প্রশ্ন করা হয় যদি,ক্রিকেটবিশ্বের সবয়েছে ভয়ংকর ব্যাটসম্যানটির নাম কী? তরুণ প্রজন্মের মনে আসবে — বর্তমান সময়ের রোহিত শর্মা, ক্রিস লিন, গ্লেন ম্যাক্সওয়েলদের নাম। কিংবা এবি ডি ভিলিয়ার্স, ক্রিস গেইল, আন্দ্রে রাসেল। আরো একটু পেছনে গেলে উঠে আসতে পারে সনাথ জয়াসুরিয়া, বীরেন্দ্র শেবাগ, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট কিংবা ম্যাথু হেইডেনের নাম। ক্রিকেটের এসব রথী-মহারথীরাও আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে গুরু মানে এক ক্যারিবীয় ব্যাটিং দানবকে। তিনি হলেন ভিভ ‘মাস্টার ব্লাস্টার’ রিচার্ডস।
তিনি বিশ্ব দাপিয়েছেন এমন এক সময়ে যখন সারাবিশ্বের ব্যাটসম্যানরা কাঁপতো বাঘা বাঘা সব ফাস্ট বোলারদের সামনে। ডেনিস লিলি কিংবা জেফ থমসন, ইমরান খান বা কপিল দেব — কেউই তার মনে ধরাতে পারেনি ন্যূনতম কাঁপুনি। সবার সামনে বুক চিতিয়ে আক্রমণে গেছেন। তাও আবার হেলমেট ছাড়াই। ক্যারিয়ারে কখনই হেলমেট পরে মাঠে নামেননি এই ব্যাটিং দানব। সতীর্থ ম্যালকম মার্শাল, মাইকেল হোল্ডিং, জোয়েল গার্নার বা অ্যান্ডি রবার্টসের মতো দানবীয় বোলারদের সামনেও ঘরোয়া ক্রিকেট কিংবা নেটে — কখনই মাথায় হেলমেট তোলেননি রিচার্ডস।
হেলমেট পরা তার কাছে ছিলো রীতিমতো অপমানের, লজ্জার। হেলমেট পরা মানে নিজের আক্রমণাত্মক সত্ত্বার আত্ত্বাহুতি দিয়ে বোলারকে মানসিক জয় দিয়ে দেয়া!। নিজের দুই চোখের ওপর প্রখর আত্মবিশ্বাস নিয়ে নামতেন। চোখ দুটিও কখনো তার সঙ্গে প্রতারণা করেনি।
ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে আইকোনিক দৃশ্যগুলোর অন্যতম স্যার ভিভ রিচার্ডসের ব্যাট হাতে মাঠে আগমন। গর্ডন গ্রিনিজ বা ডেসমন্ড হেইন্স আউট হওয়ার পর দর্শকদের রুদ্ধশ্বাস দুই চোখ তাকিয়ে থাকে ক্যারিবিয়ান ড্রেসিং রুমের দিকে। আউট হওয়া ব্যাটসম্যান বাউন্ডারি লাইন পার হয়ে যাওয়ার পর ধীরে-সুস্থে মাঠে প্রবেশ করবেন প্রায় ছয় ফুট উচ্চতার এক ব্যাটিং দানব। ভিভ অপেক্ষা করাবে, দর্শক, বোলার, আম্পায়ার সবাইকে। চুইংগাম চিবোতে চিবোতে শান্ত চোখে উইকেটে আসবেন তিনি।
মাথায় চিরাচরিত মেরুন ক্যাপটি। হেলেমেট তার দুই চোখের শত্রু। উইকেটে এসে গার্ড নেবেন, ৪-৫ ধাপ এগিয়ে বোলারের দিকে তাকিয়ে হয়তো কঠিন দৃষ্টি দেবেন অথবা নয়তো মুচকি হাসি! শঙ্কার একটি শীতল স্রোত নেমে যাবে বোলারের মেরুদণ্ড বরাবর। নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে তখনই বোলারকে একবার হারিয়ে দিয়েছেন ভিভ রিচার্ডস। বলা হয়ে থাকে, ড্রেসিং রুম থেকে উইকেট—এই ৩/৪ মিনিটই স্যার ভিভ রিচার্ডসের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক। ড্রামা, সাসপেন্স কিংবা থ্রিলার যা ইচ্ছে বলতে পারেন তার উইকেটে আগমনকে।
ব্যক্তি নয়, ব্যক্তিত্বই মুখ্য। এটাই ছিলো স্যার ভিভের দর্শন। আর এই শক্তি দিয়েই প্রায় দুই দশক ধরে সারাবিশ্বের বোলারদের দুঃস্বপ্নের কারণ হয়েছেন তিনি।
