চব্বিশ হাজার একশত সাতাত্তর। একটা সংখ্যা, পাঁচ অঙ্কের এক সংখ্যা। শুধুই কি সংখ্যা? না শুধুই সংখ্যা না। দীর্ঘ ৩৮বছরের চেষ্টা, অক্লান্ত পরিশ্রম আর অসাধারণ ক্রিকেটীয় প্রজ্ঞার সমন্বয়ের ফসল। এই ২৪,১৭৭ রান ভারতের কিংবদন্তি ব্যাটার রাহুল দ্রাবিড়ের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার স্বচ্ছ আয়নায় প্রতিফলিত হওয়া পরিসংখ্যান মাত্র।
দীর্ঘ পনেরো বছর ভারতের মিডেল অর্ডারের আস্থার প্রতীক হিসেবে খেলেছেন রাহুল দ্রাবিড়। অধিনায়কত্বও করেছিলেন ব্যাটিং দূর্গ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গণে তিনি ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন ৫০৮ ম্যাচে টেস্ট, ওয়ান্ডে মিলিয়ে। এই দ্রাবিড়ের ব্যাটে ভর করে কত ম্যাচ ভারত জিতেছে কিংবা তিনি বাঁচিয়েছেন কত ম্যাচ হেরে যাওয়া থেকে তা হিসেব করা বেশ মুশকিল।
নতুন করে এই কিংবদন্তি এসেছেন আলোচনায়। সম্প্রতি তাঁকে ভারত জাতীয় দলের কোচ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে ভারতের ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই)। তাঁকে নিয়ে বেশ সরব হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট অঙ্গন। খেলোয়াড় থেকে শুরু করে ক্রিকেট বিশ্লেষক সবাই নতুন কোচ নিয়ে বেশ আশাবাদী এবং তাঁদের প্রত্যাশার কথা জানাচ্ছেন বিভিন্ন মাধ্যমে এমনকি বাদ যাচ্ছেন না সাবেক ক্রিকেটারও।
ভারতের সাবেক খেলোয়াড় ও কিংবদন্তি সুনীল গাভাস্কার রীতিমত উৎফুল্ল বিসিসিআই এর এমন যুগান্তকারী সিধান্তকে কেন্দ্র করে। তিনি মনে করেন দ্রাবিড়ের কোচ হিসেবে ভারতীয় ক্রিকেট দলের সাথে সম্পৃক্ততা ভারতের উন্নতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। রাহুল দ্রাবিড়ের কোচিং ক্যারিয়ারের প্রত্যাশা নিয়ে গাভাস্কার বলেন, ‘ভারতীয় ক্রিকেট এখন দ্রুতগতিতে সামনের দিকে অগ্রসর হবে। তিনি তাঁর ব্যাপক অভিজ্ঞতা এবং কর্মনিষ্ঠা ছড়িয়ে দেবেন পুরো দলের মাঝে।’
তাছাড়া গাভাস্কার মনে করেন রাহুল দ্রাবিড় কৌশলগত দিক থেকে অনেক প্রসিদ্ধ একজন ক্রিকেটার। তাঁর এই গভীর কৌশলগত চিন্তাচেতনা দলকে যেকোন বাজে পরিস্থিতি সামলে নিতে অনায়সে সহয়তা করবে।
রাহুল দ্রাবিড় ক্রিকেটা খুব ভাল বোঝেন। তিনি যেকোন পরিস্থিতে উপলব্ধি করে সেই মুহূর্তের কর্মপরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলতে দারুণ পটু। দ্রাবিড়কে ক্রিকেটের একজন ভাল স্টুডেন্ট আখ্যা দিয়ে এমন মতই প্রকাশ করেন তাঁর সাবেক সতীর্থ দীনেশ কার্তিক। রাহুল দ্রাবিড়ের অধিনায়কত্ব দেখা দীনেশ কার্তিক তাঁর ব্যাপারে আরো জানান রাহুল খুব ঠান্ডা মাথার একজন ক্রিকেটার যিনি জানেন তাঁর কাজটা কি থাকে এবং তাঁর কি করা উচিৎ। তাঁর পাশাপাশি রাহুল অগাধ অভিজ্ঞতা ধারণ করেন নিজের মধ্যে। এসব কিছুই ভারতীয় ক্রিকেটের সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকার রাখতে চলেছে এমনটাই অভিমত উইকেট কিপার ব্যাটার দীনেশ কার্তিকের।
তিনি যে খুবই শান্ত স্বভাবের একজন খেলোয়াড় ছিলেন তাতে সন্দেহের কিংবা দ্বিধা প্রকাশের সুযোগ নেই। তিনি বরাবরই তাঁর ব্যাটেই দিয়েছেন জবাব। এবার হয়ত তিনি তাঁর বুদ্ধির খেলায় চেনাবেন নিজের জাত। কোচ হিসেবে নিজের জাত অবশ্য ঠিকই চিনিয়েছেন রাহুল।
তিনি ২০১৬ থেকে ২০১৯ অবধি ভারত অনূর্ধ্ব ১৯ দলের প্রধান কোচ হিসেবে দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন দুইটি বিশ্বকাপ ফাইনালে। ভারতের যুবারা একবার রানার্স আপ ও একবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দ্রাবিড় কোচ থাকাকালীন সময়ে। এছাড়াও ভারতীয় ‘এ’ দলে দায়িত্বও তিনি পালন করেছিলেন সাফল্যের সাথেই। শেষমেশ ভারতের দ্বিতীয় সাড়ির জাতীয় দল নিয়ে জিতে এসেছেন শ্রীলঙ্কার মাটিতে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ।
