তখন বাড়িতে স্পোর্টস্টার আসত, আনন্দবাজারের স্পোর্টসওয়র্ল্ড কালেভদ্রে। ম্যাচ রিপোর্টটা সেখানেই পেলাম। সফরকারী ডেভিড গাওয়ারের ইংল্যান্ড দলের সঙ্গে রবি শাস্ত্রীর নেতৃত্বে ভারতের অনূর্ধ্ব-২৫ টিম। ওপেনিং-এ শ্রীকান্ত, মিডল অর্ডারে মহম্মদ আজহারউদ্দিন, গুরশরণ সিং, রঞ্জিত খানবিলকর আর আর মাধবন। বোলিং-এ মনোজ প্রভাকর, রাজিন্দর সিং ঘাই, গোপাল শর্মা অফস্পিনার আর লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণণ।
রবি শাস্ত্রী তো ছিলই। কিন্তু রবি শাস্ত্রী ম্যাচটায় ব্যাট করেনি। উলটো দিকে, ইংল্যন্ডের পুরো টিম, ফাউলার, রবিনসন, গ্যাটিং, গাওয়ার, ল্যাম্ব, পল অ্যালট, প্যাট পোকক, ভিক মার্ক্স, নীল ফস্টার, উইকেট কিপার পল ডাউনটন। ভারতের ছিল সদানন্দ বিশ্বনাথ।
এতগুলো নাম বলার কারণ হল, পঁয়ত্রিশ বছর পরেও মনে আছে যে। সেই ম্যাচটায় একটা ছেলে দেড়শ রান করে। ছেলেটা নাকি বিশ্বনাথের সুযোগ্য উত্তরসূরি। একইরকম কবজির মোচড়, এমএল জয়সীমার আবিষ্কার। এইসব।
বয়স অল্প তখন, মুম্বাইতে শিবরামকৃষ্ণণের বারো উইকেটে জেতার পর দিল্লীতে ভারত হারল। আর তৃতীয় টেস্টে ইডেনে ডেবিউ করল ভাইজার ছাড়া সবুজ হেলমেট পরিহিত, সাইমন্ডসের ব্যাট হাতে একটি কৃশকায় শকুনের চেহারার একলব্য। হাফ টিশার্ট পরে ধনুকের মতো বাঁকা শরীর মাঠে যখন নামছে বাঁ হাতে ব্যাটের গ্রিপ আর ডান হাতে ব্যাটের ওজন নিয়ে, ততক্ষণে মোহাম্মদ আজিজুদ্দিন আজহারউদ্দীন আমার উৎসাহের খাতায় উঠে গেছে।
আসলে ওই বয়সটায় একটা ফেভারিট লাগে। প্রিয়তম। আর তখন তো ক্রিস এভার্টের থেকে মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা বা বিয়র্ন বর্গের থেকে জন ম্যাকেনরোকেই হৃদয় দিয়ে দিয়েছি। খেলাটাই শুধু নয়, সাফল্যই শুধু নয়। কীভাবে খেলে সেটাই বড়ো কথা।
আজহারকে খাতায় তোলা অবশ্য আলাদা গল্প। বুক ক্রিকেট খেলছিলাম, ইডেন টেস্টের তখনও দুদিন বাকি। আমরা ইতোমধ্যেই জেনে গেছি যে সন্দীপ পাতিলের জায়গায় সেই অনূর্ধ্ব-পঁচিশের তিন নম্বরে নামা ছেলেটি টিমে আসছে। পাঁচে ব্যাট করবে। বুক ক্রিকেটে সেদিন বোধহয় কোনোভাবে ১০, ২০, ৩০-এর পাতাগুলো পথ হারিয়ে ফেলেছিল অথবা শূন্যর সঙ্গে বেইমানি করে ক্রিকেট দেবতা তুলির পোঁচে সেসব মুছে দিয়েছিলেন।
