১.
১৯৬২ সাল। ভারতীয় ক্রিকেটের পায়ের তলার মাটি তখনো শক্ত হয়নি। তবে উত্থান শুরু হয়েছে। তরুণ অধিনায়ক নরি কন্ট্রাক্টরের অধীনে তখনো হারেনি ভারত। ১০ টেস্টে দুই জয়ের বিপরীতে আট ড্র। বিজয়ের ঝাণ্ডা উড়িয়েছে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ক্যারিবিয়ান দখল করার হুংকার দিয়েই সমুদ্রতীরের দেশে পা রাখল ভারত। কিন্তু মাঠের খেলায় কি আর ক্যারিবিয়ানদের সাথে পেরে ওঠা সম্ভব, হেরে গেল প্রথম দুই টেস্টেই।
তৃতীয় টেস্ট শুরুর আগেই প্রস্তুতি ম্যাচে চার্লি গ্রিফিথকে সামলাতে হিমিশিম খাচ্ছিলেন কন্ট্রাক্টর। হুট করে গ্রিফিথের এক বাউন্সার পুল করতে গিয়ে মিস করলেন, বল এসে আঘাত করলো ডান কানের পেছনের অংশে। রক্তক্ষরণ শুরু হলো নাক এবং কান দিয়ে। শুধু ভাবতেই শীতল স্রোত বয়ে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে।
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। নিউইয়র্ক থেকে উড়ে এলেন চিকিৎসক, অস্ত্রোপচার করা হলো। প্রয়োজন পড়লো রক্তের। রক্তের গ্রুপ মিলে গেলো ক্যারিবীয় অধিনায়কের সঙ্গে। চাঁদু বোর্দে, পলি উমরিগড়, বাপু নাদকার্নিদের সাথে মিলে রক্ত দিলেন তিনি। জয় হলো মানবতার, সেরে উঠলেন কন্ট্রাক্টর।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের মানবিক, সদাহাস্য, খেয়ালি এই রাজপুত্রের নাম ফ্র্যাঙ্ক ওরেল; ক্যারিবিয়ানের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক। শুধু তাই নয়, ওরেল হলেন সেই নেতা যিনি এক করতে পেরেছিলেন ক্যারিবিয়ান দলটাকে।
২.
ওয়েস্ট ইন্ডিজের একটি গ্রাম। হতে পারে ত্রিনিদাদ, বার্বাডোস কিংবা জ্যামাইকা। ধরে নেয়া যাক বার্বাডোস। মাত্র আঠারো মাসের ব্যবধানে কয়েক কিলোমিটারের মাঝে জন্ম হলো তিন শিশুর। শোনা যায় তিন শিশুর দাইমা নাকি ছিলেন একজনই। বড় হবার সাথে সাথে তিনজন হয়ে উঠলেন হরিহর আত্মা। একসাথে ব্যাট হাতে শাসন করলেন পুরো ক্রিকেটবিশ্ব। গড়ে তুললেন থ্রি ডব্লিউ, শতাব্দী চলে গেলেও যে নামটা আজও নস্টালজিক করে তোলে ক্রিকেট রোমান্টিকদের।
ক্যারিবিয়ান সাম্রাজ্যের রাজপুত্র যদি হন এভারটন উইকস, কোটালপুত্র বললেও বোধহয় রাগ করবেন না ক্লাইড ওয়ালকট। তবে রাজপুত্র নিশ্চয়ই ফ্রাঙ্ক ওরেল, ব্যক্তিত্বের বিচ্ছুরণে আধিপত্য বিস্তার করেছেন যিনি পুরো ক্রিকেটবিশ্বে।
উইকস বা ওয়ালকট রান সংখ্যায় ছাপিয়ে গিয়েছেন ওরেলকে। কিন্তু এমন এক সময় আসে যখন প্রতিভার ঝলকানিতে তরবারিতে ভর করে এগিয়ে যেতে হয় একলা; মন্ত্রীপুত্র, কোটালিপুত্রকে পেছনে ফেলে সেদিন এগিয়ে যান রাজপুত্র একাই।
৩.
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমুদ্রতটের সেই মাঠটি- সেখানে খেলা হয় সোনালি বালির পিচে, বাতাসে কেঁপে ওঠে নারকেল পাতার সারি, এলোমেলো ঢেউ মৃদু গর্জনে ছাপ রেখে যায় বালির মহাসমারোহে। সেই মাঠেই খেলে বড় হয়েছেন ফ্রাঙ্ক ওরেল, উইকস, ওয়ালকটরা।
রানটা তিনি করেন মনের আনন্দে। বন্ধু উইকসকে সাথে নিয়ে ত্রিনিদাদের বিপক্ষে কখনো গড়েন ৫৭৪ রানের জুটি। আবার কখনো গডার্ডকে সাথে নিয়ে বোলারদের তুলোধনা করেন। সেবার দুজনে মিলে গড়েছিলেন ৫০২ রানের জুটি। মুখে হাসি, চোখে ছন্দময় রোমান্টিক বিষাদ, ব্যাটের প্রখরতা সবমিলিয়ে তিনি যেন ছিলেন সেনাপতি ওথেলো।
৪.