তাঁর সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। তাই সাবেক ক্রিকেটার ও ক্রিকেট বিশ্লেষক আকাশ চোপড়া তাঁর সামর্থ্যের উপর প্রশ্ন না তুলে জানিয়েছেন তাঁর চাহিদার কথা। রাহুলের কোচিং ক্যারিয়ারকে ঘিরে আকাশ চোপড়া তাঁর চাহিদার কথা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘তাঁর প্রধান কাজ হবে দলের মাঝে এমন সংস্কৃতির বিস্তার করা যাতে করে তাঁরা নকআউট ম্যাচে স্বচ্ছন্দে খেলতে পারে। তাঁকে এমন এক দর্শন দলে এমন দর্শন তৈরি করা যাতে করে ম্যাচভেদে খেলোয়াড়দের খেলার ধরণে যেন অপরিবর্তিত থাকে।’
ভারত যে ২০১৩ পরবর্তী সময়ে নকআউট পর্যায়ে প্যানিক থেকে কিংবা নার্ভাসনেস থেকে হোক ম্যাচ জিততে হিমসিম খাচ্ছে কিংবা ম্যাচ হেরে যাচ্ছে সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আকাশ তাঁর চাহিদার কথা, তাঁর প্রত্যাশ অভিব্যক্ত করেন। এছাড়াও তিনি রাহুলকে পরামর্শ দেন দলের অলরাউন্ডার সংযুক্তির। তাঁর মতে ক্রিকেট এখন বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে। এখন একটি ম্যাচ জিততে আপনার ব্যাটিং-বোলিং দুই ক্ষেত্রেই সমান পারদর্শী হতে হয়। দেখা যায় বোলার কিংবা ব্যাটিং বিবেচনায় কোন খেলোয়াড়ের অন্তর্ভুক্তি দলের কম্বিনেশনে বাজেভাবে প্রভাব ফেলে।
আকাশ মনে করেন শুধুমাত্র একটিমাত্র স্কিলে দলে জায়গায় পাওয়া সেই জায়গার অপব্যবহার। তিনি তাই অভিমত কিংবা পরামর্শ জানিয়েছেন যাতে রাহুল তাঁর দলে অন্তত অলরাউন্ডারদের প্রাধান্য দেয়। তিনি যেন এই সংস্কৃতির সূত্রপাত ঘটান এমন প্রত্যাশা রাখেন আকাশ চোপড়া।
সত্যিকার অর্থেই ক্রিকেট এগিয়েছে। তাঁর সাথে পাল্লা দিয়ে এগোতে হবে এই উপমহাদেশের দলগুলোকে। তাছাড়া দলে একজন অলরাউন্ডার থাকা মানে সে আপনাকে দুইটি দিক থেকেই সমান আউটপুট দিতে পারবেন। সুতরাং যতবেশি অলরাউন্ডার দলের সাথে যুক্ত থাকবে ততই দলের জন্য মঙ্গল। আধুনিক ক্রিকেট অন্তত সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছে। রাহুল কি করবেন জাতীয় দলের দায়িত্ব গ্রহণের পর তা সময়ই বলে দেবে।
এদিকে তাঁর অধীনে খেলতে মুখিয়ে আছেন ভারতীয় দলের সাথে যুক্ত থাকা খেলোয়াড়েরা। সবেচেয়ে উৎফুল্ল তরুণ ক্রিকেটাররা, তাঁরা যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছেন রাহুল দ্রাবিড়ের অভিজ্ঞতা নিজেদের মাঝে ধারণ করতে। শুধু তরুণরা নন রাহুলের অধীনে খেলতে মুখিয়ে আছেন রবিচন্দ্রন অশ্বিনের মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়েরাও।
ভারত জাতীয় দলের নতুন কোচ নিয়োগের ব্যাপারে অশ্বিনের অভিমত জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি রাহুল ভাইয়ের বিশাল গভীর অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং তিনি সানন্দে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্বগুলো পালন করে থাকেন। তিনি আমাদের অনেকের সাথে ড্রেসিং রুম শেয়ার করেছেন তার পাশাপাশি তিনি তরুণ খেলোয়াড়দের বিষয়েও খুব ভালভাবেই অবগত আছেন। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান এবং আমি চাই রাহুল ভাইয়ের অধীনের পারফর্ম করতে।’
তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে রাহুল দ্রাবিড়ের। যা তাঁকে তরুণ খেলোয়াড়দের সামর্থ্য সম্পর্কে বেশ ভাল এক ধারণ পেতে সহয়তা করেছে। তিনি ক্রিকেট বোঝেন কিংবা বলা যায় তিনি জানেন ক্রিকেট পড়তে। এছাড়াও তাঁর রয়েছে বিভিন্ন পরিস্থিতি কাটিয়ে কি করে ভাল ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা। তিনি তাঁর মধ্যে ধারণ করা পুরো ক্রিকেট যদি বিলিয়ে দিতে পারেন জাতীয় দলের মাঝে তবে ভারত যে হয়ে যেতে পারে অজেয় সে বিষয়ে দ্বিধাহীন সকলেই। টি-টোয়ন্টি পরবর্তী নিউজিল্যান্ড সিরিজ থেকেই ভারত জাতীয় দলের দায়িত্ব নেবেন রাহুল দ্রাবিড়। কিংবদন্তি খেলোয়াড় কি হতে পারবেন গ্রেট কোচ?