ছেলেটা গ্যারি সোবার্সের রেকর্ড ভেঙে দিল বুক ক্রিকেটে। তখনও বাঁ পায়ের উপর শাফল করে অফ স্টাম্পের উপরের বলটাকে মিড উইকেট বাউন্ডারিতে পাঠানো বা অফ স্টাম্পের উপর হাফভলিকে ঈষৎ ত্যারছা ব্যাটে ব্যাকফুটে কাস্তের মতো শরীর বেঁকিয়ে কভার ড্রাইভ। অথচ সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছিল। একজন প্রাক-টিনএজ খেলাপাগল, হাফপ্যান্ট পরা বাঁহাতি স্পিনারের স্বপ্নের ক্রিকেটার হঠাৎ হাজির হয়ে গেছিল ভাঙা দাঁতে হাতের থেকে বড়ো সাইমন্ডস গ্লাভস আর কালো গ্রিপের সাইমন্ডস ব্যাট নিয়ে।
কিন্তু এই মঞ্চ তো আজহারউদ্দীনের ছিল না। বস্তুত আগের টেস্টের দায়িত্বজ্ঞানহীন শটে ম্যাচ হারার পর কপিলদেবের বাদ পড়ার পরে প্রতিবাদের মঞ্চ ছিল সেটা। ‘নো মুস্তাক, নো টেস্ট’-এর মতো ধ্বনি কপিলদেব রামলাল নিখাঞ্জের জন্য ইডেন জুড়ে উঠেছিল।
এমনই এক পরিবেশে প্রবেশ ঘটল একুশ বছরের তরুণের। পরিপক্বতা বা প্যাঁচ তখনও তাকে স্পর্শ করেনি। বাতাসে তখনও মেশেনি ঔদ্ধত্যের বিষ।
রিচার্ড এলিসন বোলার ছিলেন মনে হয়। তিন উইকেট পড়ার পর রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে জুটি বাঁধতে ছেলেটা মাঠে নামে। সবুজ হেলমেট, কপালের উপর একটু তোলা, কানে ফাইবারের ইয়ারগার্ড।
খুব যে মারমার কাটকাট ইনিংস ছিল তা তো নয়। কিন্তু কবজির মোচড়টা ছিল, ছিল ব্যাকফুট ড্রাইভের সময় জিভ বার করে মুখ বেঁকিয়ে দেওয়া। ব্যাট নিয়ে কোলে করে দুলে দুলে রুদ্ধশ্বাস ছোটা ছিল, সেঞ্চুরির পর ব্যাট তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে সদ্যপ্রয়াত দাদুকে স্মরণ করা ছিল। শিবরামকৃষ্ণণের বলে সিলি মিড অফে পিঠ বেঁকিয়ে অনবদ্য ক্যাচ ছিল। আর ছিল বিশ্বরেকর্ড ভাঙা প্রথম তিন টেস্টের সেঞ্চুরি।
প্রথম সীমিত ওভারে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেই বোধহয় ৪৭ রান করেছিল। কিন্তু সীমিত ওভারের ক্রিকেটে প্রথম রাজসিক ঘোষণা হল মেলবোর্নে ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাপ বা মিনি ওয়র্ল্ড কাপের গ্রুপের ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে। ইমরান, তাহির নক্কাশ, ওয়াসিম আর মুদাসসর নজরের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অপরাজিত ৯৩।
এরপর হুসেন সাগর লেক দিয়ে অনেক অনেক জল বয়ে গেল। জীবনের প্রথম ব্যর্থতা শ্রীলঙ্কা সামলে ৮৭-র ইডেনে আবার সেঞ্চুরি, ওয়েস্ট ইন্ডিজে পালিয়ে যাবার অভিযোগ, সব মিলিয়ে প্রথম সন্ধিক্ষণ এল ১৯৮৯-তে পাকিস্তানে। প্রথম টেস্টে তিন নম্বরে রমণ লাম্বা আজহারের জায়গায় খেলবে এটা একপ্রকার নিশ্চিত। আজহারের তৃতীয় স্লিপ থেকে নামা ব্যাট বারবার প্যাডের কাছাকাছি আসতে ব্যর্থ হচ্ছে। পরিত্রাতার ভূমিকায় এলেন জাহির আব্বাস। এশিয়ার ব্র্যাডম্যান। আজহারের বাঁ হাতের গ্রিপটা তখন প্রায়ই ঘুরে যাচ্ছে ব্যাটের পিছন দিকে ব্যাটের মুখ আগেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে স্বভাবসিদ্ধ ফ্লিকের তাড়নায়।
