এই লেখা আলোর মুখ না দেখলেই বোধহয় খুশি হতাম। কিন্তু ওই একটা বেদবাক্য, ‘খেলায় হারজিত লেগেই আছে।’ পাকিস্তানের কাছে হারের পর আজকের অসহায় আত্মসমর্পণ বড়োই বেদনাদায়ক। কিন্তু ক্রিকেট বিজ্ঞান বলেও একটা ব্যাপার আছে। সমাজ মাধ্যমে যেসব যুক্তি দেখছি, তাতে এই আলোচনা আরো জরুরি বলে মনে হয়। একে একে একটু তলিয়ে দেখা যাক ব্যাপারগুলো।
প্রথমেই বলি ঈশান কিষাণ কেন ওপেন করলেন। রোহিত শর্মা বাঁহাতি পেস বোলারদের বিরুদ্ধে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ নন। আগের ম্যাচেই শাহীন শাহ আফ্রিদি ওরকম ল্যাজে গোবরে অবস্থা করে ছেড়েছেন। আজকে তাঁর ওপরে ট্রেন্ট বোল্ট। কাজেই রোহিত শর্মাকে একটু আড়াল করা হলো। এবার প্রশ্ন হওয়া উচিৎ, তোমার দলের সেরা ব্যাটকে আড়াল করতেই বা হবে কেন? এবং এখানেই আধুনিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বিবর্তন ব্যাপারটা চলে আসে।
একটি টি-টোয়েন্টি দলে তিনজন অ্যাঙ্কর? যাঁরা ক্রিজে জমতেই সময় নিয়ে নেন বেশ কিছু বল। রোহিত আইপিএলে এরকম খেলে চালিয়ে দিতে পারেন কারণ তাঁর দলে একটা কাইরেন পোলার্ড, একটা হার্দিক পান্ডিয়া আছেন। লোকেশ রাহুলের দলেও একটা পুরান, একটা আগারওয়াল আছেন। এবার তাঁরা ফর্মে ছিলেন না, তাই রাহুলের অ্যাঙ্কর হিসাবে খেলা পাঞ্জাবের সেরকম হোমে-যজ্ঞে লাগেনি। সহজ রান চেজ ছড়িয়ে ফেলেছে তাঁরা বারবার।
বিরাট কোহলিও মূলত অ্যাঙ্কর। তবে ক্রিজে জমে গেলে শেষের ওভারে মেরে খেলতে পারেন। একটা আদর্শ টি-টোয়েন্টি দল রোহিত, বিরাট ও রাহুলের মধ্যে সর্বোচ্চ একজনকেই রাখতে পারে। নির্বাচকরা হয় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের এই বিবর্তন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন, অথবা জনরোষের ভয়ে কাজটি করে উঠতে পারেননি। গত ম্যাচে রোহিত, রাহুল তাড়াতাড়ি আউট হয়ে যাওয়ায় এই ব্যাপারটা এতো প্রকট হয়ে ওঠেনি।
কোহলিও ঠিক নিজের খেলা খেলে যেতে পেরেছেন মাঝের ওভার গুলোয়। ভালোই খেলেছেন। কারণ ঐ সময়ে হালকা স্লো পিচে চালাতে গিয়ে খেললে ১০০র কমে শেষ হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পিচ যথেষ্ট ভালো ছিল। এবং সেখানে দলের দুজন তথাকথিত সেরা ব্যাট, রোহিত ও রাহুল ১১২ ও ১০০ স্ট্রাইক রেটে মিলিত ভাবে পাঁচ ওভার খেলে এবং আউট হয়ে ফিরে এলে এরকমই অবস্থা আশা করা যায়।
তাঁরা দুজনেই টিকে গেলে ম্যাচের ফল অন্যরকম হতে পারতো। কোহলির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। এই ধরণের কনজারভেটিভ অ্যাপ্রোচটাই আসলে টি-টোয়েন্টিতে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এঁরা টিকে গেলে দারুণ রান হতে পারে। কিন্তু রোজ রোজ এরা টিকে যাবে, এই আশাটাই ভুল। এবং ভারতের এই দল এই আশার ওপরেই দাঁড়িয়ে। পাকিস্তান ম্যাচের দিন শুরুতেই দুটো অসামান্য বল ম্যাচের ভাগ্য নির্ণয় করে দেয়। আর আজকে রাহুল রোহিতের এই অ্যাপ্রোচ।
