বোরিং ফুটবলে সমাধান মিলবে স্পেনের?

স্পেন – আন্তর্জাতিক ফুটবলে আধিপত্য কী, কেন ও কীভাবে করতে হয় সেই সব প্রশ্নের উত্তর এক শব্দে সমাধান করে দেওয়া সম্ভব। ইন্টারন্যাশনাল ডমিনেন্স বলতে যা বোঝায় তা একটি দেশের নাম দিয়েই বর্ণনা করে দেওয়া সম্ভব। ২০০৮ থেকে ২০১২, ৫ বছর বিশ্ব ফুটবল কীভাবে এককভাবে শাসন করা যায় তা দেখিয়েছিলেন ক্যাসিয়াস-পুয়োলরা।

এমন কোনো দল নেই যারা স্পেনের সামনে দাড়াতে ভয় পেত না। লুইস অ্যারাগোনেসের হাত ধরে শুরু হওয়া শাসন পূর্ণতা পেয়েছিল ভিসেন্তে দেল বস্কের হাত ধরে।

স্পেনের সেই উড়তে থাকা যাত্রা শেষ হয়েছিল ২০১৩ কনফেডারেশনস কাপের ফাইনালে। নেইমারের ব্রাজিলের কাছে ৪-০ গোলের হার দিয়েই তাদের পতনের শুরু। পতনটা অবধারিতই ছিল, কোনো কিছুর শুরু হলে তার শেষটাও থাকবে। স্পেনের সর্বজয়ী দল আস্তে আস্তে নিজেদের দ্যুতি গারাচ্ছিল বটে, কিন্তু স্পেন ততদিনে নিজেদের দাঁড় করিয়ে ফেলেছে।

ক্যাসিয়াস-পুয়োলরা জায়গাটা ছেড়ে দিলেও ভরসা ছিল, যে স্বপ্ন তারা দেখিয়েছেন স্পেনের তরুণ দলকে, যে উদ্দীপনা তাদের বুকে বইছে, স্পেন অন্তত মুখ থুবড়ে পরবে না। তারা চলে গেলেও পরবর্তী প্রজন্ম ঠিকই হাত ধরবে।

তেমন কিছুই হয়নি। ক্যাসিয়াস থাকতে থাকতেই স্পেনের মতন শুরু হয়েছে। আর তিনি বিদায় নেওয়ার পর থেকেই স্পেন যেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে অমাবস্যার চাঁদ। ২০১৮ বিশ্বকাপ থেকে শুরু। এরপর থেকে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের স্পেনকে আর খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। গত বিশ্বকাপেও গ্রুপ পর্ব কোনমতে পার করে রাশিয়ার সাথে বিরক্তিকর ফুটবল উপহার দিয়ে বাদ পরেছেন নক-আউট পর্ব থেকে।

স্পেনের এবারের ইউরো যাত্রাও শুরু হয়েছে বেশ বাজেভাবে। বাজেভাবে বলতে গেলে টুর্নামেন্টের শুরু থেকে হয়, টুর্নামেন্ট শুরুর আগে থেকেই। কোভিড আক্রান্ত মৌসুমের পর সব দলকে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ২৬ দলের স্কোয়াড দিতে। এনরিকে সে পথে হাটেবননি। তিনি প্রথাগত ২৩ জনের স্কোয়াডের মতন করে নিয়েছেন ২৪ জনকে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ছিল তার স্কোয়াডে স্পেনের সবচেয়ে বড় দলের কোনো খেলোয়াড় না থাকা।

ৎপুরো স্কোয়াড সাজিয়েছেন এনরিকে কোনো রিয়াল মাদ্রিদ খেলোয়াড় ছাড়া। দলের নিয়মিত অধিনায়ক সার্জিও রামোস বাদ পরেছেন চোটের কারণে। উইঙ্গার ভাজকেজের চোট, অ্যাসেন্সিও-ইসকোর অফ-ফর্মের তাও যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু পুরো মৌসুম অসাধারণ পারফর্ম করা নাচো? তাকে বাদ দিয়েছেন তিনি। অসাধারণ এক মৌসুম কাটানোর পরও বাদ পরেছেন ইয়াগো আসপাস। তারুণ্যনির্ভর দল গড়বেন বলে তাদের বাদ দেওয়া এনরিকে অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরিয়েছেন সার্জিও বুসকেটসের হাতে। যাকে স্বয়ং বার্সেলোনা সমর্থকেরাও বলছেন, ফুরিয়ে গিয়েছেন তিনি।

