টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে আফসোসের মাত্রাটা দীর্ঘ। যে ফরম্যাটে নেই উল্লেখযোগ্য কোনো বড় জয়। তিন মোড়লের বিপক্ষে হিসাব কষলে, ভারতের বিপক্ষে ব্যাঙ্গালুরুর ম্যাচের আক্ষেপ দিল্লীর ম্যাচ জয়েও মুছে দেওয়া যায়নি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য — ইংলিশদের বিপক্ষে তো এখন পর্যন্ত একটাও টি-টোয়েন্টি ম্যাচে মাঠে নামেনি বাংলাদেশ।
বাকি থাকে অজিদের বিপক্ষের হিসাব-নিকাশ। এবারই প্রথম দ্বিপাক্ষিক টি-টোয়েন্টি সিরিজ আয়োজন করা হলেও, পূর্বে ক্যাঙারুদের বিপক্ষে আছে এক মাঝরাতের আক্ষেপ।
২০১০ সাল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে পাড়ি জমায় বাংলাদেশ দল৷ উইন্ডিজদের মাঠ বলেই সম্ভবত আশার পালে হাওয়াটা একটু বেশিই বইছিলো। না বয়ে আর উপায় কি? এই ঠিকানাতেই তো ২০০৭ পঞ্চাশ ওভার বিশ্বকাপের সুখস্মৃতি আছে।
ক্রিকেটে পরিসংখ্যান মাঠে কাজে দেয়না। কাজে দেয় আত্মবিশ্বাসের পাল্লাটা একটু ভারি করতে। নির্দিষ্ট দিনে মাঠের ক্রিকেটে সেরাটা উজাড় করে দিতে না পারলে ফলাফলের খাতা শূণ্যই পড়ে থাকে। উজাড় করতে ব্যর্থ হলে আক্ষেপের ভার কম। কেননা, তখন জবাব থাকে ব্যর্থতার। বিপত্তি ঘটে অর্ধেক উজাড় করে বাকি অর্ধেকে ডুবে গেলে।
আজকে সেই গল্পই করতে যাচ্ছি। কিছুটা সময় ব্যয় করে সাথে থাকুন। ঘুরে আসি অতীত থেকে। টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম ম্যাচে আশরাফুল ও অধিনায়ক সাকিবের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়েও ২১ রানে হারতে হয় পাকিস্তানের কাছে। টুর্নামেন্টের পরের পর্বে উত্তীর্ণ হতে মরিয়া বাংলাদেশ দল তাই একবিন্দুও ছাড় দিতে নারাজ অস্ট্রেলিয়াকে।
নারাজ তো কেবল চিন্তায় রেখে দিলে কিংবা মুখে বললেই চলেনা। কাজেও প্রতিফলন ঘটাতে হবে। সেদিনের ম্যাচ যারা দেখেছেন — বাংলাদেশ দলের বোলিংয়ে সেই প্রতিফলন নিশ্চিত দেখেছেন। উইন্ডিজের পেস উইকেটে নিজেদের স্পিন ঘূর্ণিতে নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছাড়ে অজিদের।
অজিদের বিপক্ষে রঙিন পোশাকে মাঠে নামলে কার্ডিফ ছাড়া সুখস্মৃতি ঘোরপাক খায়না মস্তিষ্কে। টেস্ট জয় তো কল্পনারও বাইরে তখন। তারপরেও, ইনজুরি জর্জরিত মাশরাফির বাউন্সারেও যে ওয়াটসনের মত দানব ভড়কে যেতে পারেন, সেটা আমি সেদিনই প্রথম বুঝতে পারি। প্রতিপক্ষকে শুরুতেই আঘাত করা গেলে এগিয়ে যাওয়া যায়।
আঘাত করলেও অজিরা তাতে মাথায় না ঘামিয়েই এগোতে থাকে। আর তাতেই সাকিবের বলে মিড উইকেটে নিজের পতন দেখেন ওয়ার্নার। দ্রুত দুই উইকেট হারিয়েও আমলে নেয়নি তারা। স্পিন নির্ভর বাংলাদেশ দল তখন এক হুমকির নাম প্রতিপক্ষের জন্য। তাই বাংলাদেশের স্পিনকে আমলে না নিয়ে তাসের ঘরের মত ভাঙতে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইনআপ।
