‘বাংলাদেশের বড় দল হয়ে ওঠার স্বপ্ন!’ – বিষয়টা একটা মিথ, কিংবা অনেকের কাছেই অলীক কোন ব্যাপার। যখন থেকে বুদ্ধি হয়েছে,ক্রিকেটটা একটু-আধটু বুঝতে শিখেছি,তখন থেকে শুনছি আমরা সম্ভাবনাময় দল,বিশেষ দিনে জায়েন্ট কিলার। আজও কি আমরা ক্রিকেট বিশ্বে সমীহ অর্জন করতে পেরেছি? ঘরের মাঠে আমরা ওয়ানডে ফরম্যাটে ফেভারিট দল, কিন্তু দেশের বাইরে বেশিরভাগ বড় দলই আমাদের গোনায় ধরে না-শুনতে খারাপ লাগলেও এটা অমোঘ সত্য। টেস্ট ফরম্যাটে আমরা জঘন্য দল। টি-টোয়েন্টিতে ভাল খেলিনা, অনেকের মতেই সবচেয়ে দুর্বল। কিন্তু অন্যদের কথায় তাল না দিয়ে আমি টি-টোয়েন্টিতে নিজেদের ‘সম্ভাবনাময় দল’ই বলবো। কারণটা একটু পর বলছি।
একটা দেশ টেস্ট ক্রিকেটের ২০ বছর পার করেছে, তবু তারা কেন আফগানিস্তানের মত নব্য টেস্ট দলের কাছেও ঘরের মাঠে পাত্তা পায় না, এর কারণ খুঁজলে খুব বেশি দূরে যাওয়া লাগবে না। সেই পুরনো কাদুন্দী!ঘরোয়া ক্রিকেট। হ্যাঁ, ডমেস্টিক ক্রিকেটের মান উন্নয়ন না করতে পারলে অবশ্যই আমরা বিশ্বমানের বোলার,ব্যাটার,এমনকি কোয়ালিটি মিনি অলরাউন্ডারও তৈরি করতে পারবো না।এটা ফ্যাক্ট।সাকিব-ফিজদের আমরা পেয়ে গেছি, তৈরি করিনি।
তাই টেস্ট ক্রিকেটে বড় দল হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা বেশ দীর্ঘমেয়াদী, আর সেজন্য কর্তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর বিকল্প নেই(যার আসলে অস্তিত্বই নেই।
কিন্তু আমাদের সীমিত রিসোর্স, মানে, খেলোয়াড়, তাদের নিয়ে আমরা টেস্টে বড় দল না হলেও অন্তত বেটার টিম হতে পারি, অন্তত: বেটার ক্রিকেট খেলতে পারি। টেস্টের বড় সাফল্যের জন্য অপেক্ষা করতে হলেও ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টিতে কিন্তু আমরা বড় সাফল্য, এমনকি যে কোন একটি বিশ্বকাপ পেতে পারি-এটা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু যা বললাম, সেটা সম্ভব হবে তখনই যখন প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ ও সুপরিকল্পিত হবে, যথাযথ বাস্তবায়ন হবে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন স্টেডিয়াম তৈরি করা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন,সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি-এগুলো করতে বিসিবিকে দীর্ঘমেয়াদে এগোতে হবে। কিন্তু এখন আমাদের হাতে যে খেলোয়াড়েরা আছে,তাদের সঠিকভাবে ব্যবহারের উপরই শর্টার ভার্সনে আমাদের বড় সাফল্য নির্ভর করবে।
অনেক পুরনো একটা কথা আছে, ক্রিকেট একটা মেন্টাল গেম। হ্যাঁ, সাকিবও সাক্ষাৎকারে একই কথাই বলেছেন, তিনি বাংলাদেশ দলে একটি পরিবর্তন আনতে হলে মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে চান। এটাই প্রথম পূর্বশর্ত। আপনার ভেতর ক্ষুধা ও নিজেদের সামর্থ্যে বিশ্বাস না থাকলে বড় দল কোনোদিনই হতে পারবেন না।
ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি তথা সাদা বলের ক্রিকেটে সাফল্য পেতে হলে ম্যানেজমেন্ট তথা বিসিবিকে বড় দলের মত চিন্তা করা শিখতে হবে। মডার্ন ক্রিকেটে ফ্ল্যাট পিচে ওয়ানডেতে ৩৫০-এর ওপর আর টি-টোয়েন্টিতে ২০০-এর ওপর রান না করার সক্ষমতা না থাকলে আপনি কখনোই সারা বিশ্বে দাপট দেখাতে পারবেন না। কারণ যে কন্ডিশনেই খেলেন না কেন, বেশিরভাগ দেশ শর্টার ভার্সনে রানের উইকেট বানায়, মিরপুরের মত ম্যাড়মেড়ে ক্রিকেট এখন অচল। আপনি বলবেন, আমাদের খেলোয়াড়দের ভাল উইকেটেও এত রান করার সক্ষমতা নেই। পাওয়া হিটার নেই। জোরগতির বোলার নেই।
সারাজীবন তো ‘নেই নেই’ করে গেলেন। আজ নেই বলে এই নিয়ে পড়ে থাকলে কখনোই কিছু হবে না। একটি জায়গায় অপূর্ণতা ঘোচাতে আপনাকে সেই জায়গাটা নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে হবে। আপনাকে পাইপলাইন বা ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে নির্দিষ্ট পজিশনে এমন কিছু ব্যাটার পিক করতে হবে, যাদের থেকে আপনি ওই পজিশনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ স্ট্রাইকরেটে রান পাবেন। যেমন – লোয়ার অর্ডারে তাকেই চুজ করবেন, যে ১৫০-এর ওপর স্ট্রাইক রেটে এই ব্যাট করবে।
ওপেনিংয়ে পাওয়ারপ্লে কাজে লাগাতে এমন দু’জনকে অবশ্যই বেছে নিবেন, যারা প্রথম ১০ ওভারে ওয়ানডেতে ৮০ রান বা টি-টোয়েন্টিতে ১০০ রান বের করতে পারে। মিডল ওভারের ব্যাটাররা অবশ্যই স্ট্রাইক রোটেট করে ১০০ এর উপরে স্ট্রাইকরেট বজায় রেখে খেলবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই আপনার পরিকল্পনার সাথে যায় না, এমন ধাচে যিনি ব্যাট করেন,তাকে সসম্মানে পরিকল্পনার বাইরে রাখতে হবে। তিনি সিনিয়র বা জুনিয়র খেলোয়াড় কিনা,সেটা বিবেচ্য হবে না।
আপনি বলতে পারেন, দীর্ঘদিন ধরে খেলা এমন কোন সিনিয়র খেলোয়াড়কে বাদ দিয়ে নতুনদের খেলালে দলের ব্যাটিং দাঁড়াতে পারবে না,কল্যাপ্স করবে। ব্যাটিং অর্ডার ভেঙে পড়বে। কিন্তু ওই যে, বড় কিছু পেতে চাচ্ছেন। আপনাকে বড় পরিসরে চিন্তা করতে হবে। আপনি যখন নতুন সেট আপ নিয়ে শুরু করবেন, আপনাকে তাদের যথেষ্ট, দরকারে তার চেয়ে বেশিই সুযোগ দিতে হবে।ধরুন, ছয় মাস বা এক বছর এদের নিয়েই এগোলেন।
তাদের স্বাধীনতা দিতে হবে, তারা নিজেদের ফিয়ারলেস ব্যাটিংটাই যেন করে। দল থেকে বাদ পড়ার ভয় নিয়ে খেললে কোন খেলোয়াড়ই নিজের সেরাটা দিতে পারে না। এভাবে আপনি হয়তো একদিন দু’দিন টি-টোয়েন্টিতে ১০০ এর নিচেও কল্যাপ্স করবেন, কিন্তু পরেরদিন ঠিকই ২০০-এর ওপর করবেন। ওয়ানডে ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। স্কোরবোর্ডে বড় রান (ওয়ানডেকে ৩৫০-এর ওপর বা টি-টোয়েন্টিতে ২০০-এর ওপর) করতে সক্ষম খেলোয়াড়েরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞতার সাথে ধারাবাহিক হয়ে যাবে একটা সময়।
