বাবর ও তাঁর আত্মত্যাগনামা

পাকিস্তানের ক্রিকেট দলের একটি তকমা কিংবা নিকনেম রয়েছে ‘আনপ্রডিক্টেবল’। এর পেছনে অবশ্য কারণ রয়েছে। কারণটাও খুব সরল। তাঁরা শক্তিশালী দলকে হারিয়ে দিয়ে, হোঁচট খেতো অপেক্ষাকৃত দূর্বল দলের বিপক্ষে। সেই ধারা পাকিস্তান ক্রিকেটের আদিকাল থেকে ছিল অব্যাহত।

কিন্তু এবার বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টির সপ্তম আসরে এসে যেন দেখা মিলেছে নতুন এক পাকিস্তান দলের। তাঁরা ইতোমধ্যে জিতে নিয়েছে নিজেদের তিনটি ম্যাচ। তাদের প্রতিপক্ষ ছিল যথাক্রমে ভারত, নিউজিল্যান্ড ও আফগানিস্তান। দুইটি ক্রিকেটিয় পরাশক্তি এবং একটি নবজাগরণ জাগানিয়া দলের বিপক্ষে জয় তুলে নিয়েছে অধিনায়ক বাবর আজমের দল।

এতেই যেন বন্দনায় ভেসেছেন বাবর। বিশ্বকাপের মতো এত বড় এক টুর্নামেন্টে এমন ধারাবাহিক সফলতার কৃতীত্ব সমর্থকেরা দিচ্ছেন বাবর আজমকেই। তাছাড়া বাবরের নেতৃত্বেই তো এসেছেন ভারতের বিপক্ষে অধরা জয়। বিশ্বকাপে কখনো ভারতে না হারাবার আক্ষেপ মোচনের সেনানী তিনিই। তাঁর বলিষ্ঠতায় পাকিস্তান যেন এক নব উদ্যম নিয়ে প্রতিটি ম্যাচে মাঠে নেমেছে।

পাকিস্তানের এই অধিনায়ক তাঁর দলকে উজ্জীবিত করেছেন প্রতিনিয়তই। তাঁকে পুরোদমে নিজেদের সবটুকু দিয়ে সাহায্য করে যাচ্ছেন তাঁর সতীর্থরা। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং তিন ইউনিটেই নিজেদের সর্বোচ্চটা নিয়ে জয় তুলে নিচ্ছে বাবরের ও তাঁর দল।

কিন্তু ভেতরের খবর ক’জনই বা জানে? ক’জন জানে বুকে রক্তক্ষরণ আর মাথায় প্রিয়জন হারানোর শঙ্কা নিয়ে একটি পুরো দলকে উজ্জিবিত রাখা, জয়ের বন্দরের দিক বাতলে দেওয়ার গল্প?

ছেলের বন্দনায় যখন গোটা দেশ প্লাবিত, ঠিক তখন বাবা জানালেন ছেলের মানসিক পরিস্থিতির কথা। জন্মদাত্রী মাকে আইসিউয়ের ভেন্টিলেশনে রেখে যে ছেলে দেশের সম্মানের জয়ের নেতৃত্ব দেয় তাঁকেই তো ‘দেশপ্রেমিক’ আখ্যা দেওয়া যায়। ঠিক এমনটাই করে দেখিয়েছেন বাবর আজম। দেশপ্রেম নাকি পেশাদারিত্ব? সেই প্রশ্নের উত্তর তোলা থাক। ঘটনার বিস্তারিত জানা যাক।

ভারতের বিপক্ষে যেদিন পাকিস্তান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচ খেলতে আরব আমিরাতের দুবাইয়ে খেলতে নামে ঠিক তখন বাবর আজমের মা ছিলেন হাসপাতালে মুমূর্ষু অবস্থায় ভর্তি, তাঁকে রাখা হয়েছিল ভেন্টিলেশনে। এমনটাই জানিয়েছেন নিজের ইন্সট্রাগ্রাম আইডি থেকে বাবর আজমের বাবা আজম সিদ্দিকি। তিনি তাঁর পোস্ট মারফত  উৎসবে মুখরিত পাকিস্তানির জনতাদের শুভেচ্ছা জানাতে দ্বিধাবোধ করেননি।

এছাড়াও আজম সিদ্দিকি লিখেন, ‘আমার দেশের এখন সময় একটি সত্য জানার। অভিনন্দন সকলকেই পরপর তিন ম্যাচে পাকিস্তান দল জয়লাভ করায়। আমার পরিবারকে এক বিশাল পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের দিন বাবরের মা ভেন্টিলেটরে ছিলেন।’

কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস পরিচালনাকারী যন্ত্র হচ্ছে ভেন্টিলেটর। মহামারী করোনাকালে যা ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হয়েছে। সে রকম এক যন্ত্রের ভরসায় মা’কে রেখে ছেলে নেমেছে এগারো জনের একটি দলকে নেতৃত্ব দেবে বলে। মনের ভেতর ঠিক কতবড় সমান পাথর রেখে এমনটা করা যায় আমার ঠিক জানা নেই। কিন্তু বাবর আজম হয়ত জানেন। পেশাদারীত্ব ছাপিয়ে যায় নাড়ী ছেড়া বন্ধন।

বাবরের বাবা তাঁর ইন্সটাগ্রাম পোস্টে আরো লেখেন, ‘বাবর তিনটি ম্যাচই খেলেছে প্রচণ্ড মানসিক পীড়া নিয়ে। আমি এখানে আসতে চাইনি। তেমনটাই হবার কথা ছিল কিন্তু আমি এসেছি যাতে বাবর দূর্বল হয়ে না পড়ে। মহান সৃষ্টিকর্তার বদৌলতে সে(বাবর) এখন পর্যন্ত ঠিক আছে।’

বাবরের বাবা আজম সিদ্দিক রয়েছেন আরব আমিরাতে, ছেলেকে ভরসা জোগাবেন বলে। কি দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যায় বাবর এবং তাঁর বাবার এই মানসিক দৃঢ়তার? আমার শব্দ ভাণ্ডারে অন্তত অভাব রয়েছে এমন শব্দের। তবে ভাবুন এত মানসিক পীড়া, যন্ত্রনা তার সাথে স্বজন হারানোর চাপা ভয় উপেক্ষা করে বাবর যে শুধু দলকে নেতৃত্ব দিয়েছে বিষয়টা তা নয়। সে রীতিমত সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে দলকে। তিন ম্যাচে করেছেন দুই অর্ধশতক। আর ভারতের বিপক্ষে বাবর-রিজওয়ান জুঁটির অদম্য ব্যাটিং তো নিশ্চয়ই এত জলদি স্মৃতির পাতায় মলিন হয়ে যাবার নয়।

এমন কিছু সময়ে যে কোন পেশাকে নিষ্ঠুর মনে হয়। তবে বাবর আজমরা জানেন পেশার সাথে আবেগের ফারাকটা কতটুকু। মাথায় আকাশ ছোঁয়া দুশ্চিন্তা এবং বুকে এভারেস্ট সমান কষ্ট নিয়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ধরতে হয় দলের হাল তা হোক দেশপ্রেম কিংবা পেশাদারিত্বের তাড়নায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link