শরীরি ভাষার বিপ্লব

তৃতীয় টি-টোয়েন্টি সেরা মূহূর্ত মার্শকে আউট করার পর শরিফুলের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের মাঝে লুকিয়ে থাকা রাগের বর্হি:প্রকাশ। এই শরীরি ভাষাই আমাকে মুগ্ধ করে চলেছে প্রথম ম্যাচ থেকে।

প্রতিটা ম্যাচ জয়ে এই শরীরি ভাষাই রেখেছে অগ্রণী ভূমিকা। এগুলোই ম্যাচে পার্থক্য তৈরি করে দেয়। ফিল্ডিংয়েরও উন্নতি হয়েছে এই শরীরি ভাষার জোরে। শামিম, আফিফ, মেহেদি ও নাইম, মুস্তাফিজসহ সকল তারুণ্যে ভরপুর বাকি সদস্যদের সাহসী শরীরি ভাষার ফিল্ডিং দেয় অনুপ্রেরণার বার্তা।

যদিও মুস্তাফিজের নাম তরুণের খাতা থেকে কাটা পড়েছে। তবে, আজ ফিল্ডিং কিছুটা এলোমেলো ছিলো আগের দুই ম্যাচের বিবেচনায়। সিনিয়র নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার এটাই মোক্ষম সুযোগ এবং ধীরেধীরে সেই বার্তাই পাওয়া যাচ্ছে।

শরিফুল ক্যাচ মিস করেও খেলায় মনযোগ হারায়নি। যে কয়েকটা বাউন্সার করেছে, সেগুলো না করলে আজকের দিনে মুস্তাফিজের বরাবর দাঁড়িয়ে যেতে পারতো সে। দীর্ঘা দেহী এই লড়াকু সৈনিকই হবে আমাদের পেস বোলিংয়র ভবিষ্যত কাণ্ডারি। মার্শের অগ্নিচক্ষুর জবাব দিয়েছে অধিনায়ক মাথার উপর ছায়া হয়ে আসায়। তাই উল্লাসটাও ছিলো সীমাহীন উইকেট নেওয়ার পর। এমন ক্ষিপ্রতাই আমরা চাই বারবার। দিতে চাই অবজ্ঞার জবাব।

ব্যাটিং নিয়ে অনেক প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে। ব্যাটিংয়ের ধরন সন্তোষজনক ছিলোনা, বিশেষ করে অধিনায়কের। সোহানের আউট হওয়ার পেছনে দায়ভারটা তারই বেশি। সোহান ও আফিফের রান আউটে দলের বিপদটা বেড়েছিলো খুব। যা কিনা স্পষ্ট ম্যাচ শেষে দলীয় স্কোরকার্ডে।

রিয়াদ জিম্বাবুয়ে থেকেই ব্যাটিংয়ের সাথে অস্বস্তিতে আছে। ব্যাটে-বলে সঠিক সংযোগ স্থাপনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এভাবে চলতে থাকলে বিরাট বিপদ হবে আসন্ন বিশ্বকাপে। অধিনায়কের অফ-ফর্ম কিভাবে ভোগায় তা আমরা ২০১৯ বিশ্বকাপেই দেখেছি।

সাকিব আর আফিফের ব্যাটিংয়ের ধরন ছিলো ইতিবাচক। ঝুঁকি নিতে না পারলে টি-টোয়েন্টিতে এগোনো সম্ভব নয়। প্রতিপক্ষ যতো বড়ই হোক না কেন! নিজেদের কলিজাটাও হতে হবে বিশালাকৃতির। আফিফ টিকে থাকলে ১৪০ এর বেশি দলীয় সংগ্রহ হওয়ার সম্ভাবনা টিকে থাকতো। স্লো উইকেটে নিজেদেরই ভুগতে হচ্ছে। যে করেই হোক শেষ দুই ম্যাচে তা সারিয়ে উঠতে হবে।

দুই ওপেনার পুরোপুরি ব্যর্থ। তামিম গতবছর থেকে টি-টোয়েন্টি খেলেছে মাত্র একটি। ২০২০ ও ২০২১ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ছাড়া কিউই বা অজিদের বিপক্ষে ওপেনিংয়ে দূর্দশা বিদ্যমান। ১১ ম্যাচের ১০ টিতেই সৌম্য, নাইমের ঘুরেফিরে আসে। লিটন কিউইদের বিপক্ষে খেলে ব্যর্থ হলেও চলমান সিরিজ ও জিম্বাবুয়েতে তার খেলা হয়নি।

এখন পর্যন্ত জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুটো পঞ্চাশোর্ধ আর একটি শতরানের উদ্বোধনী জুটি ছাড়া ঠিকঠাক ত্রিশও নেই জুটিতে। পাওয়ার প্লে কাজে লাগাতে দিনের পর দিন ব্যর্থতা চলমান। বড় দলের সাথে উদ্বোধনী জুটির দৈন্যদশা চলতে থাকলে বিশ্বকাপে ব্যাপক ভুগতে হবে আমাদের।

অন্য দুই ম্যাচের চেয়েও আজকে পিচ তুলনামুলক সহজ ছিলো। আমরা অন্তত অজিদের চেয়েও ভালো করার কথা। সেখানে আমাদেরই দূর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। অজিরা যেখানে স্পিন সামলাতে টালমাটাল, স্বাভাবিক ডিফেন্সেই পা সরে যাচ্ছে, এগুলোকে আমরা কাজে লাগাবো।

কাজে লাগাচ্ছিও বটে! পাশপাশি নিজেরাও ফেঁসে যাচ্ছি। যে করেই হোক সামনের দুই ম্যাচে এসব ভুল থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। সিরিজ জয়ে প্রাপ্তি শেষ হয়ে যায়নি! গোটা সিরিজটার শেষ পর্যন্ত নিজেদের নামে করে নেওয়া এখনও বাকি।

মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ফিটনেস নিয়ে কাজ চালু রাখতে হবে। মাঠে তার শরীরি ভাষা ভেঙে পড়লে ভেঙে যাবে দলের প্রতিরোধ। রানিং বিটুইন দ্যা উইকেটে আরো দ্রুত হতে হবে। এই সিরিজে অনেকখানি শুধরে নিয়েছে। এটা চলমান রেখে গতি বাড়ানোর কাজ করে যেতে হবে। ওজন কমিয়ে ২০১৫ বিশ্বকাপের সফলতা ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও চাই। রিয়াদ নিশ্চয়ই তাতে নজর দেবেন।

বিশ্বকাপের আগের আইপিএল সময়ের বিরতিতে রিয়াদকে কঠোর পরিচর্যা করতে হবে নিজের ফিটনেস নিয়ে। এই সিরিজ জয়ের পর কিউইদের বিপক্ষে ভালোকিছু হলে বিশ্বকাপে আমরা অবশ্যই এগিয়ে থাকবো। ওমান ও আরব-আমিরাতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের উইকেট আর আমাদের মাঠের উইকেটে পার্থক্য খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। এই তারুণ্যের উদ্যমী শরীরি ভাষা দিয়েই জয় করতে হবে ভিন্ন কিছু।

সবকিছু ছাপিয়েও উপরে থাকবে তার অধিনায়কত্বের কৌশল। বিশেষ করে অ্যালেক্স ক্যারিকে কাঁবু কর‍তে মেহেদিকে শেষ পর্যন্ত রেখে দেওয়াই তার অধিনায়কত্বের কৌশলের বিচক্ষণতা বা দূরদর্শিতার প্রমাণ করে।

সাকিব আল হাসানকে নিয়ে নতুন করে কিছুই বলার নেই। আজকের পূর্বে সাকিবের এমন উল্লাস দীর্ঘদিন নজরে আসেনি। সাকিব কেবল আমাদের নন! বিশ্বক্রিকেটেও অনন্য একজন। বাড়তি করে বলতে হবে বা বলা উচিত অথবা প্রশংসায় ভাসানো বাধ্যতামূলক জাতীয় দলে সৌম্য সরকারের সমসাময়িক মুস্তাফিজুর রহমানকে।

সৌম্য বরাবরই নিজেকে হারিয়ে খুঁজলেও মুস্তাফিজ এখন পরিণত একটি নাম। যে স্বপ্ন দেখায় ও বাস্তবায়ন করে। পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী তার নিয়ন্ত্রিত বোলিং আমাদের জয়ের স্বাদ আস্বাদন করার সু্যোগ করে দিয়েছে। মুস্তাফিজ প্রমাণ করেছে ধার কমলেও তাতে শান দেওয়া যায়। বারবার ফিরে আসা যায় ফিনিক্স পাখির মতো।

শেষটা সোহানকে দিয়েই করছি। ভুল সময়ে জন্ম বলে আখ্যায়িত করা হয় তাকে। আমি বলবো — এই ধারনা পোষণ করাই ভুল। সোহান দেশ সেরা কিপার, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আর। আজকের জয়ের অন্যতম নায়ক। তারপরেও হয়তো তাকে নিয়ে আলোচনা নাও হতে পারে। তার হাতে গ্লাভস দুটো স্থায়ী করে দেওয়া হোক। সোহান জাতীয় দলের একজোড়া গ্লাভসের যোগ্য দাবিদার।

মুস্তাফিজের কাটারগুলো কয়েক ড্রপে যখন তার কাছে যাচ্ছিলো, প্রতিটায় সতর্কতার সহিত গ্লাভসে আটকে রেখেছে। শেষ বলে বিপরীত পাশে ঝাপিয়ে পড়ে আপ্রাণ চেষ্টা দেখেছেন ? স্মৃতিতে আমার এখনও ঘোরপাক খাচ্ছে। আজকের দিনে সোহান কোনো ভুল করেনি, প্রকাশ পায়নি তার অতি আবেগ।

শোনা গিয়েছে উইকেটের পেছন থেকে সতীর্থদের চাঙা রাখার প্রচেষ্টার আওয়াজ। মেহেদি থেকে সাকিব সবাইকে উজ্জীবিত করতে এগিয়ে আসেন। একবার ভাবুন — সোহানের হাত থেকে একটা মুস্তাফিজের করা কাটারগুলোর একটাও যদি ছুটে অতিরিক্ত চার হয়ে যেতো, তাহলে ম্যাচে ভিন্ন দিকে মোড় নিতে এক বলওও সময় নিতোনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link