বোলিংয়ের ক্ষেত্রেও আপনাকে ঝুঁকি নিতে হবে। ফ্ল্যাট উইকেটে রান চেক দেওয়ার একটাই উপায়,আপনাকে নিয়মিত প্রতিপক্ষের উইকেট তুলে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই ১৪০-১৪৫’র ওপর গতিতে নিয়মিত বল করতে পারে, এমন পেসারদের বেছে নিয়ে নিয়মিত খেলাতে হবে, বিশেষ করে ওয়ানডে ক্রিকেটে। হয়তো তারা এক্সপেন্সিভ হবে, ১০ ওভারে ৭০-৮০ দিবে, কিন্তু তারা নিয়মিত ২-৩ টা উইকেট তুলে নিলে সেটাই ম্যাচের গতি বদলে দিবে।
স্পিনার সিলেকশনের ক্ষেত্রেও টার্ন করাতে পারে, মার খাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে বল করে উইকেট আদায় করতে পারে, এমন উইকেটটেকারদের প্রাধান্য দিতে হবে। যেখানে স্বাভাবিকভাবেই ফিঙ্গার স্পিনারের চেয়ে রিস্ট স্পিনারকে আমি অধিক প্রেফার করবো। আসলে আমাদের খেলার ধরণই হল মোটামুটি পেসে লাইন-লেন্থ ঠিক রেখে বল করা পেসার বা ইকোনমিক বল করা স্পিনার। এজন্যই বড় আসরে স্পোর্টিং পিচে আমরা বড় ম্যাচ বের করতে পারি না।
আপনি বলবেন,এসব খালি লেখা যায়। করে দেখানো সহজ নয়। আমি বলবো, বড় কিছু তো সহজ পথে অর্জন করা যায় না।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে আনকোরা দল পাঠিয়ে ২০০৭ এপ্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে। রাহুল দ্রাবিড়- সৌরভ গাঙ্গুলিবিহীন বিশ্বকাপ পরিকল্পনা সাজিয়ে ২০১১ তে সফল হয়েছে। এই সময়ের মাঝে নিজেদের ডমেস্টিক স্ট্র্যাকচার আরও শক্ত করে একটা সময় ফাস্ট বোলিং নির্ভর দলে রূপান্তর করে এখন বিদেশের মাটিতে নিয়মিত টেস্ট জিতছে।
২০১৫ সালে বাংলাদেশের সাথে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়ে ইংল্যান্ড তাদের ক্রিকেট খেলার ধরনই পালটে ফেলেছে। নতুন সেট আপ নিয়ে শুরু করেছিল,যার ফল ২০১৯ বিশ্বকাপে দেখেছি। এখনও যা চলছে।
আর সর্বশেষ শ্রীলঙ্কা তাঁদের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে অবস্থাতেও দ্বিমুথ করুণারত্নে, দীনেশ চান্দিমাল, লাকমলদের ছুঁড়ে ফেলে ভবিষ্যতে সাফল্য পেতে নতুনদের নিয়ে বাংলাদেশে খেলে গেছে। সিরিজ হারলেও তাঁরা নিজেদের পরিকল্পনাকে ব্যাক করছে, নতুনদের নিয়েই ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তাদের বিশ্বাস, এর ফল তারা নিকট ভবিষ্যতে না পেলেও একটা সময় পাবে। পরিকল্পনায় অটুট থাকলে তাঁরা সফল হবে- আমিও মনে করি।
আর সব ম্যাচ জেতার অজুহাতে নতুন কিছু এক্সপেরিমেন্ট করতে ভয় পাওয়া বাংলাদেশ দল আদতে বড় কি জিতেছে, কিছু ব্যক্তিগত সাফল্য দূরে রাখলে!
নিজেদের সীমিত শক্তিকেই সঠিকভাবে ব্যবহার করে শর্টার ভার্সনে নিজেদের জন্য একটি ট্রফি নিয়ে আসা বিশ্বে বাংলাদেশ দলকে বড় এক্সপোজার দিবে। এর মাঝে নিজের ঘরোয়া ক্রিকেটকেও আস্তে আস্তে গুছিয়ে নিয়ে এক সময় আমরা টেস্টেও ভাল করতে শিখবো।
কিন্তু, বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে? – এই চিন্তায় চিন্তায় দিন কাটছে। এর চেয়ে সত্যিকারের বাঘ বের করে আনা ভাল।