বন্ধু সে জন

থেমে থাকবেনা জনজীবন, আগের মতোই পিয়েনিয়ের্স আর অলিফ্যান্টস নদীর জল গিয়ে মিশবে ভারত মহাসাগরের জলে, ট্রান্সভিল থেকে উঠে আসবে আরও প্রোটিয়া তারকা। তবু পোর্ট এলিজাবেথের ড্রেসিং রুমটা বারেবার হয়তো খুঁজে বেড়াবে দলের ১৭ আর ৮ নম্বর জার্সির দুই সাবেক মালিককে, খুঁজে বেড়াবে তাঁদের ড্রেসিংরুমের রসায়নকে। না বন্ধুত্ব তো কখনোও থেমে থাকার নয়, মাঠের সবুজের বাইরে গিয়ে হয়তো তা ওই বদ্ধ কমেন্ট্রি বক্সের মাইকগুলোতে বা এই ছোট্ট স্মার্টফোনের স্ক্রিনটাতে আটকানোর সময় হয়ে এসেছে।

মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম
আজি নবপ্রভাতের শিখরচূড়ায়,
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি;
দূর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।

আজও যেন কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে দিনের শেষে স্তব্ধ বিকেলে বারেবারে ফিরে আসে ভূপতিত অঙ্গরাজ কর্ণের শেষ আকুতি, ‘আমায় রথের চাকা তুলতে একটু সময় দাও অর্জুন, একটু সময় দাও।’ না কৃষ্ণের বাক্যছলনায় সে সময় আর পাননি সূর্যপুত্র, রাজমাতা কুন্তী আর সুতমাতা রাধা হয়েছিলেন সন্তানহারা; জয় হয়েছিলো ছলনা আর অভিশাপের, হার হয়েছিলো যুদ্ধদক্ষতার, হার হয়েছিলো কর্ণের শৌর্য-বীর্যের, আর হার হয়েছিলো যুদ্ধক্ষেত্রের সাম্যনীতির। অস্তগামী সূর্যের সাথেই দিগন্তে মিশে গিয়েছিলো সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধার পরাক্রম-বিক্রম, হয়তো এটাই ছিলো অর্জুনসারথি কৃষ্ণের অন্তিম ন্যায়বিচার।

২০১৫ সালের ২৪ মার্চ, কুরুক্ষেত্র থেকে প্রায় ১২,৫৮৪ কিলোমিটার দূরে আবারও নেমে এসেছিলো এমনই এক যুদ্ধকালীন নিস্তব্ধতা, অভিশাপের খাঁড়া হয়ে নেমে এসেছিলো কিছু ক্ষমার অযোগ্য মিসফিল্ডিং আর কোনো এক দুর্বোধ্য ডার্কওয়ার্থ-লুইস নিয়ম। ১৯৯৯-এর ল্যান্স ক্লুজনার থেকে ২০১৫-র এবি ডি ভিলিয়ার্স, সবেতেই শেষে বাধ সেধেছিলো সেই ভাগ্যের ভ্রুকুটি।

ডেল স্টেইনের বলটা গ্র্যান্ট ইলিয়টের ব্যাট হয়ে ইডেন পার্কের গ্যালারিতে আছড়ে পড়তেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো সব হিসেবনিকেশ। অকল্যান্ডের আনাচেকানাচে জেন্টেলম্যানস গেমের রমরমায় আজও যেন ভেসে বেড়ায় তৎকালীন বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যানের টুপিতে ঢাকা অশ্রুসিক্ত বেদনাতুর মুখটা, বারেবারে ফিরে আসে তৎকালীন বিশ্বের এক নম্বর বোলারের ধরাশায়ী বিপর্যস্ত হওয়া ক্লান্ত শরীরটার ছবি।