এর চেয়ে শুরু থেকে চালাতে গিয়ে ১৫ ওভারে ১১০ এ অল-আউট হবার ঝুঁকি নেওয়াটা আজকের মতো পাটা পিচে অনেক যুক্তিপূর্ণ। আবারও বলছি, আজকের মতো পাটা পিচে। পাকিস্তান ম্যাচে পিচ স্লো ছিল। সেখানে ১৫০-১৬০ জয়ও এনে দিতে পারতো যদি শিশির বাধ না সাধতো। আর ঈশান কিষান আজ চালিয়ে খেলতে গিয়ে আউট হয়েছেন বলে সবাই যে রাগারাগি করছেন, তাঁদের জন্যে বলি, আজ ওইটা ছয় হলেই আনন্দে নাচতেন। টি-টোয়েন্টি খেলাটাই এরকম। হাই রিস্ক-হাই রিটার্ন। টেস্ট ক্রিকেট যদি এফ.ডি হয়, ওয়ানডে ক্রিকেট মিউচুয়াল ফান্ড, টি-টোয়েন্টি তবে একান্তই শেয়ার ট্রেডিং।
এবার আসি আরেকটা প্রসঙ্গে। কেন অশ্বিন কে নেওয়া হলো না? ব্যাপারটা হচ্ছে পাকিস্তান দলে প্রথম ছয়ে বাঁহাতি মাত্র একজন। নিউজিল্যান্ড দলে দুজন। তাঁদের একজন আবার জেমস নিশাম! অশ্বিন বল করলেও নিশ্চয় মাঝের ওভার গুলোয় বা শুরুতে করবেন। সেখানে সবাই তো ডান-হাতি। অশ্বিন দারুন অফ-স্পিন দেখিয়ে হয়তো অনেককে ফ্লাইটে বিট করলেন। কিন্তু মিসহিটও এইসব পেশিবহুল খেলোয়াড়রা মাঠ পার করে দেন। যেখানে সঠিক ম্যাচ আপ নেই, সেখানে রবিচন্দ্রন অশ্বিন কি করবেন? আফগানদের বেশ কিছু বাঁহাতি ব্যাট আছেন মিডল অর্ডারে।
সেখানে অশ্বিনকে না দেখলেই অবাক হবো। এবার অশ্বিনের বদলে যিনি এসেছেন, সেই চক্রবর্তী খুব একটা ভালো বল করেননি। বা অশ্বিন খেললে হয়তো কোনো অদ্ভুত জাদু বলে একাই পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডকে শুইয়ে দিতেন। হতেও পারতো। কিন্তু বৈজ্ঞানিক ভাবেই তিনি দলের বাইরে রইলেন। এই ম্যাচ-আপের একটা দারুণ উদাহরণ আজ উইলিয়ামসন দিলেন।
ইশ সোধিকে ঠিক সেই সময়ে আক্রমণে আনলেন যখন বিরাট-রোহিত একসাথে ক্রিজে। দুজনেই লেগ-স্পিনের বিরুদ্ধে সাদা বলের ক্রিকেটে অতীতে ছড়িয়েছেন। এবং এবারেও সোধিই তাঁদের দুজনকে তুলে নিলেন। এবার যাঁরা ম্যাচ-আপের ব্যাপারটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন, তাঁরা ভাবলেন, ‘ইশ! সোধিকেও মারতে পারলো না? এদের খেলাই ছেড়ে দেওয়া উচিত।’
শেষ করি একটা কথা বলে। বিরাট কোহলি অধিনায়ক হবার পর এটাই প্রথম আইসিসি ইভেন্ট যার সেমিফাইনালে ভারত গেল না (যদিও অঙ্কের হিসাবে অনেক কিছুই সম্ভব এখনো!)। এটি অধিনায়ক হিসাবে তাঁর সবেমাত্র চতুর্থ ইভেন্ট। মহেন্দ্র সিং ধোনি তাঁর প্রথম চার ইভেন্টের একটি জিতেছিলেন বটে। কিন্তু বাকি তিনটেয়, ইয়ে মানে গ্রুপ লিগ থেকেই বিদায় নেন। আমি কিন্তু অধিনায়ক কোহলিকে আড়াল করছি না।তথ্য গুলো মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম আর কি। এখানেই শেষ করি। জাতীয় শোকের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে বেশি না দেওয়াই ভালো। এখন তাহলে বাকিরা ঠিক করুন, আসল কারণ কি? দায়বদ্ধতার অভাব নাকি আইপিএল খেলে খেলে চামড়া মোটা হয়ে যাওয়া?