সমস্যার শুরুটা সেখানেই, দলে ২টি জায়গা খালি রেখে নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মেরেছেন এনরিকে। নেতৃত্বশূণ্য স্পেন নিয়ে ইউরোতে আসতে না আসতেই মুখোমুখি হলেন ঝড়-ঝান্ডার। কোভিডের কারণে দল থেকে বেরিয়ে গেলেন সার্জিও বুসকেটস, নেতৃত্বশূণ্য দলে যা বিন্দুমাত্র আশা ছিল তাও নিমিষেই ফুরিয়ে ফেল। অতঃপর এই দল নিয়েই মাঠে নামলেন এনরিকে। আর ফলাফল, এক হতাশ করা স্পেন।

প্রথম ম্যাচে সুইডেনের বিপক্ষে গোলের দেখাই পায়নি লুইস এনরিকের দল। এমনকি দ্বিতীয় ম্যাচেও মাত্র ১ গোল। লিড পেয়েও ধরে রাখতে পারেনি তারা। ডিফেন্স থেকে সাইডপাস, মিড থেকে সাইড পাস, সামনে বল জোগান দেওয়ার মানুষটা পর্যন্ত নেই।

প্রতি ম্যাচে ভরসার পাত্র সেই মোরাতা, যার ক্যারিয়ার কোনোকালেই স্টেবল ছিল না। গোল করার থেকে গোল মিস করায় দক্ষতা বেশি তার। গোল মিসের মহড়া চলছে এই ইউরোতেও। আর সেই মোরাতাই যখন তাদের দলের একমাত্র গোলদাতা, তখন তা বলে দেয় কতটা করুণ অবস্থায় আছে এনরিকের দল।

দূর্ভাগ্য এনরিকের পিছু ছাড়েনি। অসাধারণ মৌসুম কাটানো জেরার্ড মোরেনোর কথাই ভাবুন। গত তিন বছরে তার কোনো পেলান্টি মিস নেই। অথচ ইউরোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে পেনাল্টি মিস করে পয়েন্ট খুঁইয়েছেন দলের।

কিন্তু তাতেও স্পেনের খেলার স্টাইল নিয়ে কথা আসে। টিকিটাকা দিয়েই স্পেন তাদের রাজ্য সাজিয়েছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে টিকিটাকার দিনও ফুরিয়েছে। নতুন করে নতুনভাবে দলকে সাজানোর সময়ে এখন স্পেনের। কিন্তু এনরিকে সে পথে হাঁটছেন না।

তিনি এখনও আছেন সেই আগের মতই। টিকিটাকা দিয়েও সুন্দর ফুটবল খেলে জয় এনে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সেই দলে প্রয়োজন একজন ভালো প্লে মেকার ও দূর্দান্ত ফিনিশার। স্পেনের জার্সিতে এতদিন সে কাজটাই করতেন ইসকো-অ্যাসেন্সিও। কিন্তু তারা দুজনই দলের বাইরে। ফলে কাজটা করার দায়িত্ব এখন যাদের কাঁধে, তারা কেউই সেই কাজটা করতে পারছেন না।

২০০৮ থেকে ২০১২ সময়ে টিকিটাকার মাঝখানেই ইনিয়েস্তার লব, থ্রু পাস ছিল চোখের শান্তি। সেখান থেকে ডেভিড ভিয়া কিংবা ফার্নান্দো তোরেসের অসাধারণ ফিনিশিং। পুরো ম্যাচ পাসিং করে বেড়ালেও দিনশেষে জয় আসতো সেখান থেকেই। অথচ এনরিকের এই দলে শুধু পাসই আছে, গোল নেই। সুইডেনের বিপক্ষে তাদের সঠিক পাসের সংখ্যা ৮৩০! ৮৬% পজেশন! অথচ গোল শূন্য! পোল্যান্ডের বিপক্ষেও একই গল্প, ৭৭% পজেশন, ৭০৮টি পাস। গোল মাত্র ১টি। সেখান থেকেও জয় বের করতে পারেনি তারা। ১৯৯৬ ইউরোর পর প্রথম ইউরোর টানা দুই ম্যাচ জয়হীন স্পেন।

এনরিকের সামনে এখন সমীকরণের সমাহার। জিতলে আরামেই পরের পর্বে পাড়ি দিবে তারা। কিন্তু যদি আগের দুই ম্যাচের মতন পা হড়কায়। তাহলেই সমীকরণের জালে ফেঁসে যেতে হবে তাদের। প্রথম দুই ম্যাচের মতন যদি জকের ম্যাচেও ড্র করে তারা, তবুও তারা যেতে পারবে পরের রাউন্ডে। কিন্তু সেক্ষেত্রে পোল্যান্ডকে হারতেই হবে সুইডেনের বিপক্ষে। তৃতীয় হয়ে পরের পর্বে যেতে হবে তাদের।

লুইস এনরিকে কী পারবেন স্পেনকে তাদের গন্তব্যে নিতে? নাকি স্পেনকে আবারও তাদের বোরিং ফুটবলের মাশুল দিতে হবে গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পরে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link