ফুটপাতে তিনি এখন ডালপুড়ি বিক্রি করেন!

ইটাখোলা এলাকার রাস্তার পাশেই এক পুড়ির দোকান। ছোট্ট, জরাজীর্ণ প্রায় অবস্থা। যিনি বিক্রি করছেন তাঁকে এলাকার সবাই চেনে প্রায়। দূর থেকে দেখলে সাধারণ একজন পুড়িওয়ালা, কিন্তু কাছে গেলে সবার কাছেই তিনি পরিচিত এক মুখ।

পরিচিত না হয়ে উপায়ও নেই। এই লোকটিই কিনা তাঁর রাজ্যের হয়ে ক্রিকেট খেলেছেন প্রায় ১২টি বছর। তাঁর রাজ্যের নাম মাথায় ফেরি করে খেলেছেন ২২ গজে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতায় পরিবারকে বাঁচাতে আজ তাঁর পরিচয় একজন পুড়িওয়ালা।

আসামের চাচর রাজ্যের শিলচর শহরের এক এলাকার নাম ইটাখোলা। চাচর রাজ্যটা লোকসংখ্যা হিসেবে বেশ বড়ই বলা চলে। শত শত ব্যবসা, হাজার হাজার সরকারি চাকুরিজীবী সবই আছে এখানে। এখান থেকেই ২২ বছর আগে ১৩ বছর বয়সী এক কিশোর ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু করে।

তাঁর বয়সী ছেলেরা যখন স্কুল ব্যাগ কাঁধে টিউশনের জন্য দৌঁড়াত। ঠিক সেই সময়টায় এর চেয়েও ভারী অনুশীলন ব্যাগ বয়ে নিয়ে মাঠে যেতেন সেই কিশোর বালক। মাঠই ছিল তাঁর জন্য অ্যাকাডেমি। বেশ গরিব ঘর থেকে উঠে এলেও স্বপ্ন দেখতেন একদিন বড় ক্রিকেটার হবেন।

সেই কিশোর বালকটির নাম প্রকাশ ভগত। প্রকাশের বাবা গজাধর ভগত অনেকটা কষ্ট করেই সংসার চালাতেন। হাত-গাড়িতে করে রাস্তায় পাপড়ি চাট বিক্রি করতেন গজাধর। বাবার সাথে সাহায্য করতেন প্রকাশের বড় ভাই দিপক ভগত। ছেলেকে ক্রিকেটার বানাতে গজাধর ভগত চেষ্টার কোনো কমতিও রাখেননি।

১৯৯৯ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সেই শিলচর জেলা ক্রীড়া অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে ক্যারিয়ারের শুরু করেন ভগত। অনূর্ধ্ব-১৩ দলে কিশোর ক্রিকেটার হিসেবে বেশ ভালো পারফর্ম করে জায়গা করে নেন অনূর্ধ্ব-১৪ দলে।

এরপর ধীরে ধীরে প্রকাশ নিজেকে আবিস্কার করেন রাজ্য ক্রিকেটের একজন নিয়মিত খেলোয়াড় হিসেবে। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে আসামের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৭ সব দলেই খেলেছেন তিনি। এরপর অনূর্ধ্ব-১৯ এবং অনূর্ধ্ব-২২ দলের হয়েও খেলেছেন তিনি।

সে সময় প্রকাশ ভগতের তরুণ স্পিনার হিসেবে বেশ নামডাক হয়! ১৯৯৯ সালে ক্রিকেট ক্যারিয়ারে পদার্পণ। সেই থেকে মাত্র ৪ বছরের মাথায় নিজের ঝুলিতে যুক্ত করলেন আরেক সাফল্য। সে সময় ভারত জাতীয় দল নিউজিল্যান্ড সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

হঠাৎ মুরালি কার্তিকের ইনজুরিতে কিছুটা বিপাকে পড়ে গাঙ্গুলি-শচীনরা। কিউই বাঁ-হাতি অফস্পিনার ড্যানিয়েল ভেট্টোরি তখন বেশ ভালো ফর্মে। তাই ভেট্টোরির সামনে দাঁড়াবার আগে ব্যাট হাতে নিজেদের ঝালিয়ে নিতে চেয়েছিলেন গাঙ্গুলি-শচীনরা। বাঁ-হাতি স্পিনার মুরালি কার্তিকের ইনজুরিতে তাই বিপাকেই পড়েছিল তাঁরা।

ঠিক সেই মুহূর্তে আসামের হয়ে বিহারের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক সহ সাত উইকেট তুলে নিয়ে নজর কাঁড়েন প্রকাশ ভগত। বিজয় মার্চেন্ট ট্রফিতে অনূর্ধ্ব-১৭ দলে দুর্দান্ত পারফর্ম করে ডাক পেয়ে যান জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে (এনসিএ)। সেখানে ভগত দেখা পান তার স্বপ্নের ক্রিকেটারদের সাথে।