এক প্রবীণ ক্যারিবিয়ান নাতি-নাতনিদের গল্প শোনাচ্ছে। রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র, কোটালপুত্রদের সেই পুরনো রূপকথা। তিনজনে একত্রে চলেছে, যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। তেপান্তরের মাঠ, সাত সমুদ্র – তের নদী পাড়ি দিয়ে তাঁরা পৌঁছাল এক নতুন দেশে। সেই দেশের নাম কি তোমরা জানো?
সে দেশের নাম- ইংল্যান্ড।
বর্ণবাদের কালো ছায়া ছিল তখনো। ক্যারিবিয়ানদের তখনো মানুষ বলেই বিবেচনা করতে চাইতো অহংকারী ইংরেজরা। ১৯৫০ সালে ইংল্যান্ড সফরে গেল গডার্ডের নেতৃত্বাধীন ক্যারিবিয়রা। প্রথম ম্যাচেই ওল্ড ট্রাফোর্ডে হেরে বসলো ক্যারিবিয়রা। উল্লাস, বিদ্রুপে মেতে উঠলো ইংরেজরা। তেতে উঠলো রাজকীয় ক্যারিবিয়ান রক্ত, পরের টেস্টে ব্যাটকে তরোবারি বানিয়ে কচুকাটা করলেন ইংরেজ বোলারদের।
ওরেলের ১৬৮ রানে ভর করে ম্যাচ জিতলো ক্যারিবীয়রা। পরের টেস্টেই আরো প্রসারিত তার ব্যাট, ২৬১ রান করার পাশাপাশি বল হাতে নিলেন তিন উইকেট। এবারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতলো দশ উইকেটে। সিরিজের শেষ ম্যাচেও বিন্দুমাত্র ছাড় দিলেন না, নটিংহ্যামশায়ারে খেললেন ১৩৯ রানের ইনিংস। ক্যারিবিয়ানদের জয়ের ব্যবধান আরো বাড়লো, ইনিংস এবং ৫৬ রানে হেরে যেন চূড়ান্ত আত্নসমর্পণ করলো ইংরেজরা। ইংরেজ মূল্লুকে উড়লো ক্যারিবিয়ান ঝান্ডা। ক্যারিবিয়ান ক্যালিপ্সোর সুর ছড়িয়ে পড়েছিলো ইংল্যান্ডের পথে-প্রান্তরে।
এ যেন রাজপ্রাসাদে ঢুকে রাজার সামনে একলা নায়কের বীরত্ব প্রদর্শন এবং জয়ের মতোই রোমান্টিক কাণ্ড।
৫.
প্রতিভার অবহেলায় ওরেল অদ্বিতীয়। বোধহয় প্রতিভাবানদের স্বাভাবিক চরিত্রই এমন, তারা খামখেয়ালি। প্রাকটিসে মন নেই, কোচিং বরদাস্ত করেন না, এমনকি আগ্রহ নেই রান করায়। সুন্দরতম খেলা ক্রিকেট তিনি খেলেন সৌন্দর্যের সাথেই। উইকসের মতো না হলেও রান করেছেন অজস্র। কিন্তু যতক্ষণ ভালো লেগেছে। রানের ক্ষুধাটা তাঁর মাঝে থাকলে হয়তো রেকর্ড আরো উন্নত হতে পারতো।
গডার্ড একবার অজি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমাদের উইকসের অপরিসীম রানের ক্ষুধা, তোমাদের ব্র্যাডমানের মতো। আর খেয়ালী ট্রাম্পার হল ওরেল।’
ওরেল সবসময় হাসেন। সব সসময় হাসেন, তার হাসিতে মিশে থাকে শুভ্রতা। কারো ভুল ক্রুটি নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন না। মাঠে নিজের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করেন। অদ্ভুত শান্তির পরশ লাগিয়ে ব্যাট করেন। দ্রুত রান করেন বটে, কিন্তু তাতে মিশে থাকে স্নিগ্ধতা। একদিকে থাকে গতিময়তার কাব্য, অন্যদিকে নীতির মহিমা।
ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার সৈয়দ মুশতাক আলীর কাছে তিনি স্বার্থকতম অলরাউন্ডার। ‘ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে বিপক্ষের আক্রমণ ব্যর্থ করতে পটু, বোলার হিসেবে বিপক্ষকে ব্যস্ত করতে সদ্য ব্যগ্র, ফিল্ডারম্যান হিসেবে শিকারী বেড়াল। বলের পালিশ ছুটে গেলে সাপের খেলা দেখান।’ ওরেল সম্পর্কে এমন অভিমত ছিল তাঁর।
৬.
