দীপক চাহার: নির্ভুলতার প্রশস্ত পথ

শ্রীলংকার বিপক্ষে ৮২ বলে অপরাজিত ৬৯ রানের ম্যাচজয়ী ইনিংসের পর সাবেক ক্রিকেটার থেকে শুরু করে কোচ সবাই দীপক চাহারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। লঙ্কান বোলারদের তোপে বাকি ব্যাটসম্যানরা যেখানে খাবি খেয়েছেন সেখানে চাহার ছিলেন সাবলীল। অধিকাংশ শটেই টাইমিং ছিল চমৎকার, খেলেছেন ব্যাটের মাঝখান দিয়ে। বোলার হয়েও দারুণ ব্যাটিংয়ের রহস্যও খোলাসা করলেন চাহারই।

‘আমার ধারণা বেসিক ব্যাপারগুলো আমি ঠিক রেখেছিলাম। আপনি যদি সুইং বোলার হতে চান তবে বলের সিম ঠিক রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যদি বল সিম বরাবর সোজাসুজি না পড়ে তবে আপনি সুইং করাতে পারবেন না। ব্যাটিংয়ের ক্ষেত্রেও একই। আপনি যতটা সোজাসুজি ব্যাটে খেলবেন, ব্যাটের মাঝখানে লাগার সম্ভাবনা তত বেশি।’

তার ব্যাটিং সবাইকে অবাক করলেও যারা তাকে আগে থেকেই চেনেন তারা কিন্তু মোটেই অবাক হননি। চাহারের এমন ব্যাটিং আজকে নতুন নয়। ব্যাটিংয়ের প্রতি তার আত্ননিবেদনের শুরু এই শতাব্দীর শুরুর সময় থেকেই।

সে সময়টাতে জেলা ক্রিকেট লিগে হনুমানগড় অনেক নাম করেছিল। তাদের কোচ নাভেন্দু ত্যাগির হাতে আটজন কোয়ালিটসম্পন্ন পেসার ছিলেন যারা কিনা নিয়মিত ভালো করতেন। ফলে ত্যাগিকে প্রায়শই একাদশ সাজানো নিয়ে ঝামেলাই পড়তে হতো। অবশেষে ত্যাগি এক সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যারা ব্যাটিংয়ে দুর্বল তাদের বেঞ্চ করবেন এবং ব্যাটিংয়ে জোর দেবার কথা বলবেন। ত্যাগি ভাগ্যবান ছিলেন কারণ লোকেন্দর সিং চাহার তার ছেলে দীপককে জাতীয় দলের পেস বোলিং আইকন বানাবার স্বপ্ন দেখলেও ব্যাটিংকে অবহেলা করেননি।

‘সে বেশিরভাগ সময় পাঁচ নম্বরে ব্যাট করতো। কোনো কোনো সময় আরো আগেও নামতো’, বলেন ত্যাগি।

একদম শুরু থেকেই লোকেন্দর সিং তার ছেলে দীপককে ক্রিকেটার বানানোর ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। ত্যাগির ভাষায় তিনি যেন জ্যোতিষীদের মতো জানতেন দীপক একদিন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়াবেই। অনেকের মতে লোকেন্দর সিংয়ের নিজের ক্রিকেটার হবার অতৃপ্ত স্বপ্নকে পূরণ করতেই ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। নিজের জীবনের ব্যর্থতাকে তিনি মেনে নেন ছেলের প্রশিক্ষণের সময় নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে।

তিনি ভারতীয় বিমান বাহিনিতে নিজের চাকরি ছেড়ে দেন এবং নিজের বাড়িতে সুরতাগে নেট তৈরি করেন দীপকের বোলিং করার জন্য। তিনি ইউটিউবে পেসারদের বোলিং দেখে দীপককে শেখাতেন। ১২ বছর বয়সে থাকাকালীন দীপক ঘন্টার পর ঘন্টা নেটে সময় কাটাতেন বিভিন্ন প্রকার বলে সুইং রপ্ত করতে।