জাহির দেখে শুধু বাঁ হাতের গ্রিপটা ঘুরিয়ে দেন ব্যাটের ধার বরাবর। বাকিটা ইতিহাস। বাকিটা… ইতিহাসই। প্রথম টেস্টে দুই ইনিংসে ৩৫, তারপর দ্বিতীয় টেস্টেই শতরান। পিছনে ফিরতে হয়নি আজহারকে। রাজ সিং দুঙ্গারপুরের সেই বিখ্যাত, ‘মিয়াঁ কাপ্তান বনোগে?’ দিয়ে শুরু এশিয়া কাপের দুটো ম্যাচেই পরাজয়। নিউজিল্যান্ডে সিরিজ হারের মধ্যেও অধিনায়কের ১৯২। অধিনায়কত্বে পরিপক্বতা আসেনি তখনও। ম্যানেজার বিষাণ সিং বেদি ঘোষণাই করে দিলেন পুরো টিমকে প্রশান্ত মহাসাগরে ফেলে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে তাঁর।
কিন্তু বিপর্যয় আরও অপেক্ষা করছিল। ইংল্যান্ড সফরের ব্যাটিং সহায়ক লর্ডসের প্রথম টেস্টে টসে জিতে ফিল্ডিং আর ৩৩ রানে বিপক্ষের অধিনায়ক গ্রাহাম গুচের ক্যাচ উইকেট কিপার কিরণ মোরে ছাড়ল। রানের পাহাড়ে চড়ে বসল ইংল্যান্ড।
এসব ক্ষেত্রে যখন নতুন অধিনায়ক ব্যাট করতে নামে তখন সতর্কতাই পাথেয়। কিন্তু আজহার তো সাধারণ মানবধর্ম পালন করতে আসেননি। অশোক মালহোত্রা পরে বলেছিলেন, ‘আজহার যখন ব্যাট করতে নামে তখন লোকাল ক্রিকেটে আমিও ব্যাট করতে নেমেছিলাম। টি থেকে ম্যাচের শেষ পর্যন্ত পঞ্চাশ করে ফিরে এসে শুনি আজহার লাঞ্চের আগেই একশ করে ফেলেছেন। আদতে ১২১।
এডি হেমিংসের বলে যখন লাইন মিস করে আউট হয়ে ফিরে যাচ্ছেন তখনও ভারত বিপন্মুক্ত নয়। যা আদতে ঘটল হেমিংসেরই বলেই। শেষ উইকেটে হিরওয়ানিকে সঙ্গে নিয়ে চার বলে চারটি ছয় মেরে ফলোঅন বাঁচান কপিল দেব। ভারত তখনও জেতেনি ম্যাচটা। কিন্তু ব্রায়ান জনস্টনের মতো বিদগ্ধ ভাষ্যকরও স্বীকার করেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইংল্যান্ডের মাটিতে সেরা ইনিংস।
রবি শাস্ত্রী নিজের কমেন্ট্রিতে একটি শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন, ‘ট্রেসার বুলেট’। কিন্তু আজহারের হাতে বন্দুক ছিল না। এ যেন মধ্য আমেরিকার নাইফ ফাইট। দুটো হাতে ছোট্ট ছ ইঞ্চির ছুরিতে স্ক্যালপেলের দক্ষতায় প্রতিপক্ষকে ফালাফালা করে ফেলা। অ্যাঙ্গাস ফ্রেজার সেই সিরিজে বলকে কথা বলাচ্ছেন। ডেভন ম্যালকম আগের সিরিজেই রিচি রিচার্ডসনের হাত থেকে ব্যাট ফেলে দিয়েছেন।