ক্রিকেটীয় ব্যাকরণের কখনোই ধারেননি ভিভ রিচার্ডস। বোলার বল করলেন অফ স্ট্যাম্পের বাইরে। বলের সুইং বা সিমের ধার না ধেরেই বাম পা উঁচিয়ে মিরাকলের মতো ফ্লিক করে বল পাঠিয়ে দিলেন দিয়ে বাউন্ডারি লাইনে। সেসময় ‘hitting across the line’ ছিল রীতিমতো লজ্জাজনক, প্রতারণা। এককথায় মহাপাপ। কিন্তু এটাই ছিলেন ভিভ। প্রথাগত নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের দর্শনে করেছেন বিশ্ব শাসন। নিজের আত্মজীবনীর নামও সেকারণেই রেখেছেন, ‘Hitting Across the Line!’
১৯৭৪ সালে ভারতের চেন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে টেস্টে অভিষেক হয় ২২ বছরের এক তরুণের। এরপর নিজের ভয়ংকর ব্যাটিং দিয়ে সারাবিশ্বের ক্রিকেট ভক্তদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন স্যার ভিভ রিচার্ডস। ১৯৯১ পর্যন্ত প্রায় ১৮ বছরের ক্যারিয়ারে ১২১ টেস্টে করেছেন ৮৫৪০ রান। গড় ৫০.২৩। স্ট্রাইক রেট ৮৬.০৭। ওয়ানডে অভিষেক হয়েছিলো এক বছর পরে। ১৮৭ ওয়ানডে ম্যাচে ৪৭ গড়ে করেছেন ৬৭২১ রান, ৯০.২ স্ট্রাইক রেটে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলেছেন ৫০৭টি ম্যাচ। অবিশ্বাস্যভাবে ১১৪টি সেঞ্চুরি তার নামের পাশে। রান করেছেন ৩৬ হাজার ২১২। লিস্ট-এ তে ৫০০ ম্যাচে করেছেন প্রায় ১৭ হাজার রান (১৬,৯৯৫)।
ভিভ রিচার্ডস হলেন টেস্ট ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান যিনি ১৫০ এর বেশি স্ট্রাইক রেটে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। ১৯৮৫ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যান্টিগায় ক্যারিয়ারের ২০তম সেঞ্চুরিটি তিনি তুলে নিয়েছিলেন মাত্র ৫৬ বলে! টেস্ট ক্রিকেটের দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড হিসেবে সেটি টিকে ছিল প্রায় ৩০ বছর!
টেস্ট ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ডটিও একসময় ছিল তারই দখলে। ভিভের ৮৪ ছক্কার রেকর্ডটি টিকে ছিল প্রায় ১৩ বছর। ২০০৪ সালে যেটি ভেঙে দেন নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার ক্রিস কেয়ার্নস।
বিধ্বংসী হলেও অবিশ্বাস্য রকমের ধারাবাহিক ছিলেন ভিভ রিচার্ডস। ১৯৭৬-১৯৮৮ সাল পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটের একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে ৫৫ গড়ে রান করেছিলেন তিনি। ২৩টি সিরিজ খেলেছেন, যার ১৩টিতেই তার গড় ছিল পঞ্চাশোর্ধ্ব। ব্যাটিং গড়ে তিনি পেছনে ফেলে দিয়েছিলেন গ্রেগ চ্যাপেল (৫৪), সুনীল গাভাস্কার (৫১), অ্যালান বোর্ডার (৫২), জাভেদ মিয়াঁদাদের (৫৪) মত গ্রেটদের।
১৯৭৬ সালে মাত্র ১১ টেস্টে খেলে ৯০ গড়ে তিনি করেছিলেন ১৭১০ রান। হাঁকিয়েছিলেন ১১টি সেঞ্চুরি। এক পঞ্জিকাবর্ষে সবচেয়ে বেশি টেস্ট রানের রেকর্ড হিসেবে যা টিকে ছিল প্রায় তিন দশক। একই বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এক সিরিজেই করেছিলেন ৮২৯ রান!
