আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বা অর্জন তাঁর খুব বেশি নয়। মোটে দু’টো আন্তর্জাতিক ম্যাচ। তাতে উইকেট অবশ্য পাঁচটা, একটা হ্যাটট্রিক। দল অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের মাটিতে হারলেও সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি নিশ্চয়ই ন্যাথান এলিস।
নাথান এলিস বাংলাদেশ সফর শেষ করে পরপর দু’টো সংবাদ শুনলেন। প্রথমটা অনুমিতই। বিশ্বকাপ দলে তাঁর জায়গা হয়নি। তবে, সফরসঙ্গী অতিরিক্ত হিসেবে তিনি দলের সাথেই থাকবেন।
আরেকটা খবর হল তিনি জায়গা পেয়েছেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) বাকি অংশে। তাঁকে নিয়েছে পাঞ্জাব কিংস।
বলা উচিৎ, নিতে পেরেছে। কারণ, এলিসকে পাওয়া তাঁদের জন্য সহজ ছিল না। ক্রিকেট বিষয়ক গণমাধ্যম ইএসপিএন ক্রিকইনফো জানিয়েছে, আরো দু’টো ফ্র্যাঞ্চাইজি তাড়া করেছিল এলিসকে।
আচ্ছা, একই সিরিজে চার ম্যাচে সাত উইকেট নিয়েছেন বাংলাদেশের পেসার শরিফুল ইসলাম। এলিসের হ্যাটট্রিক দলের খুব কাজে না আসলেও, শরিফুল প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উইকেট নিয়েছেন। তারপরও কেন আগ্রহী হচ্ছে এলিসের দিকে, শরিফুলের অনাগ্রহ কেন?
এর একটা ‘জনপ্রিয়’ কারণ হল, এলিস অস্ট্রেলিয়ান। আইপিএলের কোচিং সেট আপের বড় একটা অংশ আসে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড থেকে। এখানে পক্ষপাতিত্ব না হলেও, তাঁদের পক্ষে নিশ্চয়ই একজন ভিনদেশির চেয়ে একজন স্বদেশির কাছ থেকে পারফরম্যান্স বের করে আনা সহজ হবে।
তবে, এটাই একমাত্র কারণ নয়। মূল কারণে যাওয়ার আগে দু’জনের সব ধরণের টি-টোয়েন্টির রেকর্ড দেখা যাক। এলিস ৩৩ টি টি-টোয়েন্টিতে ৩৮ উইকেট নিয়েছেন। গড় ২৫-এর ওপর, ইকোনমি রেট আটের ওপরে।
অন্যদিকে, শরিফুল ৪৮ টি টি-টোয়েন্টিতে ৬০ উইকেট নিয়েছেন। গড় ২২, ইকোনমি রেট আটের ওপরে। মানে, গড়ে শরিফুল সামান্য এগিয়ে থাকলেও তাঁদের মধ্যে পারফরম্যান্সের খুব পার্থক্য নেই।
তবে, পার্থক্য আছে অন্য জায়গায়। ন্যাথান এলিস খেলেন বিগ ব্যাশ। তাঁর পারফরম্যান্সও সেখানেই। অন্যদিকে, শরিফুল এখন পর্যন্ত বড় কোনো স্বীকৃত ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টই খেলেননি। বঙবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ আর প্রিমিয়ার ডিভিশন টি-টোয়েন্টি দিয়ে তাঁকে পাল্লা দিতে হয়েছে বিগ ব্যাশের সাথে। এখানেই আসলে এগিয়ে গেছেন এলিস।
হয়তো সামনেই বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) খেলবেন শরিফুল। তারপরও পার্থক্য থাকবেই। কারণ, বিপিএলে তাঁর গুণগত মানে বিগ ব্যাশের চেয়ে বরাবরই পিছিয়ে। আর শরিফুল যে ধরণের পেসার, তাঁকে বিকশিত হতে দেওয়ার জন্য যে ধরণের উইকেট দরকার সেটা আদৌ কখনো বানায়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। সেরকম স্বদিচ্ছাও আছে নাকি সন্দেহ।
হ্যাঁ, শরিফুলের সুযোগ আছে তারপরও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিয়মিত পারফরম করতে পারলে হয়তো শিগগিরই ডাক আসবে। সামনেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, সেখানে পারফরম করতে পারলে তো কথাই নেই।
গেল নিলামে, সাকিব আল হাসানকে তিন কোটি ২০ লাখ রূপিতে কিনেছে কলকাতা নাইট রাইডার্স। আর মুস্তাফিজুর রহমানকে পেতে রাজস্থান রয়্যালসের খরচ করতে হয়েছে মাত্র এক কোটি রূপি। সাকিবের ইম্প্যাক্ট ছিল না প্রথম ধাপে, কিন্তু মুস্তাফিজের ইম্প্যাক্ট দেখেন, কোনো ভাবেই তাঁকে এক কোটি রুপির বোলার বলে জাস্টিফাইড করা যাবে না।
তাহলে, এই চক্র থেকে বের হওয়ার উপায় কি? বার বার বলা পুরনো কথাটা আবারও বলতে হয় – ঘরোয়া টি-টোয়েন্টির মান বাড়াতে হবে। বিপিএলকে এমন একটা স্তরে নিয়ে যেতে হবে যে কেবল বিপিএলের পারফরম্যান্স থেকেই এদেশের ক্রিকেটাররা আইপিএল-বিগ ব্যাশে জায়গা পান – যেটা ন্যাথান এলিসের বেলায় হয়েছে। ক্রিকেটারদের জন্য ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের সংস্কৃতিটাও বোঝা জরুরী।
আরেকটা জরুরী বিষয় হল, এই জাতীয় ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে বড় একটা অবদান রাখেন এজেন্টরা। আর আমাদের অধিকাংশ ক্রিকেটারদেরই তেমন স্বীকৃত কোনো এজেন্ট নেই, যেটা অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারদের আছে। এদিক থেকেও পিছিয়ে পড়ছেন শরিফুলরা।
না হয়, আজীবন খোড়া যুক্তি দিয়েই সমর্থকদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে। শুধু জাতীয় দল যে এখানে ম্যাটার করে না তাঁর বড় প্রমাণ তো চোখের সামনেই – টিম ডেভিড। সিঙ্গাপুরের ক্রিকেটার। কিন্তু, নিজের সামর্থ্য দিয়ে তিনি বিগ ব্যাশ, পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) বা ইংল্যান্ডের নানা রকম ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলে বেড়ান।
টি-টোয়েন্টির ঘরোয়া বা ফ্র্যাঞ্চাইজি কাঠামো উন্নত হলে কেবল ক্রিকেটারদের ব্যাংক ব্যালান্স ফুলে উঠবে – বিষয়টা কিন্তু তেমন না। এর ফলে, দেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের হঠাৎ খেই হারানোর যে ভুতুড়ে ব্যাপার দেখা যায় – সেটা অন্তত মিটিয়ে ফেলা যাবে।
টি-টোয়েন্টি বা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যে আর চলা যাবে না – সেটা নিশ্চয়েই এতদিনে বুঝে ফেলেছেন!