সৌরভ গাঙ্গুলিকে নেটে বোলিংও করেছেন ভগত। শুধু গাঙ্গুলিই নয়; ভগত দেখা পেয়েছিলেন রাহুল দ্রাবিড়, শচীন টেন্ডুলকার, ভিভিএস লক্ষ্মণ, হরভজন সিং, জহির খান ও বীরেন্দ্র শেবাগের মতো তারকাদের! সেই সুখস্মৃতি পুঁজি করে ভগত ফিরে যান নিজের রাজ্যভিত্তিক ক্রিকেটে।

এরপর ২০০৭ সালে প্রকাশ ভগত নিজের সাথে সাথে শিলচরের নামও তোলেন রাজ্য ভিত্তিক ক্রিকেটের রেকর্ড বইয়ে! ভগতের অধিনায়কত্বে নুরউদ্দিন আন্ত:জেলা ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপে শিলচর চ্যাম্পিয়ন হয় সেবার।

এমনকি ভগতের অধিনায়কত্বে চার বার আন্ত:জেলা টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলে শিলচর। এরপর ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে আসামের হয়ে খেলেছেন প্রকাশ ভগত। তার অসাধারণ পারফরম্যান্সের কারণে ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ আসরে রঞ্জি ট্রফিতে আসামের হয়ে খেলার সুযোগ পান তিনি। এমনকি সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফির স্কোয়াডেও ছিলেন তিনি।

২০১১ সালে প্রকাশ ভগতের বাবা গজাধর ভগত ৬৫ বছর বয়সে কার্ডিয়াক অ্যাটাকে পরপারে বিদায় নিলেন। সংসারে এমনিতেই ছিল টানাপোড়ন। বাবার মৃত্যুর পর বড় ভাই দিপক ভগতও অসুস্থ হয়ে পড়ে রইলেন বিছানায়।

পরবর্তীতে সংসার চালাতে ২ বছর আগে বাবার রেখে যাওয়া পাপড়ি চাটের ব্যবসা পুনরায় শুরু করেন দিপক। এরপরই বিশ্বজুড়ে করোনার হানা! এমন মহামারী অবস্থায় রাস্তার খাবার যেন বিক্রি বন্ধ প্রায়। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল ভগতের পরিবারের।

একদিকে বড় ভাইর আয়-রোজগারে ভাটা। অপরদিকে, পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খারাপ। উপায়ন্তর না দেখে প্রকাশ ভগত নিজেই রাস্তার পাশে খুলে বসলেন ডালপুড়ির দোকান। যেই শিলচরের ইটখোলায় ক্রিকেটার হিসেবে প্রকাশের বেশ নামডাক ছিল, সেখানেই পেটের দায়ে রাস্তায় নামেন প্রকাশ।

পরিবারের হাল ধরতে ক্রিকেটকে বিদায় জানাতে হয় ভগতকে। আর্থিক সাহায্য কিংবা বড় ভাইর একটা চাকরির ব্যবস্থা হলে পুনরায় তিনি ক্রিকেটে ফিরতে পারতেন বলেও আক্ষেপ করেন প্রকাশ।

তাঁর সাথে খেলা অনেক সতীর্থরাই পরবর্তীতে সরকারি চাকুরি পেলেও প্রকাশ ভগত পাননি কিছুই। এক সময় শিলচর রাজ্যের ডেপুটি কমিশনার গৌতম গাঙ্গুলি তাঁকে ডেকেওছিলেন!

ভগত তখন রাজ্যভিত্তিক দলে বেশ ভালোই পারফর্ম করছিলেন। বেশ কয়েক জায়গায় চাকুরির জন্য ভগতের নাম দিয়েছেন এই বলে ভগতকে তখন আশ্বস্ত করেছিলেন গৌতম গাঙ্গুলি। তবে একটা চাকুরিও জোটেনি ভগতের দুর্ভাগা কপালে।

একই সাথে রাজ্য ক্রিকেটে খেলা ভগতের সতীর্থরা সরকারি চাকুরি পেয়ে পরিবার নিয়ে বেশ সুখেই আছেন। আর রাজ্যের জন্য সুনাম বয়ে আনা প্রকাশ এখন সাধারণ একজন ডাল পুড়িওয়ালা। তিনি বার বার আক্ষেপ করে বলেন, ‘পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ না হলে আমি ক্রিকেট মাঠে ফিরে যেতাম।’

সেই স্বপ্ন হয়তো পূরণ হবে না প্রকাশ ভগতের, শুধু জীবনটা যেন আরেকটু সহজ হয় – এমন প্রত্যাশা ছিল। সেই প্রত্যাশা খানিকটা পূরণও হয়েছে। খবর প্রকাশের সাথে সাথে কয়েকটা জায়গা থেকে সাহায্য এসেছে। কিন্তু, স্বপ্ন? সে কি চাইলেই সবার পূরণ হয়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link