চল্লিশ দশকের বিখ্যাত গ্যাংস্টার ফিল্ম ‘অ্যাঞ্জেলস উইথ ডার্টি ফেইসেস’ এর কথা মনে আছে কারো? মাইকেল কার্টিজের পরিচালনায় জেমস ক্যাগনি, প্যাট’ও ব্রায়ান আর হ্যাম্প্রি বোগার্টের সে কি দুর্দান্ত অভিনয়। মব বসের চরিত্রে অভিনয় করা ক্যাগনিকে আইডল মানতেন সদ্য কৈশোরে পা দেয়া বিম, ক্র্যাব, হাঙ্কি, প্যাটসি, সুইং আর ওদের লিডার সোপি।
ক্যাগনির স্পর্শে বাস্কেটবল ছেড়ে ক্যাসিনো আর জুয়ায় মন তাদের। রকি সালিভান মানে জেমস ক্যাগনির কৈশোরটাও কেটেছে এমনি ভাবেই। রকি সালিভান না চাইলেও ওই ছয়জনের দল ওকে গুরু মানা শুরু করে। রকি সালিভান আর তার বন্ধু জেরি কনোলির গল্পে শুরু হওয়া অ্যাঞ্জেলস উইথ ডার্টি ফেইসেস খুবই অনবদ্য ছবি। আমার মতন মার্টিন স্কোরসিজি ভক্তের কাছে তো দারুণ লেগেছে।
রকি সালিভান আর তার অ্যাঞ্জেলস ‘Based in the harbor of the city where lumpenproletariat, Petty criminals and prostitute mingle’।
কমিনিজমে এমন একটা বাক্য প্রায়ই বলা হয়। দারিদ্রতাকে এড়াতে মানুষ ছুটে যায় দূরদূরান্তে। তেমনই অনেক স্প্যানিশ আর ইতালিয়ান নাগরিক নতুন বিশ্বে বলে এসে যায় আর্জেন্টিনায়। আর্জেন্টিনার জাতীয় কিংবা ঘরোয়া ফুটবলে তাঁদের উত্তরাধিকারদের ব্যাপক আনাগোনা। যাদের নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি তাঁরাও এর বাইরে নয়।
ওজমার কর্বোতা, হামবার্তো ম্যাসিউ, ওমর সিভোরি, অ্যান্তোনিও অ্যাঞ্জেলিলো আর ওসভালদো ক্রুজ – এই পাঁচজন হচ্ছে আজকের নায়ক। প্রথম চারজন ইতালিয়ান শিকড়ে আটকা আর শেষজন স্প্যানিশ। একই সাথে এনারা পরিচিত ‘অ্যাঞ্জেলস উইদ ডার্টি ফেইসেস’ নামে।
শুরুতেই বলা জেমস ক্যাগনির ছবির নামানুসারেই এনাদের নামকরণ। বাংলাদেশে জন্ম হলে যেমন ধান কাঁটার পরে জমিতে কিংবা ইট পাথরের শহরের ভীড়ে রাস্তায় খেলত ঠিক আর্জেন্টিনার পরতেরোতে খেলেই এদের আগমন। চাইলেই তাঁদের পরতেরোর ছেলে বলেও ডাকা যায়।
এই পঞ্চপাণ্ডবের তান্ডবে ১৯৫৭ সালের কোপা আমেরিকা আর্জেন্টিনা জিতে একেবারে রাজকীয় স্টাইলে। রাউন্ড রবিন পদ্ধতিতে খেলা টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনা শিরোপা ঘরে তুলে এক ম্যাচ হাতে রেখেই। পাঁচ ম্যাচে গোল করে ২৪ টি। এই ২৪টি গোলই এসছে এই ‘অ্যাঞ্জেলস উই; ডার্টি ফেইসেস’-এ পাচজনের পা থেকে।
হামবার্তো ম্যাসিউ নয়টি, অ্যান্তোনিও অ্যাঞ্জেলিলো আটটির সাথে ওমর সিভোরির তিন আর ওজমার কর্বোতা ও ওসভালদো ক্রুজের দু’টি করে। নিয়ম রক্ষার শেষম্যাচে পেরুর কাছে ১-২ গোলে হেরে যায় তাঁরা। প্রথম বিশ্বকাপের নায়ক গুইলের্মো স্ট্যাবিলের অধীণের আর্জেন্টিনা পায় ১১তম কোপা আমেরিকা।
এই তো গেলো আক্রমণের কথা। পুরা টুর্নামেন্ট জুড়ে মাত্র ছয়টি গোল খায় আলবিসিলেস্তেরা। যার কারণ রিভারের দ্য ম্যাকিনার অংশ, ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার নেস্টার পিপো রসি। মাঝমাঠে কিংবা নিজেদের রক্ষণ সীমানায় দাড়িয়েই রসি নির্ধারণ করে দিতেন ম্যাচ কীভাবে চলবে – এতটাই অসাধারণ ছিলেন তিনি।