সেদিনের ইডেন পার্কের নিস্তব্ধ সন্ধ্যা আর আজকের করোনা প্যান্ডেমিকের লকডাউনের নিস্তব্ধ দিনগুলোর মধ্যে কেটে গেছে পাঁচ-পাঁচটা বছর, পিয়েনিয়ের্স আর অলিফ্যান্টস নদীর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল, থেমে থাকেনি জনজীবনও, তবে কিছুটা হলেও থমকে গেছে সেদেশের ক্রিকেট। কথায় বলে, ‘সে রামও আজ নেই, আর সে অযোধ্যাও নেই’ – ভৌগোলিক মানচিত্রে হয়তো আজও অযোধ্যা রয়ে গেছে কিন্তু নেই সেই রামরাজত্বের সোনায় মোড়া দিনগুলো।

সীতার পাতালপ্রবেশের মতো ইডেন পার্কের স্বপ্নভঙ্গের ক্ষত থেকেই আসতে আসতে শেষ হয়ে এসেছে সাউথ আফ্রিকান ক্রিকেটের রাম-লক্ষণের রমরমা – একবিংশ শতাব্দীর শেষ পনেরো বছরের দিকে ফিরে তাকালে যে ড্রাকেন্সবার্গ পর্বতমালার আশেপাশের পিচগুলো আজও খুঁজে বেড়ায় ওই দুজনকে, একজন নিজের সেরা ফর্মেই জাতীয় দলের জার্সিটা তুলে রেখে সরে দাঁড়িয়েছে আর একজন আজও অনেক চোট-আঘাত সহ্য করে লড়াই জারি রেখেছে বাস্তবের সাথে।

ওয়ার্মবাদের গালিক্রিকেটে আজও হয়তো কোনো রাগবীপ্রিয় ছেলে শেষ বিকেলে দলকে ম্যাচ জিতিয়ে দ্বিতীয় এবি ডি ভিলিয়ার্স হওয়ার স্বপ্ন দেখে, আর তার থেকে প্রায় ১৮৯ মাইল দূরে দুই গ্রীষ্মের শহর ফালাবড়োয়ার স্কুলমাঠে বল হাতে আগুন ঝরানোর পর কেউ হয়তো শেষরাতে ডেল স্টেইনের রেকর্ড ভেঙে টেস্টে দেশের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকে।

২০০৩ সালের অক্টোবরের কোনো এক কাকতালীয় সকালে নর্দার্নস টিমের হয়ে একসাথেই অভিষেক হয়েছিলো স্টেইন আর এবির। স্থানীয় দলগুলোর হয়ে ইতিমধ্যে বারবার পক্ষে বিপক্ষে খেলে ফেলা ছেলেদুটো তখনই সাউথ আফ্রিকান ক্রিকেট স্কাউটদের চোখে সোনা ফলিয়ে দিয়েছিলো, বারবার দেশকে নতুন তারকা উপহার দিয়ে আসা সুপারস্পোর্টস পার্ক তখন যেন পেয়ে গিয়েছিলো অ্যালান ডোনাল্ড, হ্যান্সি ক্রোনিয়েদের দেশের পরবর্তী দুই তারকাকে। সেই থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁদের।

পিয়েনিয়ের্স আর অলিফ্যান্টস নদীর জল যেমন শেষ অবধি গিয়ে মিশেছে ভারত মহাসাগরের বুকে তেমনই ক্রিকেট দেবতা হয়তো তখন থেকেই একসূত্রে বেঁধে দিয়েছিলো ট্রান্সভিল প্রদেশের দুই উঠতি তারকার ক্রিকেটভাগ্যকে। ২০০৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর, ঘরের মাঠ পোর্ট এলিজাবেথে সফরকারী শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে জাতীয় দলের হয়ে একসাথেই টেস্ট অভিষেক হয় স্টেইন ও ডি ভিলিয়ার্সের।

