অভিশাপের গল্প

জয়ের জন্যে দরকার এক রান, স্ট্রাইকে ফিনিশার ল্যান্স ক্লুজনার। ডেমিয়েন ফ্লেমিংয়ের বলে ব্যাট চালালেন ক্লুজনার এবং সাথেসাথেই পরম আকাঙ্খার এক রানের উদ্দেশ্যে দৌড়, অপর প্রান্তে ডোনাল্ড তাকিয়ে থাকলেন বলের দিকে, এই চাহনি শেষ করে যখন দৌড় দেয়া শুরু করলেন ততক্ষণে বল গিলক্রিস্টের হাতে। ডোনাল্ড রান আউট, টাই হওয়া ম্যাচে আফ্রিকার আবারো বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল থেকে বিদায়।

ডেভিড ওয়ার্নার এখন পর্যন্ত টেস্টে ৯০ এর ঘরে আউট হননি। এমনটাই বলেছিলেন মার্ক নিকোলস। পাশে থাকা শেন ওয়ার্ন একথা শোনার পরে কিছুটা হলেও ক্ষেপেছিলেন নিকোলসের উপরে। ওয়ার্নার ওই ইনিংসে আউট হন ৯৭ রানে।

সঞ্জয় মাঞ্জরেকার বলে যাচ্ছেন রোহিত শর্মার স্ট্যাম্পিংয়ে আউট না হওয়া রেকর্ডের কথা। শর্মা ওই টেস্টেই দুই ইনিংসেই স্ট্যাম্পিংয়ের শিকার হয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২০০ রানের টার্গেটে ব্যাট করছে শ্রীলঙ্কা। ক্রিজে তখন সাঙ্গাকারা এবং জয়াবর্ধনে, স্কোর ১৫৫-৩। এমন সময়ে রাসেল আরনোল্ড বললেন এই ম্যাচ শ্রীলঙ্কাকে স্বয়ং ঈশ্বরও হারাতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। সেই ম্যাচ পাকিস্তান ম্যাচ জিতে ২৬ রানে।

এই তিনটি ঘটনার মধ্যে শুধু একটি মিলই আছে আর সেটি হলো ক্রিকেটের বিখ্যাত টার্ম ‘কমেন্টেটর্স কার্স’। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, সচেতন-অবচেতন যে মনেই বলা হোক না কেন দিনশেষে দোষ ধারাভাষ্যকারদেরই।

এবার ক্রিকেট বাদে অন্য অভিশপ্ত কিছু কাহিনি শুনে আসি।

আর্জেন্টাইন ক্লাব রেসিং ১৯৬৭ সালে প্রথমবারের মতোন কোপা লিবার্তোদোরেস (দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নস লিগ) জিতে ওই বছর ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন সেল্টিকের মুখোমুখি হয়। প্রথম দুই লেগে কোনো রেজাল্ট না আসাতে তৃতীয় লেগ হয় এবং রেসিং সেই লেগ জিতে প্রথমবারের মতোন ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপও জিতলো।

রেসিং ক্লাব, খেলোয়াড়, সমর্থকরা যখন আনন্দে মেতে উঠছে – এই ফাঁকে  তাদের নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ইন্দিপেন্দিয়ান্তে সমর্থকরা রেসিং এর মাঠে গিয়ে সাতটা মৃত বিড়াল কবর দিয়ে রেসিংকে কার্স/অভিশপ্ত করে। কাকতালীয়ভাবে এরপর থেকেই রেসিং এর পতন শুরু হয়। এমনকি ওরা প্রথম বিভাগ থেকে রেলিগেটেডও হয়ে যায়।

বাধ্য হয়ে ১০,০০০ রেসিং সমর্থক কার্স তুলে নেয়ার উদ্দেশ্যে  মাটি খুড়ে ৬টি বিড়াল উদ্ধার করে।তারপরেও রেসিং এর ভাগ্য ফিরেনি। পরে ২০০১ সালে পুরো স্টেডিয়াম নতুন করে ঢেলে সাজানো হয় এবং শেষ ও সাত নাম্বার মৃত বিড়াল খুঁজে পায়। মজার ব্যাপার হলো ওই ২০০১ সালেই রেসিং ১৯৬৭ এর প্রথম কোনো শিরোপা জিতলো।

রেসিং এর ভাগ্য ফিরলেও এখনো ফিরেনি পর্তুগিজ ক্লাব বেনফিকার ভাগ্য। হাঙ্গেরিয়ান কোচ বেলা গাটমান, যিনি সর্বকালের অন্যতম সেরা ইনফ্লুয়েনশিয়াল ফুটবল কোচ,বেনফিকাকে ১৯৬২ সালের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ (চ্যাম্পিয়ন লিগ) জেতানোর পরে ক্লাবের কাছে নিজের বেতন বাড়ানোর জন্যে বলেন।