কলোম্বিয়ার জালে আট গোল দিয়ে শুরু হয় আর্জেন্টিনার কোপা মিশন। ইনসাইড ফরওয়ার্ড ম্যাসিউ একাই করেন চার গোল। ইতালির বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে দর্শকদের মন ভরিয়ে আর্জেন্টিনার রেসিংয়ে ক্যারিয়ার শেষ করেন তিনি। ইতালির নীল জার্সিও গায়ে জড়িয়েছিলেন।
ইকুয়েডরকে ৩-০ আর উরুগুয়েকে ৪-০ গোলে হারিয়ে টানা তিন ম্যাচ জিতে আকাশি-নীলরা। এবার নায়ক অ্যান্তোনিও অ্যাঞ্জেলিলো। এই ক্রীড়াবিদকে নিয়ে একটু আলাদাভাবে বলতে হচ্ছে। স্ট্রাইকার হওয়া স্বত্ত্বেও নিজের ডিফেন্সিভ ওয়ার্করেটের জন্যে বিশেষভাবে সুপরিচিত ছিলেন। খেলতে পারতেন সব জায়গায় – এমনকি নাম্বার টেন পজিশনেও।
আর গোল স্কোরিং অ্যাবিলিটির কথা বলাই বাহুল্য। নিজের জাত চিনিয়ে ইন্টার মিলানের হয়ে ষাটের দশকে করেছিলেন ৬৮ গোল। আযব বিষয় হলেও সত্য যে এই তাণ্ডবলীলা যখন চলছে তখন একমাত্র ওসভালদো ক্রুজ (২৬) বাদে কারো বয়স চব্বিশও হয়নি। ম্যাসিউর ছিল ২৩, সিভোরির ২২, কর্বোতার ২১ আর অ্যাঞ্জেলিলোর ১৯। চিলির জালে ৬ আর কিংবদন্তি দুই ফুলব্যাক নিল্টন আর ডিজালমা সান্তোস সাথে দিদি আর এখনো দুনিয়ার কাছে অপরিচিত গারিঞ্চার ব্রাজিলকে ৩-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা নিজেদের করে নেয় আর্জেন্টিনা।
পাঁচ এঞ্জেলের মধ্যে বাকী রইল দুজন। ওমর সিভোরি আর ওজমার কর্বোতা। দু’জনকে আলাদা করে নিয়েছি। কীভাবে শুরু করি! যে জুভেন্টাসকে আজকে আমরা দেখছি সে জুভেন্টাস একসময় নিজেদের শহরের সেরা ক্লাবও ছিল না।
ভেলেন্তিনো মাজ্জোলার জাদুতে তুরিনো তুরিন শহর তো বটে ইতালির সেরা ক্লাব ছিল। জন চার্লস আর জিয়াম্পিয়রি বোনাপার্তেকে সাথে নিয়ে সিভোরি জুভেন্টাসের রূপ বদলে দেয়। তখনকার সময়ে রেকর্ড ৯১ হাজার পাউন্ডে জুভেন্টাসে তাঁকে নিয়ে আসে জিয়ান্নি অ্যাগ্নেল্লি। এল ক্যাবাজোন মানে বড়ো মাথার সিভোরি ফুটবলে যেমন ব্রিলিয়ান্ট ছিল তেমনি নাছোড়বান্দাও বেশ।
বিপক্ষ দলের প্লেয়ারদের অপমান করতে ভালোবাসতেন,তবে সেটি ফুটবলেই। একই প্লেয়ারকে পরপর দুবার ড্রিবল করতেন শুধু সবাইকে দেখাতে যে আমার লেভেলই আলাদা। জন চার্লস খেলার মাঝে সিভোরিকে চড় মারতেন যাতে শুধু সে শান্ত হয়, মেজাজ হারিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু না করে বসে। নাটমেগ, ফেইন্টস, স্টেপ-ওভার, স্পিড সিভোরির কম ছিল না কিছুই।
জুভেন্টাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ১৯৬১ সালে ব্যালন ডি’অর জিতেন তিনি। যে অ্যাঞ্জেলসদের নিয়ে কথা বলেছি তাঁদের মধ্যে সেরা অবশ্যই বাঁ পায়ের সিভোরি। জুভেন্টাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার ছিলেন সিভোরি।
‘Creative playing style, skill, eye for goal, country of birth, hairstyle, strong mentality, at times rebellious nature both on and off the field and left footed’. – কার সাথে যেন মিলে যাচ্ছে সব। হুম ডিয়েগো ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনাকে দেখে অনেকেই সিভোরিকে ষাটের ম্যারাডোনা বলত। অনেকের কাছেই আবার ব্যাপারটা উল্টো। ম্যারাডোনা-মেসিদের আসল পথিকৃৎ ওমর সিভোরিই।
