আগ্রাসনের চূড়ান্ত নমুনা

মোহাম্মদ সিরাজের একটা বল ভয়ঙ্করভাবে লাফিয়ে উঠে আঘাত করলো ওলি রবিনসনের বুকের কাছে।

চোখ দুটো পাকিয়ে নৃশংস একটা ভঙ্গি করলেন তিনি। ক্যামেরায় ধরা পড়া মুখ যেনো সিরাজকে বলতে চাইলো, ছিড়ে নাও।

শার্প একটা ক্যাচ মিস করে ফেললেন।

মাথায় হাত দিয়ে আফসোসে যেন ভেঙেই পড়লেন। সেই আফসোসের মধ্যে কাঁদো কাঁদো ভঙ্গি নেই। চোখ মুখ বলে দিতে চাইলো – আহা, একটা মাছ ফসকে গেছে।

সিরাজের বলে ছত্রখান হয়ে গেলো জেমস অ্যান্ডারসনের উইকেট।

তিনি বুনো উল্লাসে মাতলেন। একটা হাত শূন্যে তুলে কী একটা যেনো ধরে নিতে চাইলেন। যেনো সামান্য একটা টেস্ট ম্যাচ নয়, একটা গোটা বিশ্বকাপ জিতে গেছেন। তার উল্লাস থামায় কে তখন!

হ্যাঁ, এতোক্ষনে ধরে ফেলার কথা, এই মানুষটার নাম বিরাট কোহলি।

ব্যাটসম্যানশিপে বিরাট কোহলি যে আধুনিক যুগের সেরাদের একজন, তা নিয়ে তো কোনো আলাপ নেই। আমরা ব্যাটসম্যান নয়, অধিনায়ক কোহলিকে নিয়ে একটু আলাপ করি। আসলে ঠিক অধিনায়কও নয়, আমরা দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি আগ্রাসন দেখাতে পারা ক্রিকেটারকে নিয়ে একটু আলাপ করি।

এই ল্ডস টেস্ট দেখতে দেখতেই মনে হচ্ছিল, আমরা কী কখনো বিরাট কোহলির মত আগ্রাসন দেখাতে পারা অধিনায়ক এর আগে দেখেছি? অধিনায়ক বাদ দিন, এরকম বলে বলে নিজের আক্রমনাত্মক আচরণ দেখাতে থাকা খেলোয়াড় কী এর আগে ক্রিকেটে এসেছে?

হ্যাঁ, আগ্রাসী অধিনায়ক হিসেবে আপনি হয়তো সই নবাব মনসুর আলী খান পতৌদি থেকে শুরু করে স্টিভ ওয়াহ; অনেকের নাম করতে পারবেন। আপনি হয়তো জাভেদ মিয়াঁদাদ, ডেনিস লিলির মত অনেক আগ্রাসী খেওেলায়াড়কেও খুজে পাবেন। কিন্তু এমন করে মাঠের প্রতিটা ঘটনায়, প্রতিটা ডেলিভারিতে, প্রতিটা রানে খ্যাপা প্রতিক্রিয়া দেখানোর মত কাউকে ক্রিকেট ইতিহাসে দেখতে পাবেন না।

কোহলির এই আগ্রাসন নিয়ে লর্ডস টেস্টের সময় ধারাভাষ্যকাররাও কথা বলছিলেন। কোহলির আচরণকে অমিতাভের সাথে তুলনা করে হার্শা ভোগলে বলছিলেন, ‘এটা অনেকটা অমিতাভ বচ্চনের ‘মাল্টি স্টারার’ সিনেমার মতো, যেখানে তারকা অনেক থাকলেও সব ফ্রেমে দেখা যেত বচ্চনকেই, তিনি নিজের উপস্থিতি জানান দিতেন আলাদা করে ও প্রবলভাবে।’

এমন নয় যে, কোহলি মাঝে মাঝে এই ধরণের ‘পাম্পড’ অবস্থায় থাকেন। প্রায় সবসময় ভারতীয় অধিনায়ক এই চরম উজ্জীবিত অবস্থায় থাকেন। সামান্য অর্জনেই তিনি সিংহের মত চিৎকার করতে থাকেন।

সেটা নিয়ে সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার ও বর্তমান বিশ্লেষক সঞ্জয় মাঞ্জরেকার বলছিলেন, ‘কোহলির এটা নতুন নয়। বিশেষ করে যখন তিনি তেতে থাকেন, মাঠে তাকে এমনই খ্যাপাটে চেহারায় দেখা যায়। একেকটি উইকেট উদযাপনেই মনে হয় নিজের সব প্রাণশক্তি উজার করে দেন। যেন বিশ্ব জয় করে ফেলেছেন। দলও এতে উজ্জীবিত হয়। অধিনায়ককে এভাবে দেখে সতীর্থদের শরীরী ভাষাও জেগে ওঠে। আমার কেবল মনে হয়, স্রেফ একটি উইকেট উদযাপন যদি এভাবে করেন কোহলি, তাহলে বিশ্বকাপ জিতলে তিনি কী করবেন।’

নিশ্চয়ই বিশ্বকাপ জিতলে বাড়তি কিছু করার অপেক্ষায় আছেন কোহলি।

কোহলির এই আগ্রাসণ আর বিশৃঙ্খল আচরণের চুল পরিমাণ একটা পার্থক্য আছে। বলা চলে, মাঠে একটা আচরণ বিধির সুতোর ওপর দিয়ে হাঠেন কোহলি। এই আচরণটা একটু এদিক ওদিক হলে সেটাকে অন্যায় বলে রায় দেওয়া চলে।

একসময় কোহলি আচরণগত সমস্যাও তৈরী করেছেন মাঠে।

অস্ট্রেলিয়ায় তাদের দর্শকদের দিকে আঙুল দিয়ে বাজে ইঙ্গিত করার মত ঘটনাও ঘটিয়েছিলেন। টাইমস ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কোহলি বলেছিলেন, ওই আচরণকে তিনি পারলে ফিরে গিয়ে শুধরে আসতে চান।

মজার ব্যাপার হলো, এখন কোহলি ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যটা খুব ভালো করতে পারেন। তিনি ক্রিকেটীয় আচরণের ব্যাপারে আপোষ করতে আর রাজী নন। তিনি ক্রিকেট চেতনা নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করেন, এটা তার ইদানিংকালের কথাবার্তা শুনলেও বোঝা যায়।

কিন্তু এই বোঝাপড়া কোহলিকে নির্বিষ করেনি। তিনি আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠেছেন। সম্ভবত ক্রিকেটের ইতিহাসের সবচেয়ে আগ্রাসী মানুষটি তিনিই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link