তাঁর পরিসংখ্যান দেখে যে কেউই অবাক হবেন। ক্রিকেটের ইতিহাসে তিনি এক ভবঘুরে চরিত্র। দুনিয়ার নানা প্রান্তে তাঁর ব্যাটের ফুলঝুড়ি খুলে বসেছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটটা খুব বেশি খেলা না হলেও যা খেলেছেন তাতেই রেকর্ড বইয়ে পাতায় ঝড় তুলেছিলেন। তিনি ক্রিকেট বিশ্বে ফ্রিল্যান্স ক্রিকেটারের টার্ম চালু করা রায়ান টেন ডেসকাট।
রানায় ডেসকাটের জন্ম ও বেড়ে ওঠা মূলত দক্ষিণ আফ্রিকায়। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা প্রতি ভালবাসা ছিল। বিশেষ করে স্কুলের ক্রিকেট ও রাগবি দলে তিনি ছিলেন নিয়মিত সদস্য। তবে তখনো সিরিয়াস ক্রিকেটের ধারেকাছে নেই ডেসকাট। গলফের প্রতিও একটা ভালবাসা ছিল। এমনকি এখনো সময় পেলেই ছুটে যান গলফ কোর্টে। বিভিন্ন সময় বলেছেন সময় কাটানোর জন্য গলফটাই নাকি সেরা।
সিরিয়াস ক্রিকেটে তাঁর আগমনটা অনেক পরে। তবে যখন আসলেন তখন রীতিমত আলোড়ন তুলেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ায় দ্রুতই কাউন্টি ক্রিকেটে নিজের নাম লেখান। ২০০৩ সালে এসেক্সের হয়ে তাঁর যাত্রাটা শুরু হয়েছিল। সেবছরই এক ম্যাচে তাঁর অলরাউন্ড পারফর্মেন্স দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি গ্রাহাম গুচ। তিনি ডেসকাটে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলানোর কথাও বলেছিলেন।
ডেসকাট অবশ্য তখনো চাইতেন নিজ দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার হয়েই খেলবেন। তবে বর্ণবাদের কারণে সেইসময় আফ্রিকা দলে সুযোগ পাওয়াটা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার জন্য পাড়ি জমালেন নেদারল্যান্ডে। নেদারল্যান্ডের হয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে প্রথম নিজেকে পরিচয় করান এই ব্যাটসম্যান। ২০০৫ ও ২০০৬ সালে দারুণ কিছু ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। এর ফলেই ২০০৭ বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে নেন ডেসকাট।
ওয়ানডে ক্রিকেটে তাঁর অভিষেকটা হয়েছিল ২০০৬ সালে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নিজের অভিষেক ম্যাচেই ৩২ বলে ৩৯ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। ঠিক তাঁর পরের ম্যাচেই ৪১ বলে ৫৬ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। এরপরের দুই ম্যাচেও যথাক্রমে খেলেন ৪৯ ও ৬৫ রানের ইনিংস। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেই প্রমাণ করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা তাঁদের এক রত্নকে হারিয়েছে। যত দিন গিয়েছে প্রোটিয়াদের এই বোধ ততো গভীর হয়েছে।
২০০৮ সালে টি-টোয়েন্টি অভিষেক ম্যাচেও খেলেছিলেন ৫৬ রানের ইনিংস। ব্যাট হাতে ডেসকাটের কৃতীত্বের কথা বলতে গিয়ে তাঁর বোলিংটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। অথচ পরিসংখ্যান বলে তাঁকে নিখুঁত অলরাউন্ডারই বলা যায়। ব্যাট-বলের এই প্যাকেজকে দলে ভীড়ানোর সময় একটা সময় ফ্র্যাঞ্চাইজি দলগুলো রীতিমত লড়াই করতো। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের হটকেক হয়ে উঠেছিলেন রায়ান ডেসকাট।
সহযোগী দেশের হয়ে খেলেও আইপিএল, বিগ ব্যাশ, বিপিএলসহ বিশ্বের প্রায় সব ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগই তিনি খেলেছেন। ব্যাট হাতে ওই সময়টাতে যা করা যায় তাঁর সবই করেছেন। ক্রিকেটের দুনিয়ার তাঁর আক্ষেপ করার মত তেমন কিছু নেই। তবুও হয়তো মনের কোণে নিজের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি একটা অভিমান রাখতেই পারেন ডেসকাট। কিংবা টেস্ট ক্রিকেট খেলতে না পারার একটা ব্যাথাও তো রয়েছে নিশ্চই।
নেদারল্যান্ডের হয়ে তিনি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খুব কমই খেলেছেন। বিশ্বের নানা প্রান্তে খেলতেই বেশি পছন্দ করতেন। তবু দেশটির হয়ে খেলা ৩৩ ওয়ানডে ম্যাচে তাঁর ঝুলিতে আছে ১৫৪১ রান। নূন্যতম ১০০০ রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যেই তাঁর গড়ই সবচেয়ে বেশি (৬৭.০০)। ভুল পড়েননি একটুও, ডেসকাট সত্যিই ৬৭ গড়ে রান করেছেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে তাঁর ঝুলিতে আছে পাঁচটি সেঞ্চুরি ও নয়টি হাফ সেঞ্চুরি। সহযোগী দেশের হয়ে তাঁর চেয়ে বড় মাপের ক্রিকেটার আর কখনো আসেনি সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নেদারল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন মোট ২২টি ম্যাচ। সেখানে ৪৪.৪১ গড়ে আছে ৫৩৩ রান। এই ফরম্যাটে রান করেছেন ১৩৩.২৫ স্ট্রাইক রেটে। কেন ডেসকাটকে নিখুঁত অলরাউন্ডার বলেছিলার তাঁর একটু ব্যাখ্যা দেয়া যাক। বল হাতে ৩৩ ওয়ানডেতে ২৪.১২ গড়ে নিয়েছেন ৫৫ উইকেট। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও নিয়েছেন ১৩ উইকেট।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ডেসকাট মোট ২০৩ টি ম্যাচ খেলেছেন। সেখানে ৪৪.৩৩ গড়ে করেছে ১১ হাজারেরও বেশি রান। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আছে ২৯ টি সেঞ্চুরি। বল হাতেও নিয়েছেন ২১৪ উইকেট। অথচ এমন একজন ক্রিকেটার কখনো টেস্ট ক্রিকেট খেলতে পারেননি। হয়তো টেস্ট ক্রিকেটের এক কিংবদন্তি পেতে পারতো দুনিয়া।
ওদিকে নেদারল্যান্ডের হয়ে শেষ ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন ২০১১ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপে। সেই ম্যচেও আয়রল্যান্ডের বিপক্ষে একটি সেঞ্চুরি করেছিলেন। অথচ কে জানতো এরপর আর ওয়ানডে ম্যাচে কখনো দেখা যাবেনা ডেসকাটকে। ওদিকে ২০১০ সালের পর একটা লম্বা বিরতি দিয়ে ২০১৮ সালে আবার টি-টোয়েন্টি খেলেছিলেন নেদারল্যান্ডের হয়ে।
দেশটির হয়ে শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছিলেন ২০১৯ সালে। অনেকেই হয়তো ভেবে নিয়েছিলেন এখানেই শেষ হচ্ছে এই কিংবদন্তির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। তবে সবাইকে অবাক করে ৪১ বছর বয়সে আবার নেদারল্যান্ডের বিশ্বকাপ দলে ফিরে এসেছেন ডেসকাট। আগামী মাসে ক্রিকেটের ভবঘুরে এই কিংবদন্তি খেলবেন তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ।