গায়ের গড়ন লম্বা, দীর্ঘদেহী। বাস্কেটবল খেলার জন্য একদম উপযুক্ত। নিজেকে আবিষ্কারও করতে চাইলেন একজন বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসেবেই। তবে ভাগ্য সেখান থেকেই তাঁকে টেনে নিয়ে আসে ক্রিকেটে।
সাল ১৯৯৫। বয়স তখন সবে মাত্র ১৬।
নিজের স্কুল ডি মাহেনদের এক ক্রিকেট ম্যাচ দেখছিলেন তিনি। তখন তাঁর স্কুল দলের একজন খেলোয়াড় কম ছিলো! দ্রুতই তখন একজনকে দলে দরকার। শেষ পর্যন্ত বাস্কেটবল খেলোয়াড় হতে চাওয়া সেই তরুণ ছেলেকেই দলে নিলো দলে নিলো তাঁরা।
বলা যায় সৌভাগ্যক্রমেই দলে সেদিন সুযোগ হয়েছিলো তাঁর। তাঁর স্কুল দলের বোলাররা সেই ম্যাচে বেঁধরক মার খাচ্ছিলো। অধিনায়কের হাতে তখন আর উপায়ও ছিলো না। বিপাকে পড়ে শেষ পর্যন্ত বল তুলে দেন আনকোড়া সেই তরুনকে। কান্দানা বিচে টেনিস বলে খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে ক্রিকেট বলে প্রথমবার বল করলেন। প্রতিপক্ষের অর্ধেক ব্যাটসম্যানকে একাই তুলে নিয়ে সেদিন নিজ স্কুলের মান রক্ষা করেন সেই তরুণ বালক।
সেই এক ম্যাচ, সেই এক সুযোগ! ব্যাস, বাস্কেটবল মাঠ থেকে পুরোপুরি যোগ দিলেন ক্রিকেট মাঠে। নিজের স্কুল দলের বোলিংয়ের অন্যতম ভরসার নাম হয়ে উঠলেন তিনি। এর কিছুদিন পর আরেক টুর্নামেন্টে সাবেক লঙ্কান অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা প্রধান অতিথি হিসেবে এলেন। প্রতিভাবান খুঁজে বের করার জন্য নিখুঁত চোখের প্রয়োজন। আর সেটা রানাতুঙ্গার কাছে বরাবরই ছিলো।
ওই টুর্নামেন্টের ম্যাচে ডি মাহেনদের সেই তরুন বোলারকে চোখে পড়লো রানাতুঙ্গার। দুর্দান্ত গতি আর ব্যাটসম্যানদের চোখে আতংকের কারণ হওয়া সেই ছেলেকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যান রানাতুঙ্গা। সেখান থেকেই ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায় সেই তরুনের। রানাতুঙ্গা সেই তরুণকে ছেলেকে সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবে (এসএসসি) নিয়ে নিলেন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি বাস্কেটবল থেকে ক্রিকেটে আসা সেই তরুণের।
১৯ জুলাই, ১৯৭৯। শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে জন্মগ্রহণ করেন সেই তরুণ প্রতিভাবান পেসার। নাম দিলহারা ফার্নান্দো। তাঁর দুর্দান্ত গতিতে যিনি ক্যারিয়ারে কত বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদের ২২ গজে ভুগিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। রানাতুঙ্গার হাত ধরেই ফার্নান্দোর প্রোফেশনাল ক্রিকেটে উঠে আসা। ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজের প্রতিভা আর সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে দিয়ে একের পর এক উন্নতির সিঁড়ি চাপরে উঠছিলেন উপরের দিকে। তিন বছর সিংহলিজ ক্লাবের হায়ে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের পর সুযোগ পেলেন স্বপ্নের জাতীয় দলে।
১৪ জুন, ২০০০। পাকিস্তানের বিপক্ষে কলম্বোতে টেস্ট অভিষিক্ত হন পেসার দিলহারা ফার্নান্দো। চামিন্দা ভাস ও নুয়ান জয়সার সাথে পেসত্রয়ী হিসেবে দলে যোগ দেন ফার্নান্দো। ওয়াসিম আকরামের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে লঙ্কানদের হারার ম্যাচে দুই উইকেট শিকার করেন ফার্নান্দো। পরবর্তীতে একই বছর ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম বিদেশ সফরে সুযোগ পান তিনি।
সেখানে দুর্দান্ত বোলিং করে ফার্নান্দো শিকার করেন টেস্টে মেইডেন ফাইফর। ওই টেস্ট ড্র হলেও ফার্নান্দো তাঁর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে নজরকাঁড়েন সবার। একই সিরিজে ওয়ানডেতেও অভিষিক্ত হন তিনি। তবে সেখানে নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারেননি তিনি। তিন ম্যাচে বেশ রান দিলেও শিকার করেন মোটে এক উইকেট!