‘আমি গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে দাঁড়াতাম এবং তাকে বল করতে বলতাম। প্রতিদিন ৫০০ বল- ২৫০ ইনসুইং এবং ২৫০ আউটসুইং। সেটা ছিল তার কনুইয়ের অবস্থান সঠিক করার জন্য। আমরা বিভিন্ন ধরনের বলে সুইং করানোর অনুশীলন করতাম’, বলেন লোকেন্দর সিং।

দিনের পর দিন এভাবেই কঠোর পরিশ্রম করতেন দীপক। একসময় লোকেন্দর অনুভব করেন দীপকের এবার একাডেমি কিংবা আরো বেশি সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন। আশেপাশে কোনো ক্রিকেট একাডেমি না থাকায় কিছুটা সমস্যায় পড়েন, তবে দ্রুতই সমাধান বের করে ফেলেন।

প্রতিদিন মোটরসাইকেলে করে দীপককে নিয়ে যেতেন ৫০ কি.মি. দূরের হনুমানগড় জেলা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনে যেখানকার সুযোগ-সুবিধা ছিল বেশি এবং দীপককে পেয়েছিল ত্যাগিকে যিনি কিনা লেভেল-১ কোচ এবং ফিটনেস ট্রেনার।

‘ক্রিকেটার হতে চাইলে কেবল ব্যাটিং-বোলিংয়ে পারদর্শী হলেই হবে না। এটা তার চেয়েও আরো অনেক বেশি কিছু। আমি কেবল সে দুটোই দেখেছি বাকি সবকিছুর কৃতিত্ব নাভেন্দুর’, বলেন লোকেন্দর।

বাকি সবকিছু বলতে দীপকের অসাধারণ ফিটনেসের কথাই বুঝিয়েছেন লোকেন্দর। আশ্চর্যজনকভাবে ১২ বছর বয়স থেকেই ত্যাগির রুটিন মেনে চলতেন দীপক, ‘হনমানগড়ে একটা দুর্গ ছিল। দীপক সারাদিনে বারবার দুর্গে উঠতো এবং নামতো। সপ্তাহে ২-৩ দিন আলাদা করে দৌড়ের রুটিন ছিল। সেজন্য সে খুব দ্রুতই উন্নতি করেছে।’

‘সারা বিশ্বের অ্যাথলেটদের জন্য সবচেয়ে বেসিক ব্যাপারগুলো হচ্ছে- দৌড়ানো, লাফানো, উঠা, পুল এবং পুশ। দীপক সবগুলোই ছোটবেলা থেকেই নিয়মিত অনুশীলন মরে গেছে।’, যোগ করেন তিনি।

সবকিছু একত্রে মেনে চলা সহজ ছিল বিশেষ করে হনুমানগড়ে। কারণ সেখানকার তাপমাত্রা মাঝেমাঝেই ৪০ ডিগ্রীর উপরে উঠে যেত। সেখানকার ক্রিকেট সুযোগ-সুবিধার উন্নতি ঘটে যখন ২০০৫ সালে ললিত মোদি রাজস্থান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সাবেক অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক বব সিম্পসনকে রঞ্জি দলের পরামর্শক নিযুক্ত করার পাশাপাশি যুব দলের দায়িত্বে আনেন ইংরেজ কোচ ডেরেক সিমন্সকে।

ডেরেক হনুমানগড়ে একটি ক্যাম্পের আয়োজন করেন এবং সেখানেই ১৩ বছর বয়সী চাহারকে দেখে মুগ্ধ হন, ‘ডেরেক সিমন্স আমাকে বলেন মি. নাভেন্দু এই ছেলেটি অনেকদূর যাবে। তিনি আমাকে দীপকের বিশেষ খেয়াল রাখতে বলেন। তিনি দেখেন দীপক দুই দিকেই বল সুইং করাতে জানে এবং বলেন তিনি অবশ্যই আরসিএকে দীপকের ভালোভাবে দেখভাল করতে বলবেন।’