সেদিনে দুই ইনিংসে মাত্র ২৪ আর ১৮ করা ছেলেটা যত দিন গেছে জাঁকিয়ে বসেছে বাইশ গজে – কেপ টাউন-জোহানেসবার্গ ছাড়িয়ে দাপিয়ে বেরিয়েছে লর্ডস-মেলবোর্নের ময়দান, বাঘাবাঘা বোলারদের ইয়র্কার প্রিয় ল্যাপশটে উড়িয়ে দিয়েছে ফাইন লেগের ওপর দিয়ে, লফটেড ড্রাইভ আর রিভার্স সুইপে ছিনিমিনি খেলেছে অনেক বোলারের স্বপ্ন নিয়ে, ওডিআই তে ২০১৩ থেকে ২০১৭ টানা চারটে বছরের শেষে রাঙ্কিংয়ে নিজের শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে, টেস্টেও শীর্ষস্থান ধরে রাখে টানা দুবছরের বেশি সময় , আর তিনি নিজে থেকে সরে না আসা পর্যন্ত ওই শীর্ষস্থান থেকে কেউ তাকে সরাতে পারেনি।

আর সেই সরে আসার সময় দুই মেন ফরম্যাটেই রেখেছেন বিরল ৫০+ গড় | ওদিকে সেদিন 146 রানে 3 উইকেট নেওয়া বোলারটা ইনজুরি আর শুরুর দিকের ইনকন্সিস্টেন্সির সাথে লড়াই করে বারবার ফিরে এসেছে টিমে, ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে নি:সন্দেহে সেসময়ের সেরা বোলার, ২০০৮ থেকে ২০১৪’র মাঝে টানা ২৬৩ সপ্তাহ বিরাজ করেছে টেস্ট ক্রিকেটের নম্বর এক বোলারের আসনটিতে। আর এই ফাঁকে অনেক সুখ-দুঃখের ভাগিদার হয়েছে এই দুই তারকা |

দীর্ঘদিন উপভোগ করেছে টেস্টক্রিকেটে এক নাম্বার দলের তকমা, ভারতে-অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে জিতে এসেছে টেস্ট-ওডিআই সিরিজ, মাঠের বাইরের আর মাঠের ভেতরের অসাধারণ বন্ধু এই ব্যাটসম্যান-বোলার যুগলের হাত ধরেই সাউথ আফ্রিকান ক্রিকেট ফিরে পেয়েছিলো তাদের গৌরবান্বিত অধ্যায় ; একসাথে ২২১টা ম্যাচ খেলেছে স্টেইন-এবিডি জুটি। শুধু স্টেইনের বলেই ৮১ টা ক্যাচ ধরেছে এবিডি।

ড্রেসিংরুম ভাগ করা শুরু সেই নর্দার্নস দলের হয়ে, পরে টাইটান্সের হয়ে একসাথে খেলার সময় তিন-তিনবার ডোমেস্টিক টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, প্রথমদিকে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে বেশিদিন একসাথে না খেললেও আবার সেই সুযোগ ফিরে পেয়েছে তারা সাম্প্রতিককালে। বিশ্বকাপের মতোই দুজনেরই যে অধরা রয়ে গেছে শখের আইপিএলটাও।

কথায় বলে শেষ হয়েও হইলো না শেষ। ইডেন পার্কের সেই সন্ধ্যা যে এখনও পিছু ছাড়েনি তাদের, আরও একবার শাপমুক্তির চ্যালেঞ্জ যে নিতেই হবে, আসলে চ্যালেঞ্জ নিতে তো তারা বরাবরই ভালোবাসে। তাই আজও বারবার ইনজুরির ধাক্কা কাটিয়ে বল হাতে ট্র্যাকে ফিরে আসে ভিনটেজ স্টেইনগান, আরেকটা ইনজুরি এসে তাকে ধাক্কা দেওয়ার আগে অবধি নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ক্রিজে আগুন ঝরানোর চেষ্টা করে, আরও একবার ঘুরে যায় স্পিডোমিটারের কাঁটা। আরসিবি থেকে সোয়েন স্পার্টানস, আজও ল্যাপশট, সুইপ, রিভার্স সুইপে নিজের জাত চিনিয়ে চলেছে ক্রিকেটের মিস্টার ৩৬০ ডিগ্রি।

