১৯৯৩-এর দাঙ্গা ও একজন নির্ভীক গাভাস্কার

উপমহাদেশের সাম্প্রতিক বীভৎস পরিবেশের অ্যান্টিডোট নিশ্চিতভাবেই খেলার মাঠ এবং শুধুই খেলার মাঠ। সে মাঠের বাউন্ডারির একদিকের ফিল্ডার যদি হন মহেন্দ্র সিং ধোনির ভক্ত বশির মিয়া, তবে অন্যদিকের বাউন্ডারিতে নিশ্চিতভাবেই ফিল্ড করছেন ভারতীয় ক্রিকেটের এক চিরকালীন বটগাছ, ১৯৯৩ সালের সিরিয়াল ব্লাস্টোত্তর দাঙ্গা-অশান্ত বাণিজ্যনগরীতে তাঁর একটি পরিবারের তিনটি প্রাণ বাঁচানো আজও মুম্বাইয়ের জীবনঅরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ হয়ে আছে।

যেজন্য ১১ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে মুম্বাইর ক্রীড়াসাংবাদিক সংগঠন তাঁকে জীবনকৃতী পুরস্কার দিয়েছিলেন মুম্বাইর সি সি আই-তে, তাদের গোল্ডেন জুবিলি অনুষ্ঠানে। ১২ মার্চ ১৯৯৩ তারিখের সেই ঘটনাটি ফিরে দেখছি, আজ আর একবার, সবার সঙ্গে।

১৯৯৩ সালের ১২ মার্চ মুম্বাইয়ে ১২টি ধারাবাহিক শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটেছিল। নিহত হয়েছিলেন ২৫৭ জন নিরীহ মানুষ। গোটা মুম্বাই জুড়ে শুরু হয়েছিল ভয়াবহ দাঙ্গা, যা মুম্বাই শহরকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল। শোনা যায়, এরপরে মুম্বাইয়ের মাটিতে গড়ে উঠেছিল আলাদা আলাদা সম্প্রদায়ের আলাদা আলাদা পাড়া।

বান্দ্রা-ওরলি সি লিঙ্কের পাশে ন’তলা হাউসিং কমপ্লেক্স স্পোর্টস ফিল্ডে তখন থাকতেন সানি সহ বারো জন টেস্ট ক্রিকেটার। তাঁদের মধ্যে ছ’জন ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। ক্রিকেটারটারা ছাড়াও বহুতলটিতে থাকতেন বিলিয়ার্ডসের বিশ্ব চাম্পিয়ন, ভারতীয় হকি দলের অধিনায়ক, একাধিক আন্তর্জাতিক টেনিস ও ব্যাডমিন্টন প্লেয়ারও। অবসরের ছ’বছর পরেও আপাদমস্তক শৃঙ্খলাপরায়ণ সানি পুরনো অভ্যাসে রোজকার মত সেদিন সকালেও কাছের এক মাঠে ঘাম ঝরাতে গিয়েছিলেন। ঘরে ফিরে লেবুর সরবতে চুমুক দিয়েই শুনে ফেলেছিলেন বাইরের রাস্তায় রক্তের স্বাদ পাওয়া একগুচ্ছ উন্মত্ত জনতার জান্তব চিৎকার।

স্লাইডিং জানলার পাল্লা সরিয়ে সানি দেখেছিলেন, সামনের রাস্তা দিয়ে তীর বেগে ছুটে আসছে একটা প্রাইভেট গাড়ি। কিন্তু রাস্তাটা ব্যারিকেড করে ঘিরে রেখেছিল কয়েকশো লোক। প্রাইভেট গাড়িটিতে ইঁট আর পাথর বৃষ্টি করতে করতে তার পিছনে তাড়া করে আসছিল একদল উন্মত্ত জনতা, যার মধ্যে অনেকের হাতে ছিল ছুরি আর তরবারি। গাড়িটিকে সানিদের ফ্ল্যাটের সামনে থামতে বাধ্য করেছিল সেই উন্মাদ জনতা। অবিরাম ইঁট বৃষ্টিতে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল জানলার কাঁচ থেকে উইন্ড স্ক্রিন। আশেপাশের বহুতলগুলির জানলা দ্রুত বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল আসন্ন নারকীয় ঘটনার আশঙ্কায়।