খুঁজে পাবেন। যদিও তা সংখ্যায় অতি নগন্য। তবে ওয়ানডেতে যে স্যার ভিভ রিচার্ডসই সর্বকালের সেরা এ নিয়ে দ্বিমত করার লোক বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইয়ান বোথাম, ব্যারি রিচার্ডস, মার্টিন ক্রো, শেন ওয়ার্ন, রবি শাস্ত্রী, নিল ফেয়ারব্রাদার, ডেরেক প্রিঙ্গলদের মত বিশেষজ্ঞরাও সেরার প্রশ্নে বেছে নিয়েছেন ভিভকেই। তিনি ছিলেন যুগের চেয়ে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকা একজন খেলোয়াড়।
বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ইনিংস দিয়ে ম্যাচের মোড় একাই ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম ছিলেন তিনি। ১৯৮৫ সালে ওল্ড ট্রাফোর্ডে মহাকাব্যিক এক ইনিংস খেলে ইতিহাসেই জায়গা করে নেন তিনি। ইংল্যান্ডের বোলারদের সুইংয়ের সামনে ১৬৬ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এক প্রান্ত আগলে রেখে ব্যাটসম্যানদের আসা যাওয়া মিছিল দেখছিলেন ভিভ। সেখান থেকেই শুরু করেন পাল্টা আক্রমণ।
১৭০ বলে ১৮৯ রানে অপরাজিত থেকে ইনিংস শেষ করেন তিনি। শেষ উইকেটে আসে ১০৬ রান। এরমধ্যে ভিভের একারই অবদান ৯৩ রান! ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংস শেষ করে ২৭২/৯ রানে। ভিভের চেয়েও ২১ রান পেছনে থেকে শেষ হয় ইংল্যান্ডের ইনিংস। ওয়েস্ট ইন্ডিচ ম্যাচ জিতে নেয় ১০৪ রানে। ২১টি চার আর ৫টি ছক্কায় সাজানো ভিভের এই ইনিংসকে ওয়ানডের সর্বকালের সেরা ইনিংস বিবেচনা করা হয়।
১৯৭৫-১৯৯১ সাল পর্যন্ত ওয়ানডে ক্রিকেটে ১-৭ নম্বর পজিশনে ব্যাট করা সব ব্যাটসম্যানের গড় ছিলো ছিল ২৯ আর স্ট্রাইক রেট ছিল ৬৫! সেখানে ভিভ রান করেছেন ৪৭.০ গড় আর ৯০.২০ স্ট্রাইক রেটে!
ওয়ানডেতে ১১টি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন ভিভ। তার সবকটিতেই জিতেছে তার দল। ওয়ানডেতে প্রতি ১৫ ইনিংসে অন্তত একটি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন তিনি। তার সময়ে ১-৭ নম্বর পজিশনে ব্যাট করা ব্যাটসম্যানদের প্রতিটি শতকের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে গড়ে ৫৫ ইনিংস!