তাই অসময়ে অবসরের পর দেশের সেবায় যেমন শেষ আরেকটিবার নিয়োজিত হতে চায় ডি ভিলিয়ার্স, তেমনই ৩৭-এও প্রোটিয়া টুপিটার মায়া ছেড়ে যেতে পারে না ডেল। অবসর না দিয়ে ফেললে হয়তো হয়তো সামনের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ইডেন পার্কের মতোই আরও এক সন্ধ্যায় ইলিয়টের বদলে অন্য কোনো ব্যাটসম্যানের দিকে ক্যারিয়ারের শেষ বলটা করতে ছুটে আসতেন বিশ্বের প্রাক্তন এক নম্বর বোলার ডেল স্টেইন।

আর বলটা ব্যাটে ছোঁ মেরে উড়ে যাবে বাউন্ডারির দিকে, শুধু শেষ মুহূর্তে হয়তো তা ইডেন পার্কের মতো বাউন্ডারিটা পেরিয়ে যেতে পারবেনা, বাউন্ডারি লাইনে তা তালুবন্দি করতে প্রস্তুত থাকবে ভাগ্যযুদ্ধের শেষ যোদ্ধা এবিডি…. থাক – এসব কথা বাস্তবের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলাটা অপ্রাসঙ্গিকই বটে, বিধির বিধানকে কেই বা খণ্ডাতে পারে।

থেমে থাকবেনা জনজীবন, আগের মতোই পিয়েনিয়ের্স আর অলিফ্যান্টস নদীর জল গিয়ে মিশবে ভারত মহাসাগরের জলে, ট্রান্সভিল থেকে উঠে আসবে আরও প্রোটিয়া তারকা। তবু পোর্ট এলিজাবেথের ড্রেসিং রুমটা বারেবার হয়তো খুঁজে বেড়াবে দলের ১৭ আর ৮ নম্বর জার্সির দুই সাবেক মালিককে, খুঁজে বেড়াবে তাঁদের ড্রেসিংরুমের রসায়নকে। না বন্ধুত্ব তো কখনোও থেমে থাকার নয়, মাঠের সবুজের বাইরে গিয়ে হয়তো তা ওই বদ্ধ কমেন্ট্রি বক্সের মাইকগুলোতে বা এই ছোট্ট স্মার্টফোনের স্ক্রিনটাতে আটকানোর সময় হয়ে এসেছে।

হয়তো ক্লুজনার, ডার্কওয়ার্থ লুইস বা ইডেন পার্কের অভিশপ্ত দিনগুলো একাকার হয়ে প্রোটিয়ারা দিন গুনবে নতুন কোনো শাপমুক্তির সুন্দর ভোরের। ওই কোকাবুরা ব্যাট আর বলগুলো বড্ড মিস করবে তাদের একছত্র অধিপতিদের, নর্দার্নসের সুপারস্পোর্টস পার্কের দুই প্রৌঢ়ত্বের পথযাত্রী থেকে ময়দানের ঘামেভেজা অফিসফেরত লোকদুটোর স্বপ্নভঙ্গের গল্প মিলে মিশে গিয়ে গান গাইবে বন্ধুত্বের আর পাশে থাকার।

ঘুড়ির ফাঁসে আটকে যাওয়া ভিক্টরিয়ার আশেপাশের মেঘগুলো তখন ধরে বেড়াবে বেতারের সংকেত আর সন্ধ্যার পরবর্তী আরসিবি-কেকেআর আইপিএল ম্যাচের ব্রডকাস্টিংয়ের আগে শেষ একবার রেডিওতে বেজে উঠবে –

ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোরেঙ্গে
তোরেঙ্গে দাম মাগার
তেরা সাথ না ছোড়েঙ্গে

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...