একই বছর ভারতের বিপক্ষে গল টেস্টে ক্যারিয়ার সেরা ৪২ রানে ৫ উইকেট শিকার করেন তিনি। ১২৪ রানে ৩ উইকেট থেকে ফার্নান্দোর দাপটে ১৮৭ রানেই ৯ উইকেট হারায় ভারত। ফার্নান্দোর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে ১০ উইকেটের জন্য পায় লঙ্কানরা। ফার্নান্দো নিজের প্রতিটা ডেলিভারিতেই তাঁর শক্তির শেষ অংশটুকাও তিনি খরচ করতেন। তবে অতিরিক্ত গতি জেনারেট করতে গিয়ে বের কয়েকবার ইনজুরিতেও পড়েছেন তিনি। এছাড়া ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে বেশ কয়েকবার খরুচেও ছিলেন তিনি।
সাল ২০০২। ইংল্যান্ড, ভারত ও শ্রীলঙ্কার ন্যাটওয়েস্ট সিরিজে ফার্নান্দো ৫ ম্যাচে ১০ উইকেট শিকার করেন। ২০০৩ এবং ০৪ এর মাঝামাঝি সময়ে দুইবার ব্যাক ফ্র্যাকচারে কিছু সময় দলের বাইরে থাকেন তিনি। পরবর্তীতে ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে কলম্বোতে বাংলাদেশের বিপক্ষে এক টেস্টে ক্যারিয়ার সেরা ৯৫ রানে ৭ উইকেট শিকার করেন তিনি। প্রথম ইনিংসে ফার্নান্দোর ৬০ রানে ৫ উইকেট শিকারে বাংলাদেশ মাত্র ১৯১ রানেই গুড়িয়ে যায়। দ্বিতীয় ইনিংসে ১৯৭ রানে অলআউট হবার পথে ৩৫ রানে ২ উইকেট শিকার করেন তিনি।
১৫ই জুন ২০০৬। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন ফার্নান্দো। পরের বছর ২০০৭ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে ঘরের মাঠে ক্যারিয়ার সেরা ২৭ রানে ৮ উইকেট শিকার করেন তিনি। প্রথম ম্যাচে জয়ের পর পরের তিন ম্যাচেই হেরে যায় লঙ্কানরা। তবে শেষ ম্যাচে ফার্নান্দোর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে জয় পায় লঙ্কানরা।
ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই ইনজুরি তাঁর জন্য বেশ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে তিনি কখনোই দমে জাননি। ইনজুরি কাটিয়ে ফিরে এসেছেন বারবার।
২০০৭ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ মূহুর্তে ফার্নান্দোর ম্যাজিকে সুপার এইটে জয় পায় লঙ্কানরা। শ্রীলঙ্কার দেওয়া ২৩৬ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে শেষ বলে জিততে ইংলিশদের প্রয়োজন তখন তিন রান। স্ট্রাইকে ছিলেন দুর্দান্ত ব্যাটিং করা অলরাউন্ডার রবি বোপারা।
ফার্নান্দো বল করার জন্য দৌড় শুরু করলেন রবি বোপারা কিছুটা অফে সরে এসে লেগ সাইডে শট খেলার জন্য প্রস্তুত। শেষ মূহুর্তে এসে বল না ছেড়ে পুনরায় বোলিং প্রান্তে ফিরে যান ফার্নান্দো। এরপর আবার দৌড় শুরু করলেন বল করলেন স্টাম্প টু স্টাম্প। দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে রবি বোপারার অফ স্টাম্প উড়ে যায়! শেষ মূহুর্তে ফার্নান্দোর দুর্দান্ত ডেলিভারিতে সুপার এইটে ২ রানের জয় পায় লঙ্কানরা।
পরবর্তীতে ২০০৯ সালে ফার্নান্দোর বিপক্ষে ম্যাচ ফিক্সিং এবং জুয়ার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে। মিডিয়া সহ বিভিন্ন মাধ্যমেই এই খবর ছড়িয়ে পড়ে। তবে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থা (আইসিসি) থেকে জানানো হয় ২০০৯ সালে তারা যখন শ্রীলঙ্কায় যায়, সেখানে ফার্নান্দো তাঁর অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারার মাধ্যমে বিষয়টি টিম ম্যানেজমেন্টকে জানায়।
আর তাঁদের মাধ্যমেই আইসিসি জানতে পারে যে জুয়াড়িরা ফার্নান্দোর সাথে যোগাযোগ করে। তবে, আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিট (আকসু) ফার্নান্দোর বিরুদ্ধে সরাসরি ম্যাচ ফিক্সিং কিংবা এ যাবতীয় কোনো কান্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পাননি।