১৯৬০ সালে নির্বাচিত হন ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক হিসেবে। ততদিনে অবসর নিয়েছেন দুই বন্ধু ওয়ালকট-উইকস। তারুণ্যে ভরপুর ক্যারিবিয়ানদের দলটাকে এগিয়ে নিতে তখন ওয়ারেলের বিকল্প নেই। দলে জুনিয়র হিসেবে পেলেন গ্যারি সোবার্স, রোহান কানহাই, ওয়েসলি হলদের মতো প্রতিভাদের। পরিবর্তীতে তার রেখে যাওয়া পতাকা যারা রাখবে সমুন্নত।
নেতৃত্বের প্রথম টেস্টেই ব্রিসবেনে মুখোমুখি হলেন রিচি বেনোর অস্ট্রেলিয়ার। প্রথম ইনিংসে গ্যারি সোবার্সকে যোগ্য সঙ্গ দিলেন, ববি সিম্পসন-অ্যালান ডেভিডসনদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে গড়লেন ১৭৪ রানের জুটি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৪৫৩ রানের জবাবে অজিরা থামলো ৫০৫ রানে।
দ্বিতীয় ইনিংসেও তার ৬৫ রানের উপর ভর করে ক্যারিবীয়রা অজিদের সামনে ছুঁড়ে দেয় ২৩৩ রান। শেষদিনে ব্যাট করতে নেমে শেষ দুই ঘন্টায় ম্যাচটি এসে দাঁড়ায় টানটান উত্তেজনার সামনে। অজিদের প্রয়োজন ১২৪ রান, অন্যদিকে ক্যারিবীয়দের দরকার চার উইকেট।
পরবর্তী দুই ঘন্টায় যা ঘটলো তাতে এক শতাব্দীর গল্পের খোরাক পেয়ে গেলেন ক্রিকেট রোমান্টিকরা। দিনের শেষ বলে অজিদের দরকার এক রান, বল করবেন ওয়েসলি হল। বল করার আগমুহূর্তে হলের কানের কাছে ওয়ারেল বললেন, ‘তুমি যদি নো বল করো, তাহলে চিরকালের জন্য বার্বাডোসে ফেরার কথা ভুলে যেও।’
শেষ বলে রান আউট হলেন ম্যাককিফ, বিশ্ব ক্রিকেট দেখলো প্রথম টাই। অমরত্ব পেয়ে গেলেন একজন ওরেল, একজন বেনো এবং অবশ্যই একজন ওয়েসলি হল।
পরবর্তীতে তার সম্মানার্থে শুরু হয় অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার ‘ফ্র্যাঙ্ক ওরেল ট্রফি’।
৭.
ওরেল যেন অন্য ধাতুতে গড়া। তার কথাবার্তা, আচার-আচরণ, চলনে বলনে ফুঁটে ওঠে আভিজাত্য। ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও সিরিজ জিতে নেয় ওয়ারেলের নেতৃত্বাধীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে বয়স, একসময়ের তরুণ ওয়ারেলও হেরে যান শরীরের কাছে। প্রিয় ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিতে হয়।
রান করাটাকে কখনোই গুরুত্বের সাথে নিতে চাননি। অবসর নেবার পূর্বে ৫১ টেস্টে পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই গড়ে রান করেছেন ৩৮৬০। সর্বোচ্চ স্কোর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ২৬১।
শুরুর ঘটনায় ফিরে আসি। ভারতীয়রা অকৃতজ্ঞ নন, মনে রেখেছেন ওয়ারেলের রক্তের ঋণ। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ও ওরেল – স্মরণে প্রতি বছর তিন ফেব্রুয়ারি ‘ফ্রাঙ্ক ওরেল দিবস’ পালন করে ভারতীয় ক্রিকেট মহল। ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের উদ্যোগে সেদিন স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতাদের রক্ত সংগ্রহ করা হয়।
সেই ঘটনার পর কেটে গেছে প্রায় পাঁচ দশক। কন্ট্রাক্টর আজও ক্রিকেট নিয়ে কথা বলেন। কিন্তু চলে গেছেন ওয়ারেল, বিধাতার কি নির্মম লীলাখেলা। রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন প্রতিপক্ষকে অথচ লিউকেমিয়াতে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪২ বছর বয়সেই নশ্বর এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন তিনি।
৮.
ওরেল ছিলেন বোহেমিয়ান শিল্পী। নিজেকে পুড়িয়ে তিনি প্রদীপ জ্বালান। আমাদের এই বর্ণহীন পৃথিবীতে ওরেলরা আসেন নানা বর্ণে রাঙিয়ে দিতে, রঙিন করে তুলতে। ফ্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের আলোর ঝলকানি কিংবা ফিক্সিংয়ের কালো থাবা যখন গ্রাস করে ক্রিকেটকে তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো তখন আমরা অপেক্ষা করি ওরেলের মতো মুক্তিদূতের আগমনের। ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেট খুঁজে পায় তাঁর হারানো নির্মলতাকে।
ক্রিকেটের একজন কবির নাম ফ্র্যাঙ্ক মর্টিমার ম্যাগলিন ওরেল।