এবার আসি আর্জেন্টাইন গারিঞ্চাকে নিয়ে কিছু বলার। ওজমার ওরেস্তে কর্বোতা। গারিঞ্চার মতন উইঙ্গার ছিলেন। মদ-নারীর দিক দিয়েও গারিঞ্চার সমতুল্য। কর্বোতার একটি বিশেষ বিশেষ ক্ষমতা ছিল পেনাল্টিতে গোল করার। জীবনে ৬৪ পেনাল্টি নেয়া কর্বোতা গোল করেছেন ৬১ টিতেই।
রিভার প্লেটের লিজেন্ডারি গোলরক্ষক আমাডো কারিজো সুইডেনে ৫৮ বিশ্বকাপ চলার সময় কর্বোতার সাথে বাজি ধরেছিলেন যে কর্বোতার নেয়া ৫০ পেনাল্টির অন্তত ১০ টি হলেও তিনি সেইভ করবেন। কর্বোতা গোল করেছিল ৪৯টি। বাকিটা কি ধরতে পেরেছিলেন কারিজো? নাহ, সেটি গোলবারের বাইরে মেরেছিলেন আর্জেন্টাইন গারিঞ্চা।
১৯৫৭ এর কোপায় ব্রাজিলের বিপক্ষে তাঁর পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়ে গোটা লিমা শহর তাঁর ভক্ত বনে গিয়েছিল। ম্যাচ শেষে তাঁদেরকে নিজের জার্সি উপহার দেন কর্বোতা। মাঝেমধ্যে এতটাই মদে বুঁদ হয়ে থাকতেন যে ভুলে যেতেন ম্যাচের কথা।
একবার পুরো মাতাল অবস্থায় খেলতে নেমে গেলেন। সতীর্থদের বললেন তাঁকে পাস না দিতে কারণ তিনি কিছুই ঠিকঠাক দেখছেন। ওই ম্যাচেও জোড়া গোল করেন কর্বোতা। এই ব্যাপারটা পড়ার সময় আমি পুরো তাজ্জব হয়ে গেলাম। ফুটবল ঈশ্বর যেন দুহাত ভরে দিয়েছিলেন এই লোককে। কর্বোতা যখন ড্রিবলিং করে এগিয়ে যেতেন তখন কারো সাধ্য ছিল না তাঁর পা থেকে বল কেড়ে নেয়ার।
একবার এক সাক্ষাৎকারে এই প্রসঙ্গে কর্বোতা বলেছিল, ‘Do you why nobody could take the ball from me, cause she (ball) didn’t want to abandon me. Other things were indeed taken away from me’। ব্রাজিলের গারিঞ্চা আর আর্জেন্টিনার গারিঞ্চার জীবনের শেষের দিকটাও একই। দুজনই মারা যান একলা, নি:স্ব, সম্বলহীন এবং অসহায়ভাবে।
কোচ স্ট্যাবিল কীভাবে পেলেন এদের সবাইকে একসাথে খেলানোর আইডিয়া। এই টুর্নামেন্টের আগে তিনটি ফেন্ড্রলি ম্যাচে খেলিয়েছিলেন তাঁদের, আসলে কাকে নিবেন সেটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। ওই তিন ম্যাচে তারা গোল করেছিল ১৭ টি। দল নির্বাচনে কোচ স্ট্যাবিলকে আর দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি।
এই ‘অ্যাঞ্জেলস উইদ ডার্টি ফেইসেস’রা একসাথে এই একটি টুর্নামেন্টই খেলেছে। একসাথে খেলে মাত্র ছয়টি ম্যাচে তারা যে নৈপুণ্যের সমারোহ করে গেছেন তা আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে জ্বলজ্বল করছে ৬৪ বছর পরেও। মাইকেল কার্টিজের ছবির নামানুসারে দর্শক এমনকি দলের স্টাফ ও সতীর্থরাও কর্বোতা, সিভোরি, অ্যাঞ্জেলিলো, ক্রুজ আর ম্যাসিউকে ডাকতেন সেই একই নামে।
আরেকটি জিনিস তাঁরা চলে যাবার পরে আর্জেন্টিনা থেকে হারিয়ে গিয়েছিল, লা নুয়েস্ত্রা মানে আমাদের ধরণ মানে যে ধরনের নান্দনিক-ছান্দসিক-মনমাতানো ফুটবল আর্জেন্টিনা খেলে এসছিল এতদিন। স্পিনেত্তো-জুবেলদিয়া-বিলার্দোদের হাতে আসে অ্যান্টি ফুটবল। যার গল্প হবে অন্য কোনো দিন।