মাশরাফি আমাকে আবারও অবাক করে দেয় নিজের ছোঁড়া বাউন্সারে। যার কোনো উত্তর জানা ছিলোনা ডেভিড হাসির। মোড়লদের ছয় ব্যাটসম্যান আত্মসমর্পণ করে ফিরে যায় দলীয় ৬৭ রানের ভেতরে।
ওয়ার্নার, ওয়াটসন, ডেভিড হাসি, ক্লার্ক, ক্যামেরুন হোয়াইট ও হাডিনকে ব্যাট হাতে ব্যর্থ বানিয়ে নিজেদের সম্ভাবনার আকশে হলুদ সূর্যের উঁকি দেওয়া রূপ দেখতে শুরু করে টিম বাংলাদেশ। তাসের ঘরের মত ভেঙে যাওয়া প্রতিপক্ষের ব্যাটিং লাইনআপের কফিনে শেষ কয়েকটি পেরেক ঠোকার অপেক্ষা তখন। ক্যারিবিয়ানদের গ্যালারিও অপেক্ষায় চমক দেখার। আর মৃদ্যু উৎসব শুরু হয়েছিল বঙ্গের ঘুমন্ত নগরীতে।
কিন্তু, ম্যাচের ঘটনা ভিন্ন দিকে মোড়ে নেওয়ার যে তখনও ছিলো বাকি! শেষ ভরসা হিসেবে মাঠে নেমে বাংলাদেশের আশায় গুড়েবালি করে দেন মাইক হাসি। নিজ অভিজ্ঞতার পূর্ণ প্রয়োগে ১৬২ স্ট্রাইকরেটে ২৯ বলে ৪৭ রান করে নিজ নিরাপদ সংগ্রহের ঘরে নিয়ে পৌঁছান। সঙ্গ দেওয়া তরুণ স্টিভ স্মিথের ১৮ বলে ২৭ রানের ইনিংসও ছিলো কার্যকরী।
এই ইনিংসে ছোঁয়া লেগেছিল মুগ্ধতার, পেশাদারিত্বের ও দায়িত্বের। দলের প্রতি দায়ভার থেকেই বিপর্যয় থেকে টেনে সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছান। অন্যরা ব্যর্থ হতেই পারে! নিজে ব্যর্থ হলে চলবেনা। সেটাই প্রমাণ করলেন হাসি।
৬৭ রানে ৫ উইকেট হারানো অস্ট্রেলিয়ার স্কোরবোর্ডে বাকি ৭৬ রানে উইকেট পড়েছে কেবল একটি। দলীয় সংগ্রহ গিয়ে থাকে ১৪১ রানে। যার পুরো কৃতিত্ব মাইক হাসি হলেও, তাকে সঙ্গ দেন স্টিভ স্মিথ। অজিদের এই সংগ্রহেই অর্ধেকের বেশি সম্ভাবনা কমে যায় বাংলাদেশের জয়ের।
খর্বশক্তির বাংলাদেশের বিপক্ষে এই রান প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য যথেষ্ট, জেতা যাবে হেসে-খেলে। তবুও, বাংলাদেশ আশা বুনে যায় আশরাফুল ও সাকিবে। আগের ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষেও তারা দু’জন আশা দেখালেও সফল নন। তবে স্বপ্ন দেখতে তো আর বাঁধা নেই। তাই একই স্বপ্নে বিভোর হয়ে নির্ঘুম রাতকে সঙ্গী করে দ্বিতীয় ইনিংস দেখা শুরু সমর্থকদের।
গতিদানব শন টেইটের বলে প্রথম থেকেই অপ্রস্তুত ইমরুল কায়েস। টেইটের গতিতে নড়বড়ে ইমরুলের ব্যাড়িং স্ট্যান্স। বড় শটের নেশায়, টেইটের স্লোয়ারে মিড অনে ক্লার্কের হাতে ধরা ইমরুল৷ ইনজুরিতে দ্বিতীয় ম্যাচে নেই তামিম। আশরাফুলের উপর তীব্র আশা। আগের ম্যাচের ইনিংসে আশরাফুল নিজেই বাড়িয়েছেন নিজের উপর প্রত্যাশার চাপ।
নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলা ডার্ক ন্যানেস অজিদের দলে সুযোগ পেয়ে বাউন্সারে ফেরালেন আশরাফুলকে। দৃষ্টিনন্দন শট খেলেও রানের খাতা না খুলেই বিদায়। অবশ্য, এটাই আশরাফুল। যিনি কখনোই ধারাবাহিক ছিলেন না। দুই ওপেনারের শূণ্য রানে বিদায়, দলীয় স্কোরকার্ডে ৪ রান এসেছে শন টেইটের কল্যাণে।
ওপেনারদের বিদায়ে টিভির সামনের সমর্থক বা ড্রেসিংরুমে অপেক্ষাকৃত ব্যাটসম্যানদের কপালে চিন্তার ভাঁজ দীর্ঘতর হতে শুরু করে। সম্ভাবনার সূর্য অস্তমিত হতে শুরু করে ইনিংসের দেড় ওভার থেকেই। আস্তে আস্তে বেজে উঠতে শুরু করে অশনি সংকেত।
বলের লাইন না বুঝে বা শুরুতেই দ্রুত রান তোলার অস্থির প্রচেষ্টায় প্রথম দুই ব্যাটসম্যানের দেখানো পথেই পা বাড়ান আফতাব ও রিয়াদ। পরের ব্যাটসম্যানরা মাঠে এসে জয়ের তাড়নায় ছয় হাঁকিয়েছেন চারটি। বাকিসময় অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন প্রতিপক্ষের পরিকল্পনার কাছে। ফলে, অব্যাহত ছিলো আসা-যাওয়ার মিছিল।
ক্যাঙারুদের সিমারদের আক্রমণে ফিল্ডারদের ভেদ করা থেকে ব্যর্থ ও মানসিক চাপ থেকে উতরানো সম্ভব হয়নি বলে ম্যাচটাও আর বাংলাদেশের ভাগ্যে আসেনি। মাঝ রাস্তায় পথ পাল্টে অস্ট্রেলিয়ার ঠিকানা ধরে ম্যাচের ফলাফল।সম্ভাবনা জাগিয়েও অস্ট্রেলিয়ার গণ্ডি থেকে নিজেদের গণ্ডিতে বহন করতে ব্যর্থ ম্যাচের ভাগ্য। পরপর দুই পরাজয়ে বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়তে হয়েছিল।
অথচ, সেদিন ১২০ বলের খেলায় লক্ষ্যটা ছিল মাত্র ২২ রান বেশি। লজ্জার বিষয় ১২০ বল মাঠে টিকেই থাকতে পারেনি বাংলাদেশ। ১১২ বল পর্যন্ত টিকে দলের সংগ্রহ ১১৪ তেই থেমে যায়। একেবারে ধীরস্থির ক্রিকেট খেললেও আজ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে জনশূন্য থাকতে হতোনা।
ম্যাচের শুরুতে যেই অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং ভেঙেছিল তাসের ঘরের মত। তারই পুনারাবৃত্তি করে দেখিয়েছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে আরেকটি বড় জয়ের দেখা থেকে বঞ্চিত হয় ব্যাট হাতে নিজেদের অযথা শট খেলার প্রবণতা বা চঞ্চলতায় এবং একইসাথে পরিকল্পনা-মাফিক ক্রিকেট না খেলতে পারার দোষে।
উইন্ডিজের মাটিতে সেই ম্যাচ বাংলাদেশ সময় রাত ১১ টায় শুরু হয়ে সমাপ্ত হয় রাত দুটোয়। তবে, বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় ম্যাচ সমাপ্তের আধাঘন্টা পূর্বেই। জয়োল্লাসের প্রতীক্ষায় থাকা সমর্থকদের অন্তর ভরে গিয়েছিল বিষাদে। টানা দুটো সহজ জয় থেকে বঞ্চিত হয়ে বিদায় নিতে হয় টুর্নামেন্ট থেকে।
যদিও, সম্ভাবনা ছিল দুটো ম্যাচ জিতেই পরের পর্বে খেলার। তাই পরাজয়গুলো সমর্থকদের অন্তরে ব্যাথা দিয়ে গেছে দীর্ঘদিন। মধ্যরাতের সুনশান নীরবতা পরিণত হয় সমর্থকদের স্বপ্নভঙ্গের আক্ষেপ ও বিষাদে।