু করে দেন। এমনকি যে মার্কেট থেকে ব্যাট কেনা হয়, সেই মার্কেটে দাড়িয়েও মুনিম ব্যাটিং করেন!
কিন্তু বলাই বাহুল্য যে, বাবা-মায়ের এই প্রশ্রয় লম্বা সময় থাকেনি।
ছেলে পড়ালেখা উচ্ছন্নে দিয়ে ক্রিকেটার হোক, এমনটা আশা করেননি বাবা। তিনি চেয়েছিলেন, পড়াশোনাটাই হোক। ফলে মুনিম বিকল্প পথ বেছে নিলেন। স্কুল পালিয়ে মাঠে গিয়ে খেলা শুরু করলেন।অ কোনোক্রমে লুকিয়ে লুকিয়ে ক্রিকেট কিট জোগাড় করা শুরু করলেন।
এই সময়ে তাকে কোচিং করিয়েছেন হাবিবুর রহমান রহমান অলক। অলকের একজন শিষ্যকে আপনারা চেনেন-মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। এ ছাড়া প্রয়াত হায়াতুল ইসলাম হান্নান ও জাকির হোসেনের কাছেও ট্রেনিং করেছেন মুনিম।
মুনিম এই পর্যায়ে ব্রেকটা পেলেন বিভাগীয় অনুর্ধ্ব-১৬ দলে খেলার ভেতর দিয়ে। এখানে ভালো করায় তাঁর ঢাকায় এসে খেলার স্বপ্ন তৈরি হলো। বাড়িতে রীতিমত লড়াই করে চলে এলেন ঢাকায়; তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেট খেলতে। এখানে দু বছর শ্যামল বাংলা বলে একটা দলে খেললেন। তারপর প্রথম বিভাগে সিসিএস। ২০১৭ সালে গাজী গ্রুপের হয়ে প্রিমিয়ারে অভিষেক হলো।
মজার ব্যাপার হলো, এই আবাহনীর বিপক্ষেই প্রিমিয়ার অভিষেক হয়েছিলো তার। তিনি নিজে খুব ভালো না করতে পারলেও গাজী গ্রুপ এ বছর শিরোপা জিতে নিলো। আর গত মৌসুমে মাঝারি ধারাবাহিকতার পুরষ্কার হিসেবে এলেন আবাহনীতে।
আবাহনীতে নিজের প্রথম মৌসুমে মাত্র দুটো ম্যাচে একাদশে সুযোগ পেয়েছিলেন। ফলে নিজেকে চেনানোর সুযোগটাই সেভাবে পাননি। এ বছর সুযোগ আরও কম আসার কথা ছিলো। কারণ, আবাহনীর টপ অর্ডারে এবার আরও বেশি তারকা।
তারপরও লিটনের অনুপস্থিতিতে সুযোগ এলো। কিছু করতে পারছিলেন না মুনিম। নিজেকে নিয়েই যেনো একটু দ্বিধায় ছিলেন। সেই সময় পাশে এসে দাড়ালেন কোচ খালেদ মাহমুদ সুজন। বললেন, ‘দ্যাখ, এতো কিছু ভাবিস না। তুই যা পারিস খেল। তুই সেঞ্চুরি করলেও হয়তো লিটন ফিরলে ম্যাচ পাবি না। ফলে যে কয়টা ম্যাচ পাবি, নিজের খেলাটা উপভোগ কর।’
এই কথাটা বদলে দিলো মুনিমকে। ফল তো দেখতেই পাচ্ছেন। হেসে বলছিলেন, ‘আমি আর ক দিন সুযোগ পাবো, তা নিয়ে আর ভাবি না। প্রতিটা ম্যাচকে শেষ ম্যাচ ভেবে এনজয় করার জন্য ব্যাটিং করি।’
এটা বলতে হবে যে, মুনিম এই ২৩ বছর বয়সেই ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ব্যাপারটা শিখে গেছেন-উপভোগ।
এখন মুনিমের স্বপ্নটাও বড় হয়েছে। নিজেকে নিয়ে খুব একটা দ্বিধা আর কাজ করে না। তিনি জানেন, এভাবে উপভোগ করতে পারলে জীবন একদিন কাছে আসবেই, ‘আমি তো বাড়ি ছেড়েছিই জাতীয় দলের স্বপ্নে। একদিন আমি ওখানে যেতেই চাই। তবে এটাও জানি যে, দুটো ভালো ইনিংসে স্বপ্নপূরণ হবে না। আমাকে বছরের পর বছর এরকম খেলে যেতে হবে। আর সেটাই করতে চাই আমি।’
তাই হোক। মুনিমের স্বপ্নপূরণ হোক। মুনিমের ঝলকানিতে আলোকিত হোক একদিন বাংলাদেশ।