সেই ম্যালকম, ফ্রেজার, লুইস, হেমিংস বস্তাবন্দি করে দু’ঘণ্টার জন্য লর্ডসের প্যাভিলিয়নে বসিয়ে দিয়ে লেট কাট, স্কোয়ার কাট, ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট দিয়ে স্কোয়ার ড্রাইভ, বোলার্স ব্যাক ড্রাইভ, আর ফ্লিক, লেগ গ্লান্স তো আছেই। তখন আজহারউদ্দিন ভিনগ্রহের প্রাণী। সাধারণ ক্রিকেটকে দৈনন্দিন আলুভাতানির প্রকোপ থেকে বাঁচাবার জন্য স্ল্যাজেঞ্জার ব্যাট হাতে অবতীর্ণ হয়েছেন।
ডার্বিশায়ারের হয়ে পরের বছর অভিষেক হল কাউন্টিতে। সোনার ফর্ম, জীবনে প্রথম প্রথম শ্রেণির ডবল সেঞ্চুরি এই সময়েই। ৯৩-৯৪র সিজনটা পুরো খেলতে পারেননি, আন্তর্জাতিক ম্যাচ থাকায়। কিন্তু সিজনের মাঝপথে উড়ে গিয়ে উত্তর ইংল্যণ্ডের ভিজে উইকেটে জেট ল্যাগ না কাটিয়ে নেমে পড়ে এক অনবদ্য কাব্যিক সেঞ্চুরির কথা কাউন্টির লোকেরা এখনও বলাবলি করে।
নতুন ইনিংসের এই শুরু। তারপর ম্যানেজার অজিত ওয়াদেকর আর স্পিন ত্রৈকা অনিল কুম্বলে- বেঙ্কটপতি রাজু- রাজেশ চৌহানে ভর করে দেশের মাটিতে পরপর নটি টেস্ট জয়। হিরোকাপের সোনার ফর্ম, অ্যাডিলেডের সেঞ্চুরি, বিশ্বকাপে তিনশ রান। এসব পেরিয়ে কন্ট্রোভার্সি আর বিতর্ক। বিবাহ বিচ্ছেদ, সৌরভ রাহুলের মঞ্চে আগমন, সচিনের বিশ্বত্রাস হয়ে ওঠা। এসব তো ছিলই। মাঝে অধিনায়কত্ব হারিয়ে সাধারণ প্লেয়ার হিসাবে মঞ্চে প্রবেশ।
এই সময়েরই একটা ইনিংস বারবার করে মনে পড়ে। আসলে একটা নয়, ওই সময়ের তিনটে। প্রথমটা আমার দেখা শেষ সম্পূর্ণ ইডেন টেস্ট। ৯৭, দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রায়ান ম্যাকমিলানের বলে কনুইয়ে চোট লাগার দিন বিকেলেই ফিরে যেতে হয়েছে।
সকালে এল ব্লকে বসে আছি। অর্থাৎ ইডেনের ক্লাব হাউসের বাঁদিকে। ইতোমধ্যেই যোগ্য উত্তরসূরি এসে গিয়েছে। ভেঙ্কট সাঁই লক্ষ্মণ। তখনও ভেরি ভেরি স্পেশাল হননি তিনি। তবুও, নয়ন মোঙ্গিয়া আউট হতে সবে ভেবেছি জাভাগল শ্রীনাথ নামবেন। ও মা, সাদা হেলমেটে বাঁ হাতে ব্যাট বৃত্তাকারে ঘোরাতে ঘোরাতে সূর্যের দিকে দুবার তাকিয়ে মাঠে নামলেন সেই আজহারউদ্দিন, নাকি খোঁচা খাওয়া চিতাবাঘ।
সামান্য ওপেন স্টান্স। মিড উইকেটের দিকে শরীর ঘুরিয়ে মিড অনের দিকে সামনের পা। এরপর যেটা শুরু হল সেটাকে আড়ং ধোলাই বলে। শুধুমাত্র জামাকাপড় কেন, মনের গ্লানি, দুশ্চিন্তা সবই ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। বিশেষ ভালোবাসা তোলা ছিল সেই টেস্টে অভিষেক করা ল্যান্স ক্লুসনারের জন্য। সেই টেস্টেই সাত উইকেট নিয়ে ভারতকে খাদের ধারে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি। সেই ক্লুসনারকে অবলীলায় এক ওভারে পাঁচটা চার। গায়ে করা বলগুলো মিড উইকেটের উপর দিয়ে ফেলে দেওয়া।