রাজস্থানের বয়সভিত্তিক দলে কয়েকবছর কাটানোর পর অবশেষে ২০১০ সালে দীপক রঞ্জি ট্রফির জন্য ঘোষিত দলে ডাক পান। নিজের প্রথম ইনিংসেই দীপক আট উইকেট নেন এবং হায়দ্রাবাদ অলআউট হয় মাত্র ২১ রানে! সে সিজনে দীপক ৪০ উইকেট নেন, তার বাবার প্রত্যাশার চেয়ে ১৫ উইকেট বেশি। নিজের প্রথম মৌসুমেই রাজস্থানের বর্ষীয়ান পেসার পংকজ সিংকে সাথে নিয়ে দলকে জেতান তাদের ইতিহাসের প্রথম রঞ্জি ট্রফি। কিন্তু ততক্ষণে লোকেন্দর সিং দীপকের জন্য নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ফেলেছেন।

‘লোকেন্দর সিং বললেন তাকে যদি সিনিয়র দলের হয়ে খেলতে হয় তবে অবশ্যই গতি বাড়াতে হবে। ১২০ কি.মি. যথেষ্ট না। তাকে আরো জোরে বল করতে হবে।’, স্মরণ করেন নাভেন্দু ত্যাগি।

কিন্তু পরের তিন মৌসুমে দীপক অনেকটাই পিছিয়ে পড়েন অসুস্থতা এবং চোটের কারণে। জন্ডিসের কারণে পরের মৌসুমের রঞ্জি ট্রফির প্রায় পুরোটাই মিস করেন তিনি। সে সময়টা ছিল খুব কঠিন, রাতে ঘুমাতে পারতেন না দীপক। তার পায়ের পেশি ছিঁড়ে যায় অনুশীলন করার সময়।

২০১৪ সালে সুস্থ হওয়ার পর দীপকের প্রধান লক্ষ্য ছিল আইপিএলে ভালো খেলার মাধ্যমে জাতীয় দলে জায়গা করে নেয়া। ২০১০ এবং ১১ সালে দীপক রাজস্থান রয়্যালসে সুযোগ পেয়েছিল কিন্তু ইনজুরির কারণে খেলতে পারেনি। তারা তাকে রিলিজ করে দেয়ার পর পরবর্তী ফ্যাঞ্চাইজির জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয় ২০১৬ সাল পর্যন্ত। সেবার তাকে কিনে নেয় রাইজিং পুনে সুপারজায়ান্টস। কিন্তু বিধিবাম, সেখানেও মাথাচাড়া দেয় পুরনো শত্রু ব্যাকপেইন। সেবার কেবল শেষের দুই ম্যাচেই পুনের হয়ে মাঠে নামতে পেরেছিলেন তিনি।

২০১৬ সালে দীপক জয়পুরে এক ১০ দিনব্যাপি পেস বোলিং ক্যাম্পে অংশ নেয় যেটা পরিচালনা করছিলেন সাবেক আইরিশ ক্রিকেটার ইয়ান পন্ট এবং বর্তমান এসেক্স ক্রিকেটার ক্যাথরিন ডাল্টন, ‘দীপক সেসময় রাজ্য দলের সাথে অনুশীলন করছিলেন না এবং বিশেষভাবে আমাদের সাথে কাজ করতে চান। আমরা ক্যাম্পের কাজের ফাঁকে ফাঁকে তার বোলিং নিয়ে কথা বলতাম। আমরা দুজন ছিলাম সমবয়সী। আমরা মূলত কথা বলতাম কিভাবে ইনজুরিমুক্ত থেকে বলের গতি বাড়ানো যায় কারণ দীপকের ব্যাকপেইনের ইতিহাস ছিল।’

‘দীপকের রানআপে কিছুটা সমস্যা ছিল। আপনাকে সঠিক জায়গায় পা ফেলতে হবে। আমরা তার বাম পা এবং বাম কাঁধের সমন্বয়টা ঠিক করতে চেয়েছি। এটা তাকে আরো বেশি ফ্লেক্সিবিটি এবং বলে আরো বেশি গতি সৃষ্টি করতে সহায়তা করতো। আমরা পাওয়ার হিটারদের দেখি। তারা জানে কিভাবে কোমরকে রোটেট করতে হয় বলকে হিট করার ঠিক আগে যাতে সর্বোচ্চ শক্তি দিতে পারে। ফাস্ট বোলিংয়ের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই। যতই দ্রুত আপনি শেষ করবেন তত বেশি শক্তি দিতে পারবেন।’, যোগ করেন তিনি।