ভিভের সমসাময়িক প্রথম সারির কয়েকজন ব্যাটসম্যানের ওয়ানডে পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, তাদের বেশিরভাগের গড় ছিল ৪০ আর স্ট্রাইক রেট ছিল ৬০’র ঘরে।
- জহির আব্বাস- গড় ৪৭.৬২, স্ট্রাইক রেট ৮৪.৮০
- গ্লেন টার্নার- গড় ৪৭.০, স্ট্রাইক রেট ৬৮.০৫
- গর্ডন গ্রিনিজ- গড় ৪৫.০৩, স্ট্রাইক রেট ৬৪.৯২
- ডিন জোন্স- গড় ৪৪.৬১, স্ট্রাইক রেট ৭২.৫৬
- জাভেদ মিয়াঁদাদ- গড় ৪১.৭০, স্ট্রাইক রেট ৬৭.০১
- ডেসমন্ড হেইন্স- গড় ৪১.৩৭, স্ট্রাইক রেট ৬৩.০৯
- গ্রেগ চ্যাপেল- গড় ৪০.১৮, স্ট্রাইক রেট ৭৫.৭০
- ক্লাইভ লয়েড- গড় ৩৯.৫৪, স্ট্রাইক রেট ৮১.২২
- অ্যালান ল্যাম্ব- গড় ৩৯.৩১, স্ট্রাইক রেট ৭৫.৫৪
- মার্টিন ক্রো- গড় ৩৮.৫৫, স্ট্রাইক রেট ৭২.৬৩
দেখা যাচ্ছে, ভিভ (৯০.২০) বাদে আশির ওপর স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন শুধুমাত্র দু’জন; জহির আব্বাস (৮৪.৮০) আর ক্লাইভ লয়েড (৮১.২২)। তবে তারা দুজনেই ভিভের তুলনায় ম্যাচ খেলেছেন অনেক কম। ভিভের ১৮৭ ম্যাচের বিপরীতে লয়েড ৮৭ আর জহির খেলেছিলেন মাত্র ৬২ ম্যাচ।
ওয়ানডের দ্রুততম (২১ ইনিংস) ১০০০ রানের রেকর্ডটি প্রায় ৪২ বছর ধরে ছিলো তার দখলে। ১৯৭৫ সালে তার সেই রেকর্ড ২০১৭ সালে এসে ভেঙে দেন পাকিস্তানের ইমাম উল হক। যদিও একই বছর সেটা নিজের দখলে নিয়ে নেন আরেক পাক ব্যাটসম্যান ফখর জামান।
ওয়ানডে ইতিহাসে সর্বাধিক রেটিং পয়েন্ট (৯৩৫) পাওয়া ব্যাটসম্যানের নামটা এখনো ভিভ রিচার্ডস। দ্বিতীয় স্থানে আছেন জহির আব্বাস (৯৩১)। বর্তমান ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ রেটিংয়ের মালিক বিরাট কোহলি (৯০৯)।
অধিনায়ক ভিভের রয়েছে অনবদ্য এক রেকর্ড। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত ৫০ টেস্টে অধিনায়কত্ব করেন তিনি। ভিভ রিচার্ডস একমাত্র ক্যারিবীয় দলপতি যার অধীনে কোনো সিরিজ হারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ভিভ রিচার্ডস যেমন ছিলেন ডোমিনেটিং তেমনই অ্যাগ্রেসিভ ছিলেন। কিন্তু স্লেজার ছিলেন না। এমনকি প্রতিপক্ষের ক্রিকেটাররাও তাকে স্লেজ করার সাহস পেতেন না। তিনি ছিলেন ক্রিকেটের প্রথম পোস্টারবয়, ক্রিকেটের সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাটসম্যান, তিনি আক্রমণ এবং ধ্বংস করেছেন সমস্ত বোলিং আক্রমণ এবং অসংখ্য বোলারের ইগো।
অসামান্য এই খেলোয়াড় জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৫৯ সালের ৭ মার্চ,অ্যান্টিগায়।তার পুরো নাম স্যার আইজ্যাক ভিভিয়ান আলেকজান্ডার রিচার্ডস। বিশ্বের সকল বোলারদের জন্য যমস্বরূপ এর ব্যাটসম্যান ১৯৯১ সালে অবসর নেন।
উইজডেন ক্রিকেটার্স অ্যালম্যাক স্যার ভিভ রিচার্ডসকে শতাব্দীর সেরা ক্রিকেটার ঘোষণা করার সময় তাঁকে বর্ণনা করেছে এভাবে – ‘He was attacking, aggressive but not a slogger. His trademark shot was a hitting across the line but his cover drives were gorgeous. He was a poet capable of violent poetry. A subtle artist who had the gift of ferocious performance. A man who made chewing gum a style statement. A man who defined swagger. Sir Vivian Richards was Cricket’s first ever poster boy. A playboy. A one man evolution. A Knighted king. And Crickets most feared batsman ever.’