এমনকি বিশ্বত্রাস সাদা বিদ্যুৎ অ্যালান ডোনাল্ডের একটি অতিরিক্ত উঁচু বাউন্সারকে কেজরিওয়াল কায়দায় মাথার উপর ঝাড়ু ঘুরিয়ে স্কোয়ার লেগের উপর দিয়ে চার। পল অ্যাডামসকে লং অনের উপর দিয়ে বি ব্লকে ফেলে দেওয়া। ইডেন উদ্যান তখন ইডেন উত্তাল। যদিও মনে করা যেতে পারে অনিল কুম্বলের ৮৮-তে আটকে যাওয়ার পিছনেও আজহার ছিলেন, আর-একটু ধরে খেললে অনিল সেঞ্চুরি করতে পারতেন হয়তো। তবুও ওই ইনিংসটা স্মৃতির মণিকোঠায় অম্লান হয়ে গেল।
পরের টেস্ট কানপুরে, প্যাট সিমকক্স, পল অ্যাডামসকে শুধুমাত্র লাইনের বাইরে ব্যাটে ঘূর্ণি পিচে নির্বিষ করলেন তিনি। ১৬৩। ফ্রন্টফুট লেগ স্টাম্প বরাবর নিয়ে ব্যাটের চাপে বল মাটিতে আর ব্যাকফুটে লেগ স্টাম্পে এসে স্পিনের বিপরীতে কাট, ড্রাইভ।
এমনি একটা টেস্ট ইনিংস ছিল নিউজিল্যান্ডে। নিউজিল্যান্ডের পেসার সাইমন ডুল সেই টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৭ উইকেট নিয়েছিলেন। গোখরোর মতো স্যুইং, ঘাস থেকে ছিটকে ছিটকে উঠছে বল। এখানেও বলকে নিজের অফসাইডে রেখে স্কোয়ার ড্রাইভ আর স্কোয়ার কাটের একটা বিরল কাব্যগাথা।
ফিরে যাই দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্টে। কেপটাউনের দ্বিতীয় টেস্টে যখন ব্যাট করতে এলেন, ভারত পাঁচ উইকেট মাত্র আটান্নয় হারিয়ে ধুঁকছে। তার আগের টেস্টে ১০০ আর ৬৬-তে অল আউট হয়েছে। এমতাবস্থায় সচিনের স্থৈর্যকে সাহস দিতে আজহার নিজের ফেন্সিং ইপোটি বার করলেন আবার। পরবর্তী ১৫ ওভারে ১১০ উঠল। তার মধ্যে পরপর দশটি চার। এমন মনে করা হচ্ছিল যে ল্যান্স ‘জুলু’ ক্লুসনার আজহারের প্রিয় বোলারে পরিণত হয়েছেন। যাঁকে কিটব্যাগে করে যে-কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়।
এসবই চলছিল। হঠাৎ এল সেই খবর যা আমাদের মতো আজহারপ্রেমীর বুকে ছুরি চালিয়ে দিল। ম্যাচ ফিক্সিং কাণ্ডে নাম উঠল আজহার, জাদেজা, নয়ন মোঙ্গিয়া, অজয় শর্মা, মনোজ প্রভাকরদের। ভারতীয় ক্রিকেটের কালো অধ্যায়। আরও কালো হয়ে দেখা দিল আপামর আজহারপ্রেমীদের কাছে। তখন সদ্য সদ্য চাকরি নিয়ে দিল্লিতে এসেছি। মনে আছে একটা মেল লিখেছিলাম, রক্তক্ষয়ের আখ্যান।