হঠাৎ সানির নজর পড়েছিল গাড়ির ভেতরে বসে আছেন এক তরুণ দম্পতি ও তাঁদের সন্তান। ক্রন্দনরত সেই দম্পতি হাতজোড় করে প্রাণভিক্ষা চাইছিলেন নরপশু দাঙ্গাবাজদের কাছে। তাঁদের ছোট শিশুটিও আতঙ্কে চিৎকার করে কাঁদছিল আর দাঙ্গাবাজদের উল্লাসে তিনজনের কান্নার আওয়াজ চাপা পড়ে যাচ্ছিল। ভিড় ক্রমশ বাড়ছিল গাড়িটি ঘিরে। উন্মত্ত জনতার মাথায় ঘুরছিল দুটি শব্দ, পেট্রল আর দেশলাই।

এই দেখে ফোন করে বিল্ডিংয়ে থাকা অনান্য ভারতীয় ক্রিকেটারদের সাহায্য চেয়ে বিচলিত সানি জীবনের মায়া না করে দৌড়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেছিলেন। কয়েকশো দাঙ্গাউন্মাদ জনতার সামনে একা গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সদ্য মাঠ থেকে ফেরা তিনি। সারা দেহের রক্ত উঠে এসেছিল তাঁর ঘাম না শুকোনো মুখে। সারা শরীর থর থর করে কাঁপতে থাকা সানির সেই রুদ্ররূপ এর আগে কেউ দেখেনি কোনদিন। নিশ্চিত শিকার হাত ছাড়া হতে দিতে চাইছিল না মারমুখী হয়ে ওঠা জনতাও।

তাদের চক্রব্যূহের ভেতরে থাকা গাড়িটির চারদিকে ঘুরতে শুরু করেছিলেন অকুতোভয় সানি গাভাস্কার। তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘তোমরা যা করতে চাইছো, তা আমাকে দিয়ে শুরু করতে হবে। আমি জীবিত থাকতে তোমরা ওদের স্পর্শ করতে পারবে না। তোমরা কি মানুষ! হিম্মত থাকে তো আগে আমাকে মারো।’

এর ফলে, সেই প্রথম থমকে গিয়েছিল রক্তলোলুপ দাঙ্গাবাজেরা। আর একা সানিকে কয়েক হাজার মানুষের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে দেখে, কমপ্লেক্স থেকে, ক্রিকেট ব্যাট হাতে বেরিয়ে এসেছিলেন ভারতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার, একনাথ সোলকার, যজুবেন্দ্র সিং প্রমুখ এবং বেরিয়ে এসেছিলেন কমপ্লেক্সে থাকা অনান্য খেলোয়াড়রাও।

তাঁদের কারও হাতে ছিল টেনিস র‌্যাকেট, কারও হাতে ছিল হকি স্টিক। সানির ওই রূপ দেখে একসময় পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিল সেই আক্রমণোদ্যত জনতা। সানির হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন সেই দম্পতি। আতঙ্কে সিঁটিয়ে থাকা তাদের শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন সানি। তারপর তাদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করেছিলেন সানি সেদিন।

সেই ঘটনার অনেক পরে ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর বাইরের দুনিয়া প্রথম জেনেছিল ঘটনাটির কথা। সানি না, সেই ১৯৯৩য়ের ১২ মার্চের ঘটনার অন্য এক প্রত্যক্ষদর্শী মুম্বাইয়ের স্পোর্টস জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের গোল্ডেন জুবিলি অনুষ্ঠানে, ঘটনাটি শ্রোতাদের সামনে বলেছিলেন। সেই প্রত্যক্ষদর্শীর নাম রোহন গাভাসকার, যিনি সেদিন কমপ্লেক্স-এর বারান্দা থেকে পুরো ঘটনাটি দেখেছিলেন। ঘটনাটি বিশদে ‘দ্য উইক’ পত্রিকায় লিখেছিলেন জাতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার যুজবেন্দ্র সিং।

পরে ক্রিকেটারদের অধিকার নিয়ে অনেক লড়াই করেছেন সানি, তৈরী করেছেন প্লেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন।দুঃস্থ অবসর নেওয়া ক্রিকেটারদের পেনসনের ব্যবস্থা করেছেন সানি। বেনিফিট ম্যাচ খেলে টাকা তুলে দিয়েছেন তিনি, করেছেন মুম্বইয়ের প্রাক্তন টেস্ট ক্রিকেটারদের ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা। কিন্তু সম্ভবত তাঁর সেরা অবদানটি ছিল নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তিনটি প্রাণ বাঁচিয়ে দেওয়া। যা ঘটনার ২৩ বছর পরেও কাউকে জানতে দেননি সানি গাভাস্কার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link