এক মহাব্যস্ত সময় পার করছে ক্রীড়াজগত। ইউরো ও কোপার রাজ্যে হাজির হয়েছে এক টুকরো টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল। সাউদাম্পটনের বাইশ গজে আঁটকে গেছে পুরো একটি ক্রিকেট জাতির চোখ। অনেক বছর পর কোনো একটি টেস্ট ম্যাচের জন্য এমন অধির অপেক্ষায় ছিল গোটা ক্রিকেট বিশ্ব। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের এই যুগে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল এক ফালি বৃষ্টির মত।
টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের নবম দল হিসেবে আসর শেষ করেছে বাংলাদেশ। এখানে বাংলাদেশ ম্যাচ খেলেছে মোট সাতটি। সেখানে ছয়টিতে হার এবং একটিতে ম্যাচে ড্র। বাংলাদেশ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলবেনা কিংবা প্রথম পাঁচ দলের মধ্যে থাকবেনা সেটাই আশা করা হয়েছিল। কেননা নিউজিল্যান্ড, ভারত কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মত সেই ক্রিকেট কাঠামো আমাদের নেই। তবে এটা আশা ছিল যে অন্তত ঘরের মাঠে ভালো কিছু জয় পাবে বাংলাদেশ। কিংবা বাইরের ম্যাচ গুলোতে অন্তত দুই-একটা ম্যাচে নিজেদের সেরাটা খেলবেন মুমিনুলরা।
এতটুকুও আশাও যেন মহাকাশের দূর নক্ষত্রের মত অধরাই রয়ে গেলো। আমরা আমাদের কাছাকাছি শক্তির দল ভাবি শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। একসময়ের পরাশক্তি দুই দল এখন ক্রিকে মাঠে রীতিমত ধুঁকছে। সেই শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথেও টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে আমাদের পয়েন্টের ব্যবধান ১৮০। দুই দলই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শেষ করেছে ২০০ পয়েন্ট নিয়ে। এক ড্রয়ে বাংলাদেশের পয়েন্ট সর্বসাকুল্যে ২০।
পয়েন্ট তালিকার প্রথম হয়ে শেষ করা ভারতের পয়েন্ট ৫২০। অর্থাৎ তাঁদের সাথে আমাদের পয়েন্টের পার্থক্য ঠিক ৫০০। আমিও আবারো স্বীকার করছি ভারতের মত ক্রিকেট কাঠামো আমাদের নেই। তবুও মাঝেমাঝেই বাতাসে ভাসতে শোনা যায় ভারত আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দল।
এই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ কোন কোন দলের সাথে কিভাবে হেরেছে সেগুলো লিখে শুধু শুধু আলোচনা লম্বা করতে চাইনা। আমাদের অবকাঠামো নেই, তবে আমাদের প্রজ্ঞা ঠিক কতখানি ছিল? একবার এক শীর্ষ ক্রিকেটার বললেন, ‘গোল বলের খেলা ভাই, এখানে কতকিছুই হতে পারে।‘
আবার সাকিব বললেন এখানে হার-জয় আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ না। আমরা টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলতে পারবোনা । ফলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই তিনি মনোযোগ দিতে চাইলেন। সবমিলিয়ে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রতি এই ছিল আমাদের নিবেদন।
এবার ফাইনাল খেলতে যাওয়া দুই দল নিউজিল্যান্ড ও ভারতের দিকে একটু তাকানো যাক। আবারো বলছি এই দুই দলের ক্রিকেট অবকাঠামোই তাঁদের ফাইনাল পর্যন্ত পৌছানোর মূল কারণ। কেননা প্রশ্ন আসতে পারে অবকাঠামো কিংবা ক্রিকেট সংস্কৃতিতে বিপুল পার্থক্য থাকা দুটি দলের মধ্যে তুলনা করার কারণ কী। আমরা মোটেই তুলনা করছিনা। আমরা শুধু খুঁজতে চাইছি আমাদের খোরা কাঠামো দিয়ে যতটুকু সাফল্য আসার কথা সেটুকুই বা আসছে না কেনো।
ভারতের ক্রিকেট সংস্কৃতি ও অবকাঠামো নিয়ে নতুন করে আলোচনা করা বৃথা। দেশটি তাঁদের পাইপলাইনের শক্তিও খুব ভালো করেই দেখাচ্ছে। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য একটি দল গঠন করার পর তাঁরা আবার একটি দল শ্রীলঙ্কার সাদা বলের ক্রিকেট খেলতে পাঠিয়েছে একই সময়ে। এই দুলে জায়গা করতে পারেননি এমন কিছু প্রতিভাবান ক্রিকেটারও ভারতের আছে।