যে লোকটাকে শচীন টেন্ডুলকারেরও আগে রেখেছি, বাঙালি হয়েও সৌরভের উপরে ভালোবেসেছি, কপিল, গাভাসকার, ভেঙসরকার ছাপিয়ে যাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছি, সে ক্রিকেটকে নিজের জীবন থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে! এভাবে? চন্দ্রচূড় কমিটি, সিবিআই সব কিছু প্রমাণ করতে পারেনি কোর্টে, সসম্মানে ছাড়া পেয়েছেন। কিন্তু ক্রিকেট আর ফিরিয়ে নেয়নি। বর্তমানে হায়দ্রাবাদ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হলেও না। কপালে ৭৮৬বার লিখে দেওয়া হয়েছে ‘চোর’ ‘গাদ্দার’ ‘বিশ্বাসঘাতক’। হাতের সেই ছ ইঞ্চির ছুরি, গদাযোদ্ধাদের মাঝে পালক নিয়ে ছবি-আঁকিয়ের সেই তুলিতে রক্তের লাল, বিশ্বাসভঙ্গের কালো।
তারপর? তারপর আর কি! সচিন সৌরভ রাহুল অনিল লক্ষ্মণের হাত ধরে পরবর্তীতে ধোনি যুবরাজ হরভজন শেহবাগ জাহিরকে স্পর্শ করে সেই কলঙ্কময় অধ্যায় থেকে ভারত বেরিয়ে এসেছে। বিশ্বজয় করেছে দু-দুবার। বর্তমানে টেস্টে এক নম্বর টিম। নতুন নতুন কত সুপারস্টার! শর্মাজি কা দামাদ আর শর্মাজি কা বেটা আজকের আধুনিক ভারতের ক্রিকেট ঈশ্বর। ক্রিকেট খেলাটাই ঘুরে গেছে এখন ২৭০ ডিগ্রি।
কিন্তু ওই তসরের উপর সুতো দিয়ে ছবি আঁকা ব্যাটিং, ওই বিশ্বমানের ফিল্ডিং, এক অ্যাকশনে বল ধরে ছুড়ে দেওয়া বা পার্থে সচিনের বলে অ্যান্ডারসন কামিন্সের ক্যাচে টাই, স্ল্যটারের এক হাতে আম পাড়ার মতো ক্যাচ। ব্যাকওয়র্ড পয়েন্ট বা কভার থেকে বল ধরে বিদ্যুৎগতিতে উইকেট ভেঙে দেওয়া, ডান কাঁধ ঝুঁকিয়ে ক্রিকেট ব্যাকরণকে মিডউইকেট বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া ব্যাটিং, চিতার গতিতে রানিং বিটুইন দ্য উইকেট, প্যাডল স্যুইপ, লেট কাট, হাফভলিতে ব্যাকফুট ড্রাইভ- এগুলো যেন স্মৃতির পাতায় পিঠ দিয়ে বসে রোদ সেঁকে রোজ।
গাভাস্কার ৮৭-তে বলেছিলেন, ‘আমার সব রেকর্ড আজ্জু ভেঙে দেবে।’ ভাঙেনি সে, এমনকি দ্বিশতরানও নেই। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ১৯৯-তে রবি রত্নায়েকের বলে এলবিডব্লিউ হওয়াটাই সর্বাধিক। তবু ২২টা সেঞ্চুরির মালিকের জন্য ক্রিকেট বিধাতা বোধহয় আমাদের মতো সংখ্যালঘু প্রেমিকদের হৃদয়ে আলাদা অলিন্দ বেঁধে রেখে দিয়েছেন। মোহাম্মদ আজিজুদ্দিন আজহারউদ্দীন সেখানে প্রতিদিন সকালে বসে ক্যালিগ্রাফি করেন আর মোমের আলোয় সন্ধ্যায় সেতারের মূর্ছনা তোলেন। তুলবেন, আজীবন, আমরণ।
কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক