সে একজন ছিল বটে…

বহু অভিযোগ থেকে যায় দেওয়াল থেকে মলাটে। বাংলা ভাষায় ক্রীড়াসাহিত্য মানেই চিনি মেশানো আবেগের পরাকাষ্ঠা, তুল্যমূল্য বিচারের বাণী সেখানে নীরবে, নিভৃতে কাঁদে। এ হেন ঠাসা অভিযোগ সূচির মধ্যে হঠাৎ নীলকণ্ঠ পাখিরা উড়ে বেড়ালে, চোখরাঙানি আর চক্ষুলজ্জাও উড়ে যায় অচিন প্রদেশে। বিশেষত সেই কিশোরদের, সেই শৈশবের হাফপ্যান্ট যাদের আজ দূরবীন দিয়েও খুঁজে পাবে না কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক, তাঁরা আজ বিমর্ষ।

তাঁদের বারবার মনে হচ্ছে, কোথাও যেন তারা বড় হয়ে গেছে। আয়নার সামনে তাকালে নিজেকে আর সেই ছোটটি মনে হয় না, মনে হয় সময় যেন এক ঝলকে এ বিষে ভরা দুনিয়ায় তাদের রাতারাতি বড় করে তুলেছে। মেসি বার্সেলোনা ছেড়ে যাওয়ায় যে ভাবনা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে তাদের কাছে। সময়ের নদী, বহমান। কিছু ক্ষেত্রে সময়ের তোড়ের কাছে যেন তার গতি মাপতে যাওয়াই সবচেয়ে বড় বোকামি।

এই বোকাগুলো জানে না, পৃথিবীতে কিছুই শ্বাশ্বত নয়। সৃষ্টি আর ধ্বংসের মিশেলেই ভরে থাকে জগত। মেনে নিলে লড়াইয়ের বদলে লড়াই, না মানলে ব্যর্থতার স্ট্যাম্প গায়ে লাগিয়ে নীরবে প্রস্থান। বাইনারি জগতে মধ্যস্থতার স্থান নেই। মেসির প্রস্থান যেন সেইদিকেই ব্যঙ্গের আঙুল তুলল।

আঙুল তুলল সেই ছেলেটার দিকে, পরের প্রভাতে ফাইনাল এক্সাম থাকা সত্বেও যে আগের রাতে জেগে থেকে মেসির খেলা দেখেছিল প্রাণভরে। যে মেয়েটার সদ্য ব্রেক আপ হয়েছে, মেসির বাঁ পায়ে কার্ল করা ফ্রিকিক সে ক্ষতের মলম হিসেবে অব্যর্থ কাজ করেছিল। ইউনিসেফের লোগো থেকে রাকুতেনের লোগোর মাঝে কেটে গেছে পনেরোটা বছর – লম্বা চুল থেকে সোনালী চুল, ভরা ইতিহাস।

তার সাক্ষী গোটা প্রজন্মটা, যখন জিদান চোখের জলে বিদায় জানাচ্ছেন ফুটবলকে, তখন বিশ্বমঞ্চকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে ফুটবলের ভাগ্যাকাশে নতুন সূর্য হিসেবে উঠছেন লিওনেল মেসি। যার বাঁ পায়ের, গোলের, ড্রিবলিংয়ের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে থেকে গেছি আমরা, এই বোকাদের দল।

এ যেন বহুদিনের প্রেমালাপে হঠাৎ চিরকালের বিরতি। বহু চেনা, বহু জমানো ব্যথা-আনন্দের চির পরিসমাপ্তি। অফিসে, বাসে, পার্কে, রকে মেসির হয়ে গলা ফাটানো ছেলের দল কথা বলার প্রসঙ্গ হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণায় কুঁকড়ে। রোনালদোর সাথে বারবার তুলনা করা বিশ্ব ফুটবল দর্শক এক নিমেষে নির্বাক। চিরাচরিত দশ নম্বর – তুলে রাখা হবে হয়তো সযত্নে। আসলে বছরে এক-আধবার এরকম বিমর্ষভাব আসা হয়তো ভাল। উপলব্ধি হয়, জীবনে কোনওকিছুই ফরএভার নয়, ধ্রুবক নয়। চলে যেতে হবেই, আজ না হোক কোনও একদিন। সেটাই নিয়ম।

সুমনের গান মনে পড়ছে খুব। ‘আজকে যে বেপরোয়া বিচ্ছু, শান্ত, সুবোধ হবে কাল সে।’ সুমন যেন আমাদেরই কলার ঝাঁকিয়ে জানিয়েছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বেদনাময় নিয়মের কথা। মেসি তার যথার্থতা প্রমাণ করে দিলেন। আসলে মেসি, বার্সেলোনা বা লাপোর্তা – কেউই এ দোষের ভাগীদার নন। ভাগীদার আমরা, যারা অদ্ভুত মায়ার বন্ধনে নিজেদের জড়িয়ে এসেছি এতকাল। স্বপ্নের নায়ককে নিয়েই স্বপ্ন বুনেছি, গোল করলে চেঁচিয়ে গলার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটিয়েছি, আবার হেরে গেলে বন্ধ দরজার ওপারে কেঁদেছি অবলীলায়।

মেসিরা তো বারবার আসেন না, কচ্চিৎ-কদাচিৎ এরকম ক্ষণজন্মা পৃথিবীতে আসেন। সঙ্গে বাক্স-প্যাঁটরায় ভরে নিয়ে আসেন একরাশ দুর্নিবার স্বপ্নের ডায়রি। আমরা তাতে দিনলিপি লিখে চলি, ‘আজ পাঁচজনকে কাটিয়ে, কাল বাঁ পায়ে আন্ডার-দ্য-ওয়ালে’ গোল।

মেসি যখন চলে যান, তখনও ফেলে যান গল্প। ‘সে একজন ছিল বটে’ – এইটুকু কথা। আমরা শুনিয়ে যাই পরের প্রজন্মকে। যারা এ রস থেকে বঞ্চিত, তাদের গল্প উপহার দেব কোনও এক রাতে, যখন ভবিষ্যতে দেখব এরকমই কোনও শিশু বল জাগলিং করবে সবুজ গালিচায়।

কোনও কোনও দিন আবেগে থাকারই দিন, আমাদেরই জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link