দীপকের সুইংয়ের দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু বর্তমান ধুমধাড়াক্কা ক্রিকেটে তাকে বোলিংয়ে নতুন কিছু যোগ করতে হতো। সেজন্য সে পন্ট এবং ডাল্টনের তত্ত্বাবধানে তীরে নতুন তূণ যোগ করে।

তিনি বলেন, ‘দীপক বর্তমানে যে ধরনের স্লোয়ার করে থাকে সেটা সে তখনই শিখেছিল। এটা নাকাল বলের মতোই অনেকটা। কেবল আঙুলের গিঁট দিয়ে বল ধরার পরিবর্তে কনুই ঘুরিয়ে ছাড়া হয়। এটা আসলে ইয়ান পন্ট এবং জুলিয়েন ফন্টেইনের উদ্ভাবন। ২০১১ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের বোলারদের জন্য এটার উৎপত্তি ঘটায় দুজনে মিলে।’

২০১৭ সালে মাত্র তিন ম্যাচে খেললেও সে মহেন্দ্র সিং ধোনির নজরে পড়ে যায় দীপক। ফলে চেন্নাই আইপিএলে ফিরে এলে তাকে দলে ভেড়ান ধোনি। সেবার পাঞ্জাব এবং দিল্লীর সাথে লড়াই করে ৮০ লাখ রুপিতে তাকে দলে নেয় চেন্নাই। দীপকও আস্থার প্রতিদান দেন দারুণ পারফরমেন্স করেই।

সে মৌসুমে তিনি দশ উইকেট নেন যার সবগুলো ছিল পাওয়ারপ্লেতে। চেন্নাইয়ের শিরোপাজয়ে সেবার বড় ভূমিকা ছিল তার। দুরন্ত ফর্ম আর জাসপ্রিত বুমরাহর ইনজুরি সবমিলিয়ে দীপক ডাক পান ইংল্যান্ডগামী ভারত দলে। ব্রিস্টলে তার টি টোয়েন্টি অভিষেক ঘটে এবং মাসদুয়েক পরে এশিয়া কাপে ওডিয়াই অভিষেক। কাকতালীয়ভাবে সেটাই ছিল অধিনায়ক হিসেবে ধোনির শেষ ওডিয়াই।

২০১৯ সালে দীপক নিজেকে নতুন করে চেনান, সবাইকে দেখিয়ে দেন তিনি কেবল নতুন বলের বোলার নন। সেবারের আইপিএলে তার ২২ উইকেটের ছয়টি পেয়েছিলেন ডেথ ওভারে। একই বছরের নভেম্বরে ক্যারিয়ার সেরা বোলিং ফিগারের দেখা পায় সে। বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচে ৭ রানে তার নেয়া ৬ উইকেট টোয়েন্টি ইতিহাসেরই সেরা বোলিং ফিগার।

‘দীপক সীমিত ওভারের ক্রিকেটে মূল ফোকাস রাখতে চেয়েছিল। এরপরই সে নিজেকে বদলে ফেলতে শুরু করে, বুঝতে বোলিংয়ে বৈচিত্র‍্য আনা প্রয়োজন। স্লোয়ার বল, ইয়র্কার পাশাপাশি স্বভাবজাত সুইং তো আছেই।’, বলেন ডাল্টন।

গত তিন বছরে দীপক নিজেকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে, প্রস্তুত করেছে নিজেকে জাতীয় দলে খেলবার জন্য। পূরণ করেছে ১২ বছর বয়সে দেখা স্বপ্নকে। এখন দেখবার বিষয় আসন্ন টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অধিনায়ক কোহলি তাঁকে কিভাবে ব্যবহার করেন। ভারতের সফলতা অনেকাংশেই যে নির্ভর করবে দীপকের উপর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link