ইগোতে ম্লান কিংবদন্তির অবদান

আপনাকে যদি পাকিস্তানের সেরা ব্যাটারের নাম জিজ্ঞেস করা হয় তার প্রতিউত্তরে আপনি কার নাম নেবেন? বাবর আজম, জাভেদ মিয়াঁদাদ, জহির আব্বাস কিংবা মোহাম্মদ ইউসুফের নাম। দুই একজনের হয়ত স্মৃতির পাতা থেকে উঁকি দেবে ইউনুস খানের নাম। অভিষেক টেস্টেই শতক হাকানোর রেকর্ড গড়া এই ব্যাটার নিস:ন্দেহে পাকিস্তানের একজন কিংবদন্তি।

শুধু যে পাকিস্তানের সেরা ব্যাটার ছিলেন ইউনুস খান তা কিন্তু নয় একবিংস শতাব্দীতে যে ক’জন সেরা ব্যাটার ছিলেন তাঁদের মধ্যেও ইউনুস অন্যতম। তরুণ সমাজ তাঁকে আইডল মানেন এবং একজন খেলোয়াড় ইউনুসকে যথেষ্ট সম্মান ও সমীহও করতেন। ইউনুস খান একবার তাঁর এই খ্যাতির পেছনের কারণ হিসেবে তিনি নিজের চর্কায় তেল দেওয়াটাই উল্লেখ করেন তিনি।

ইউনুস খান মনে করতেন অহেতুক আলাপচারিতা কিংবা নিজের খুটিনাটি বিষয় নিয়ে অপরের সাথে কথা বলার বিশেষ কোন কারণ নেই। এই ধরণের আলাপচারিতায় যদি অপরপক্ষ মনোযোগ হারিয়ে ফেললে তা মানহানীকর একটা ব্যাপার হয়ে যেতে পারে। ইউনুস খানের ভাষ্যমতে তিনি সর্বদা চেষ্টা করতেন অন্যের ভুলত্রুটি সুধরে দেওয়ার চাইতে নিজের দিকটাই আগে ঠিক করবার। তাছাড়া তিনি অন্যের ভুলে চেচামেচিতেও তিনি ছিলেন অনিচ্ছুক।

অনেকে মনে করেন তাঁর এই ইগো সমস্যা কিংবা তাঁর এই স্বভাবচারিতাই তাঁকে ভিলেন বানিয়েছে বেশ ক’বার। ইউনুস খানের ক্যারিয়ারে একটু উঁকিঝুঁকি মারলে দেখা যাবে রানের এক বহমান স্রোতধারার। পাকিস্তানের সবুজ জার্সি গায়ে তিনি ছাড়িয়েছেন ১০,০০০ হাজার রানের মাইলফলক।

এছাড়াও তাঁর দখলেই রয়েছেন পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ শতক হাকানোর অনন্য রেকর্ড। সবগুলো ফরম্যাট মিলিয়ে তাঁর শতকের সংখ্যা ৪১। তাঁর নিকটবর্তী ইউসুফ খান মাত্র দুইটি শতকের ব্যবধানে রয়েছেন। বর্তমান জাতীয় দলকে প্রতিনিধিত্ব করা আজহার আলী ও বাবর আজম তাঁর থেকে পিছিয়ে রয়েছেন যথাক্রমে ২০ ও ২১টি শতকের ব্যবধানে।

খেলোয়াড় হিসেবে তিনি যতটা না ছিলেন নন্দিত, ঠিক ততটাই ছিলেন নিন্দিত তাঁর ব্যবহারের জন্যে। শুভাকাঙ্খীরা প্রত্যাশা করেছিলেন তাঁর মতো কিংবদন্তি ব্যাটার হয়ত দায়িত্ব নেবেন দলের, দলের ব্যাটিং তথা সার্বিক উন্নয়নে কাজ করবেন। তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি ইঞ্জেক্ট করে দেবেন তরুণদের মাঝে।

পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড(পিসিবি) ঠিক তেমন পরিকল্পনা নিয়ে তাঁকে ব্যাটিং কোচ হিসেবে দুই বছরের জন্য। কিন্তু তাঁর স্বল্পভাষী স্বভাব কিংবা তাঁর গুরুগাম্ভীর্যতা কিংবা অন্যকে পাত্তা না দেওয়াকে ঘিরে তিনি কেবল একটি বছর টিকতে পেরেছিলেন পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ডাগআউটে।

তিনি নিজেকে ইমরান খানের মতো ভাবতে শুরু করেছিলেন। নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে মাত্র একটি টি-টোয়ান্টি বিশ্বকাপ জেতা ইউনুস হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন ইমরান খান একজনই এবং তিনি অনন্য। তাঁর মতো হতে চাওয়া নেহাৎ বোকামি এবং ভ্রান্তধারণা।

বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞদের এমনটাই মতামত। তাছাড়া তিনি বেশ খামখেয়ালি স্বভাবের ছিলেন। যথাসময়ে দলের ক্যাম্পে হাজির হতে যেন তাঁর বেশ অনীহা ছিল। তবে এমন ঘটনার পেছনে পাকিস্তানের ক্রিকেট সংস্কৃতিকে দায়ী করা যায় নির্দ্বিধায়। পাকিস্তানে ইউনুস খানদেরকে এ ধরণের শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে শাস্তি দেওয়ার নজির খুব একটা দেখা যায় না।

তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে আবার এসেছিলেন কোচ হয়ে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা ট্যুরে বর্তমান পেস আকমণের কাণ্ডারি হাসান আলীর সাথে এক বিতর্কে জড়িয়ে দায়িত্ব হারান ইউনুস খান। তাছাড়া খেলোয়াড়ি জীবনে একবার তিনি গণমাধ্যমে অকপটে বলেছিলেন তাঁর বিষয়ে যেসকল বিতর্কিত তথ্য প্রচার হয় তাঁর পেছনে দায়ী তাঁর সতীর্থরাই।

তাছাড়া তিনি এমনটাও বলেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে নাকি তাঁর সতীর্থরা একত্রিত হয়ে কুৎসা রটান এবং যার নেতৃত্ব দেন শহীদ আফ্রিদি। পরবর্তীতে তাঁর করা এই অভিযোগ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়।

ব্যাপারটা হতাশাজনক। ইউনুস খানের মতো খেলোয়াড়দের নাম যেখানে শুধুই থাকবার কথা রেকর্ড বইয়ে কিন্তু তা ছাপিয়ে গেছে বিতর্কিত সব কর্মকান্ডে। কিংবদন্তি ইউনুস খান দুইবার ব্যাটিং কোচের দায়িত্ব হতে অপসারিত হয়েছেন দুইবার। এছাড়াও অধিনায়কত্ব ছেড়েছেন প্রায় তিনবার।

যেখানে তাঁর ব্যাটিং, তাঁর রেকর্ড অনুপ্রাণিত করার কথা ছিলো তরুণদের, সেখানে ইউনুস খানের কৃতীত্ব ঢাকা পড়ে যাচ্ছে বিতর্কের আড়ালে। তবুও তাঁর বহু শুভাকাঙ্খী আশা করেন তিনি নিজেকে বদলে ফেলবেন অন্তত নিজের জন্যে না হোক, নিজের দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link