চাকরি নেই। বেকারের ভিড়ে হাঁসফাঁস করছে দেশ। রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো ধুঁকছে। একটার পর একটা কারখানা লকআউট। বিদেশী বিনিয়োগের স্বপ্ন তলানিতে। দেশের অর্থনীতির সূচক হু হু করে নামছে। কৃষক আত্মহত্যা হচ্ছে প্রায়ই। এদিকে প্রকৃতির রোষ থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছে না কেউ, বাড়ছে জলস্ত্বর, গলছে মেরুর বরফ। কর্কট ক্রান্তির দেশে সবুজের ঘ্রাণ ফিঁকে হয়ে আসছে পোড়া বারুদের গন্ধে।
এর মাঝেই রোজ দশটা-সাতটার ডিউটি করে সিগারেট ধরায় ছেলেটা। বসের ঝার, বাড়ির ইএমআই আর প্রেমিকার ছেড়ে যাওয়ার জাঁতাকলে খুব ইচ্ছা করে একটা সপাটে স্টেপ আউট করে সমস্যাগুলোকে বাউন্ডারি পার করে দিতে, হয় না, বারে বারে একটু এগিয়ে ও থমকে যায় ও।
সৌরভ গাঙ্গুলি নতুন বলটা তুলে দেন তরুণ জহির খানের হাতে। বরোদার বাঁ-হাতিকে ফেলে দেওয়া হয় ম্যাথু হেইডেন-সনাথ জয়াসুরিয়া-গ্রায়েম স্মিথ-মার্কাস ট্রেসকোথিকদের সামনে। হিংস্র চাউনি, বিশাল পেশির বাঁ-হাতি ওপেনারদের সামনে ভারতীয় পেসার- প্রিয় খাদ্য!
তবু দৌড় শুরু করেন জহির, উপমহাদেশের সমস্ত ক্রিকেটীয় ব্যাকরণ ভেঙে জাম্প নেন, নতুন বলটা ছুঁড়ে দেন পিচে। পায়ের কাছে গোঁত্তা খেয়ে ভেঙে দেয় উইকেট। শুরু করতে ভয় পাওয়া ছেলেটার প্রথম রান-আপ শুরু করার আগে স্লিপ থেকে চেঁচাতো নজফগড়ের বাউণ্ডুলে শেবাগ। ক্রিকেট আর জীবনের টেক্সটবুককে ছারখার করে ভেসে আসত চিৎকার, ‘কাম অন জ্যাক, কাম অন, আগে ডাল গেম কো…’
ভারতীয় লিগ্যাসি ব্যাটিং মেরুদণ্ডের মাথায় ডিনামাইটের মতো দাঁড়িয়ে বীরেন্দ্র শেবাগ। জহিরের সামনে যদি হেইডেন থাকেন তবে বীরুর সামনে যমরাজসম শোয়েব-আকরাম-লি-স্টেইন-মালিঙ্গা-ম্যাকগ্রা। নন স্ট্রাইকিং এন্ডে দাঁড়ানো শচীন টেন্ডুলকারের দিকে মুচকি হেসে শুরু হত ভারতের সমস্ত সমস্যার মুখে একটা ‘হু কেয়ার্স!’ মানসিকতার প্রলয় নৃত্য, ২৯৯ রানে দাঁড়িয়ে স্টেপআউট করার মতো একটা মানসিকতার দাদাগিরি।
প্রতিদিনের বেড়ে চলা সমস্যার সামনে ব্যাট ঘোরানোর জন্য আর শেবাগ নামেন না মাঠে। কঠিনতম পরিস্থিতিতে শিরদাঁড়া সোজা করে লড়াই করার জন রান আপ নেন না জহির। হাজারে হাজারে শচীন-সৌরভরা আজও লড়ছেন, লড়ছেন বেকারত্বের সঙ্গে, লড়ছেন অসহযোগিতার সঙ্গে, লড়ছেন যে কোনো শর্তে অবশ্যম্ভাবী লুকোনো পরাজয়ের নিয়তির সঙ্গে।
শুধু বাড়ি ফেরার পথে কেউ জহির হতে পারছে না, হাজারটা সমস্যার সামনে কেউ শেবাগ হতে পারছে না। সীমান্ত দিয়ে লক্ষণরেখা কেটে দেওয়া সমাজের মুখে ইয়র্কার দিতেন জহির খান, পুরোনো বলে গোঁত্তা খেত রিভার্স সুইংগুলো। পূণ্যভূমিতে একটা জহির খান আর বীরেন্দ্র শেবাগ শুরু করতেন রূপকথা লেখার মহড়া।
যে ছেলেটা রোজ রাষ্ট্রের কাছে বঞ্চিত হয়ে, হেরে গিয়েও স্টেপ আউট করতে ভয় পাচ্ছে তাঁর রূপকথা। যে রোজ প্রেমিকার প্রত্যাখ্যানের পরেও তাকে মুখের ওপর ‘না’ বলতে পারছে না তাঁর রূপকথা। ভয়ংকর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ে টিউশন পড়িয়ে বাড়ি ফেরা হারানো ফুটবলারের রূপকথা। এত স্বপ্নের মাঝে শচীন-সৌরভ-দ্রাবিড়-কুম্বলেরা রয়েছেন নিরাপদ ফুলের গালিচায় শুধু কাঁটার সামনে প্রথম বুক পেতে দাঁড়ানো। ‘যা হবে বুঝে নেব’ মার্কা ছেলে দুটো হারিয়ে যাচ্ছে রোজ।
প্রথম সূর্যের আলো আসে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া থেকে, সে গড়ে দেয় রাজার সিংহাসন। তাঁর রাজপাটে পাপড়ি মেলে সূর্যমুখীর বাগান – আমরা বাগানের রূপের কাছে ঋণী হয়ে যাই, ভুলে যাই সূর্যের বেপরোয়া শক্তিকে- একটা জাতির উঠে দাঁড়ানোর জন্য নির্ভীক শেবাগ আর জহির লিখে যেতে থাকেন গগণচুম্বী স্পর্ধার এক অসমাপ্ত নোটবুক।