ভারতের ক্রিকেটের খারাপ সময়ে দেশটির হাল ধরেছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। সৌরভ ভারতকে সামনে থেকে, চোখে চোখ রেখে লড়তে শিখিয়েছিলেন। তাঁর সময় ভারত বিশ্বাস করলো ঘরের বাইরেও তাঁরা নিজেদের দিনে জিততে পারে। এরপর ভারতের ক্রিকেটে এলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। তিনি ভারতের ক্রিকেটের রূপকথাই নতুন করে লিখলেন। তাঁর নেতৃত্বে ভারত শুধু বিশ্বাসই না, নিয়মিত জিততেও শুরু করলো।
সেই ক্রিকেটীয় ঐতিহ্যের ভার এখন বিরাট কোহলির হাতে। কোহলির দল বিশ্ব ক্রিকেটে দাপিয়ে বেড়ানো এক দল। যেকোনো ফরম্যাটে, যেকোনো কন্ডিশনে কিংবা যেকোনো টুর্নামেন্টে ভারতে আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না। মোদ্দা কথা ভারতের ক্রিকেটে নতুন কেউ না কেউ এসেছেন হাল ধরতে। তাঁরা একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন দেশটির ক্রিকেটকে।
একইরকম ইতিহাস নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটেও রয়েছে। ২০১২-১৩ সালেও বেশ ভুগছিল কিউইরা। ১৯৫০ সালের পর সেই প্রথম টানা পাঁচটি টেস্ট ম্যাচ হারে দলটি। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি র্যাংকিংয়েও খুব একটা সুখকর অবস্থানে ছিল না দলটি। সেই সময় নিউজিল্যান্ডের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব নেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। তাঁর নেতৃত্বে ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে কিউই দের। যেমনটা সৌরভ ভারতের জন্য করেছিলেন। দুই বছর পর ম্যাককালামের নেতৃত্বে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালও খেলে দেশটি। নতুন করে ঘুরে দাঁড়ায় দলটি।
এরপর সেই দলের হাল ধরেন ক্রিকেটের নিতান্ত এক ভদ্রলোক কেন উইলিয়ামসন। গত কয়েকবছরে উইলিয়ামসনের নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ড যেনো এক ভিন্ন কোনো দল। কেন যেখানে হাত দিচ্ছেন সেখানে যেনো সোনা ফলছে। ২০১৯ বিশ্বকাপটা নিউজিল্যান্ডের জয় করতে না পারাটা তো শুধুই এক দুর্ভাগ্য। এবার টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে লড়ছে দুই দল।
ম্যাককালামের দেখানো পথে হেঁটে কেন উইলিয়ামসন নিউজিল্যান্ডকে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। নতুন কেউ এসে হয়তো তাকেও ছাড়িয়ে যাবেন। এভাবেই তো ক্রিকেটটা এগিয়ে যায়। কোনো এক সাক্ষাৎকারে ম্যাককালাম বলেছিলেন, ‘আমি দলে আগ্রসান ও আত্মবিশ্বাস যোগ করতে পেরেছিলাম। তবে আমার সময় দল কখনোই এতটা ধারবাহিক ছিল না। কেনের নেতৃত্বে সেটা সম্ভব হয়েছে।’
বাংলাদেশের ক্রিকেটেও একজন এসেছিলন যিনি কলার উঁচু করে লড়তে শিখিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর জন্য সীমানা ছিল আকাশ কিংবা মহাকাশ। হারের বৃত্তে ঘুরতে থাকা একটি দলের দায়িত্ব নিয়েই বদলে দিলেন সবকিছু। মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্রিকেটও একটা উচ্চতায় পৌছেছিল।
তবে তাঁর বিদায়ের পর আমরা আরেকজন ধোনি কিংবা কেন উইলিয়ামসন পাইনি। ফলে আমাদের ক্রিকেট গত দুই বছর ধরে একই জায়গায় থমকে গিয়েছে কিংবা পেছাচ্ছে। আমাদের খুব দ্রুত মাশরাফির একজন উত্তরসূরি দরকার। যিনি আমাদের নতুন একটি জায়গায় পৌছে দিবেন। সাথে একটা মজবুত ক্রিকেট কাঠামোও প্রয়োজন বটে।