ক্লাব কর্তৃপক্ষ রাজী না হলে দলের দায়িত্ব ছেড়ে দেন এবং বলেন আগামী ১০০ বছরেও বেনফিকা ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে না।এখন পর্যন্ত আটটি ফাইনাল খেলেও বেনফিকা জিতেনি একটিও। গাটমানের অভিশাপ ভাঙতে পারেনি পর্তুগিজ ক্লাবটি।

বেসবলে বোস্টন রেড সক্স বনাম নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কিস দ্বৈরথটি অনেকটা ফুটবলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-লিভারপুল,বার্সা-মাদ্রিদের মতোনই। এই রাইভালরি নিয়ে একটি অনেক পুরোনো মজার কৌতুক আছে।

আমেরিকার এক স্কুলে প্রথম শ্রেণির ক্লাসে প্রথমদিনে এক শিক্ষিকা এসে তাঁর শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বললেন তিনি ইয়াঙ্কিস ভক্ত এবং তাঁর মতোন যারা ইয়াঙ্কিস ভক্ত তারা যেন হাত তুলে। ক্লাসের প্রথমদিন ম্যাডামকে খুশি করার জন্য হলেও সব বাচ্চারা হাত তুললো। শুধু হাত তুললো না জেনি। একটু আশ্চর্য হয়ে জেনিকে ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন কেন সে হাত তুলেনি।

জেনি: আমি নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কিস সমর্থন করি না, আমি বোস্টন রেড সক্স ফ্যান।

ম্যাডাম: কেন?

জেনি: কারণ, আমার বাবা-মা দুজনই রেড সক্স ফ্যান।

ম্যাডাম: এটা কোনো কারণ হতে পারে না। যদি তোমার বাবা-মা দুজনই অপদার্থ হয় তখন তুমি কী করবে?

জেনি: তখন আমি নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কিস সাপোর্ট করবো।

১৯১৮ সালে বোস্টন রেড সক্স ওয়ার্ল্ড সিরিজ (বেসবল চ্যাম্পিয়নশিপ) জিতলো। এরপরে যখন ক্লাবটি আবার এই শিরোপা ঘরে তুলল ততদিনে পেরিয়ে গেছে ৮৬ বছর, মানে ২০০৪ এসে আবার ওয়ার্ল্ড সিরিজ জিতে রেড সক্স। এই ব্যর্থতার পেছনের গল্প কী আসলে? অভিশাপ নাকি কুসংস্কার!!

১৯১৯ সালে রেড সক্স তাদের তারকা খেলোয়াড় বেইব রুথকে, যার ডাকনাম ছিল ব্যাম্বিনো (বাচ্চাদের মতোন দেখতে ছিলেন বিধায় এমন নাম, ব্যাম্বিনো অর্থ বাচ্চা) নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কিস এর কাছে বিক্রি করে দেয়। এরপর থেকেই ৮৬ বছর ধরে শিরোপার স্বাদ পায়নি রেড সক্স।

নিতান্তই আবেগের বশীভূত হয়ে ভক্তদের দৃষ্টিতে এই ব্যাম্বিনোকে বেঁচে দেয়ায় তাদের কাল হয়ে দাড়িয়েছে। অন্যদিকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ইয়াঙ্কিস রুথের স্পর্শে  বনে গিয়েছে দৈত্য। শেষ পর্যন্ত ২০০৪ সালে ইয়াঙ্কিসদের হারিয়েই এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হন রেড সক্স।

এই কার্সটি বোস্টন শহর এবং শহরের অধিবাসীদের  এতটাই দৈনন্দিন ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল যে শহরের সবচেয়ে ব্যস্ততম সড়কের উপরে বিদ্যমান ব্রিজে ‘রিভার্স দ্যা কার্স’ লেখা একটি ছোটোখাটো বিলবোর্ড ঝুলানো হয়েছিল। ২০০৪ রেড সক্স জেতার পরে কর্তৃপক্ষ সেটি সরিয়ে ফেলে।

ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার পোড়াকপালের কথা মনে করেই এই কাহিনিগুলোর কথা বললাম। রেসিং-রেড সক্স পারলেও এখনো পারেনি বেনফিকা। বিশ্বকাপ বা যেকোন টুর্নামেন্টে ভালো খেলে হঠাৎ করেই হোচট খায় আফ্রিকানরা। ১৯৯২ বিশ্বকাপে বৃষ্টিকে দ্বায়ী করা যেতে পারে। ১৯৯৯ এর জন্যে দ্বায়ী ডোনাল্ড নাকি আফ্রিকানদের উপরে গোসসা করা ক্রিকেট দেবী! চাইলেই দক্ষিণ আফ্রিকা রেসিং বা রেড সক্স থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজে নিতে পারে। বলা যায় না হয়তো একদিন তাদের শোকেসও পাবে বড়ো কোনো শিরোপার স্পর্শ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link