নদীর দু-পাড়ে কঠিন শিলা-স্তূপ। পাহাড়ের বুক চিড়ে নেমে আসা নদীর জল আছড়ে পড়ে পাথরের গায়ে, ছিটকে ওঠে। ফের দিক পাল্টে বয়ে যায়। পাহাড় পেরিয়ে সে এসে পড়ে মালভূমিতে, তারপর সমভূমিতে। তার বুকে জমা পলি একটু একটু করে গড়ে দেয় উপত্যকা, তাতে ফলে সোনার ধান।
বেঁচে থাকে প্রজন্ম, নদীর জল আর কঠিন শিলা জানতে পারে না মানুষের ইতিহাস তারা বয়ে যায়, বয়ে চলে যায়। জলের আকার নেই, কঠিন পাথর তবু ক্ষয়ে যায় জলের অবিরাম বয়ে চলার স্রোতে, এখানেই বন্ধু হয়ে ওঠে নদী আর পাহাড়।
দিল্লী ডেয়ারডেভিলস থেকে আসার সময় এবি ডি ভিলিয়ার্স জানতেন তিনি সেই এক পাত্র জলের মতো। প্রোটিয়াস রক্ত আর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা তাকে মানিয়ে নিতে শিখিয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকা দলের সুপারস্টার তখন বিশ্ব ক্রিকেটের ‘দ্য টপ’। বিধ্বংসী ব্যাটিং আর মায়াবি মেজাজে তিনি মন জিতে নিলেন ভারতের।
ভারতে এমনিতেই সম্মান পান প্রোটিয়াস আর কিউইরা, এবি ডির ক্ষেত্রে ভালবাসা ঢেলে দিল ভারতীয় ক্রিকেট। এদিকে রয়াল চ্যালেঞ্জার্সে তখন একটু একটু করে নিজেকে বিশ্ব ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপার জন্য তৈরী করছেন বদ মেজাজি দিল্লীর তরুণ।
ড্রেসিংরুমে প্রাথমিকভাবে ছেলেটার রাগ আর একগুঁয়েমি পছন্দ ছিল না টিম ম্যানেজমেন্টের। এবি ডিভিলিয়ার্স আসতে সমস্যা বাড়ার-ই কথা। প্রথমে সেভাবে জমলো না আলাপ। সময় পেরোলো। একটা সময় যেমন পাথরে জলের দাগ পড়ে ঠিক সেভাবে একগুঁয়ে বিরাটের ভেতর যেন ছলাৎ করে উঠল কেউ। যেন সুদূর আফ্রিকার ফোক মিউজিক শোনাতে নিয়ে গেল কেউ – ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন সম্রাটকে যেন নতুন পৃথিবী দেখাতে নিয়ে এলেন এবি ডি ভিলিয়ার্স।
২০১২-১৩ থেকেই বিরাটের প্রবল জনপ্রিয়তা চিন্তায় ফেলল রয়াল চ্যালেঞ্জার্স ম্যানেজমেন্টকে। একেই বদমেজাজি বিরাট, তার ওপর একই দলে এবি’র মতো প্রতিদ্বন্দ্বী। এক জঙ্গলে যেমন দুই সিংহ থাকতে পারে না তেমনি চিন্নাস্বামীর সবুজে দুই সম্রাটের রাজত্ব যে ভেঙে যাবে তা হয়ত এক প্রকার ধরেই নিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু ঐ যে এবি ডি – এক বিষ্ময়!
বিরাটের মনের যন্ত্রণাগুলো যেন নিঃশব্দে পড়ে ফেললেন প্রোটিয়াস কিং, রাতে বসতে শুরু হল আসর। কঠিন শিলা যেমন ক্ষয়ে যায় একগুঁয়ে বিরাট তেমনি এবিডির বহমানতার কাছে গলে যেতে লাগল একটু একটু করে। বিশ্ব ক্রিকেটে এক নম্বরের লড়াই চলছে যাদের দুজনের মধ্যে তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব?
হয়ত এই অসাধ্য সাধনের জন্যই তারা এবি ডি-বিরাট!
২০১৪ সালের পর থেকে যেন দুটো নদী মিলে ক্রিকেটীয় সভ্যতার বুকে জমিয়ে দিতে লাগল উর্বর পলি, বিরাটের ভেতরের নরম মনটাকে আগলে রাখলেন এবি ডি। অন্যদিকে, জেদি বিরাট নিজের অজান্তেই যেন বড়দাদার আসন দিল এবি ডিকে। দুই বন্ধুর তাণ্ডবে বদলে যেতে লাগল অনেক সমীকরণ।
ভিভ-বোথামের পর ফের যেন বসন্তের হাওয়া পেল ক্রিকেট বিশ্ব। সকলের কাছে দাম্ভিক বিরাট অবলীলায় টুইট করে দিলেন এবি ডি তাঁর আইকন। এবিডি লিখলেন বিরাটের অধিনায়কত্ব পেয়ে তিনি খুশি, বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যানের শিরোপা হয়ে উঠল ভালবাসার খেতাব যা দিল না আইসিসি। বিরাট আর এবিডি যেন একে অপরের মাথায় তুলে দিলেন পালক পরিহিত স্বর্ণমুকুট। বিরাট যেন বদলে গেলেন একটু একটু করে। খোলামেলা মনটা ক্রিকেটের রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ পেল ভিলিয়ার্সের কাছে।
আচমকা ঝড়ে ক্রিকেট থেকে সরে গেলেন প্রোটিয়াস কিং, ভেঙে পড়লেন বিরাট। তবু লাল জার্সি পরে বাইশগজ-এ নামলেই যেন রঙ তুলি দিয়ে লেখা হয় ক্রিকেটের রূপকথা।
হয়ত আমরা প্রজন্মের কাছে একদিন বলে যেতে পারবো – ‘এক জঙ্গলে দুই সিংহ থাকলে সব সময় যুদ্ধ নয়, অন্তত একবার রূপকথা লেখা হয়েছিল…’