এরপর ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে রেকর্ড গড়ে প্রথমবারের মতো টেস্ট জয় পায় শ্রীলঙ্কা। শেষ দুইদিনে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ছিলো ৪৫০ রান, আর লঙ্কানদের দরকার ১০ উইকেট। দুর্দান্ত এক বাউন্সারে গ্রায়েম স্মিথকে ফিরিয়ে সূচনা করেন ফার্নান্দো। এরপর অ্যাশওয়েল প্রিন্সকে ফিরিয়ে দ্বিতীয় উইকেট শিকার করেন তিনি। সেই ম্যাচে লঙ্কানরা ২০৮ রানের জয় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তাদের মাটিতে প্রথম টেস্ট জয় ছিনিয়ে নেয়।
পরের বছরই পাকিস্তানের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলেন। অধারাবাহিকতা, ইনজুরি ছাড়াও নতুনদের সুযোগ দিতে জায়গা হারাতে হয় তাকে। ওয়ানডে এবং টেস্টেও খুব বেশিদিন আর খেলতে পারেননি তিনি। অতিরিক্ত গতি জেনারেট করতে যেয়ে নো বল আর অতিরিক্ত রান দেওয়ার কারণে অনেক ম্যাচেই খরুচে বোলিং করেন তিনি। ওয়ানডে ক্যারিয়ার বেশ লম্বা হলেও টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে খেলতে পারেননি খুব বেশি ম্যাচ। সব মিলিয়ে ক্যারিয়ারের শেষটা মোটেও নিজের মতো করে কাটাতে পারেননি তিনি।
টেস্টে ৪০ ম্যাচে ১০০ উইকেট শিকার করেছেন তিনি। ৩ বার শিকার করেছেন পাঁচ উইকেট। ১৪৭ ওয়ানডে ম্যাচে শিকার করেন ১৮৭ উইকেট। যার মধ্যে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন ১ বার। ক্যারিয়ার সেরা ২৭ রানে ৬ উইকেট। টি-টোয়েন্টি তে ১৮ ম্যাচে নেন ১৮ উইকেট, ক্যারিয়ার সেরা ১৯ রানে তিনটি।
এছাড়া ঘরোয়া ক্রিকেটে ৪০৯ ম্যাচে শিকার করেছেন ৭২৫ উইকেট, পাঁচ উইকেট নিয়েছেন চারবার। ফার্নান্দো ২০০৮ সালে কাউন্টিতে উস্টারশায়ারের হয়ে খেলেছেন। এছাড়া ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে খেলার সুযোগ পান তিনি।
ফার্নান্দোকে যেকোনো ম্যাচে কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারার ক্ষমতা ছিল। তাঁর বোলিংয়ের বিশেষত্ব ছিলো একদিকে তিনি যেমন দুর্দান্ত গতিতে বল করতে পারেন, নিয়মিত পেস জেনারেট করতে পারেন! তেমনি ইসপ্লিট-ফিঙ্গার ব্যবহার করে তিনি দারুণ স্লোয়ার ডেলিভারিও করতে পারতেন। তাঁর বলের দুর্দান্ত গতির জন্য জাতীয় দলে সুযোগ পেলেও ম্যাচ ও উইকেটের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী তিনি দারুণ স্লোয়ার বলও করতেন। চাপের মুহূর্তে স্নায়ুচাপ ধরে রেখে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারতেন তিনি। অধিনায়কদের ভরসার শেষ আশ্রয়স্থলও বলা চলে তাঁকে।
অসাধারণ পেস আর পেশি শক্তির কারণে চামিন্দা ভাসের অবসরের পর তাঁর মধ্যে সবরকম সম্ভাবনাই ছিলো লঙ্কানদের সেরা পেসার হবার। তবে ইনজুরি আর অধারাবাহিকতাই তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। যার কারণে হতে পারেননি লঙ্কানদের ইতিহাসের সেরা পেসার।
প্রতিবার যখনি ইনজুরি থেকে ছিটকে গেছেন দল থেকে, একইভাবে লড়াই করে ফিরেছেন সিংহের মতোই। কিন্তু সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের ক্রিকেটে তাঁর লাইন-লেন্থ এবং অতিরিক্ত নো বল করার প্রবণতার কারণে নিজেকে সেরাদের কাতারে নিয়ে যেতে পারেননি তিনি।
নুয়ান কুলাসেকারা, অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস এবং থিসারা পেরেরাদের আসার পর দলে জায়গা করাটা বেশ মুশকিল হয়ে পড়ে ফার্নান্দোর জন্য। ২০১২ সালে তিন ফরম্যাটের দল থেকেই বাদ পড়লেন। এরপর আর দলে ফেরার কোনো সম্ভাবনাই ছিলো না তাঁর।
এরপর চার বছর বাদে ২০১৬ সালে লাসিথ মালিঙ্গার ইনজুরিতে আবারো ডাক পান তিনি! ভারতের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে সুযোগ পান ফার্নান্দো। সেখানে অবশ্য মাত্র এক ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তিনি। এরপর আর কখনো জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়াতে পারেননি এই পেসার।