আপনি দূরদ্বীপবাসী। আমার সামান্য চিঠির অস্তরাগ সেই সাতসমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে আপনার হাতে পৌঁছে যাবে না এ যেমন সত্যি তেমনি আপনার অগণিত ভক্তের মাঝে একজন সামান্য খেলা লিখিয়ে ক্রিটিক আপনাকে নিয়ে কিছু লিখবে না – তাও হতে পারে না। আপনার কথা মনে এলেই আমার মনে পড়ে আমার ছেলেবেলার এক গল্প।
তখন আমি মফঃস্বলে থাকি। আমাদের পাশেই ছিল ফুলির মা বুড়ির ঘর। মনে পড়ে পাড়ার কারও বাড়ির কেউ মরণাপন্ন রুগী হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকলে সে কাঁদনা গাইত। তার ভাঙাচোরা ঘরের ছোট্ট ঠাকুরের ছবি যা কিনা ময়লা জমে আর ঠাকুরের মুখ দেখা যায় না তার সামনে বসে যেত প্রার্থনায়, বুড়ির মেয়ে মরেছে,বর মরেছে – সাতকূলে কেউ নেই।
তবু প্রতিটি বার সে ঠাকুরের কাছে হাত পা ছড়িয়ে বসত কারও দুঃসংবাদ আগমনের সম্ভাবনা থাকলেই। বলাই বাহুল্য ধুলো আর ময়লা জমা দেবতর কোনোদিন তার প্রার্থনায় সাড়া দেন নি। এমনকি পাড়ায় এমন ঘটলে বুড়ির কাঁদনা শুনলেই রেগে যেত সক্কলে- বুড়ি পড়তে জানে না, লিখতে জানে না- আর যেটা সে জানত না তা হল দেবতার সীমাবদ্ধতা!
সে আজ আর নেই। অনেক দিনের কথা। কিন্তু আপনার অস্তিত্ব প্রকট হল আমার জীবনে এর অনেক পরে, এই ঘটনার রেশ থেকে বহুদূরে।
ডিয়ার হিউম্যানেষু, রোনালদো দ্যস স্যান্তোস আভেইরা – আমি একথা একবাক্যে স্বীকার করে নেই আপনিই সেই রক্ত-মাংসের হিউম্যান যিনি আমাকে দেবতা শব্দটার প্রতিটা বর্ণকে বুনোট থেকে খুলে নগ্ন করে প্রমাণ করে দেন দেবতার চেয়ে সহস্র গুণ ক্ষমতাশালী স্পিসিজের নাম মানুষ!
কিন্তু, আপনার জীবনও তো কম বর্ণময় নয়। তবে কেন এত ভ্যানতারা বকতে হচ্ছে? এর উত্তর বাঁধা আপনার জীবনকুণ্ডলীর হলদে পাতার দস্তাবেজে। জর্জ বেস্ট-এরিক ক্যান্টোনা-ডেভিড বেকহ্যাম- এই তিনটে নাম বললেই ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের সিল্ক গ্রাস থেকে চুঁইয়ে পড়ে রোদ।
আর এই রোদে ১৮ বছরের সোনালি চুলের একটা তরতাজা যুবা হয়ে আপনি আসেন। আমি হলফ করে বলতে পারি ৭ নম্বর জার্সি আপনি চান নি, আপনি চেয়েছিলেন ২৮ নম্বর জার্সি। কিন্তু কোনো এক দৈবশক্তিমান ফুটবল বিজ্ঞানী আপনার অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও আপনার পিঠে চাপিয়ে দিয়েছিল বেস্ট-ক্যান্টোনা-বেকহ্যাম এর রাজমুকুট।
হ্যাঁ, ২৮ নম্বর পেলে ইতিহাসটা আপনি লিখে ফেলতেন একইভাবে, সংশয় নেই আমার এতে বিন্দুমাত্র কিন্তু ঠিক যেরকম মাধ্যমিকে স্টার পেলেই প্রতিটা ছেলের হাতে অলিখিত বিধানের মতো উঠে আসে সায়েন্স গ্রুপের মোটা মোটা বই, তার ইচ্ছের বাইরে গিয়ে পড়তে হলেই যখন ঘিরে ফেলে বিষাদ, সুইসাইড করে বসে অনেকে আপনি তাদের হয়ে যেন বলেন-
‘আমার পিঠে চাপানো হয়েছিল ম্যানচেস্টারের সবচেয়ে ভারী কাঁটার মুকুট, আমার হাতে দুটো অপশন ছিল – আমি সেই কাঁটাই বিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত হই নতুবা সেই কাঁটার ভেতর থেকে গোলাপ হয়ে ফুটে উঠি নিজে।’
আমি নিশ্চিত আপনি প্রথম অপশনটাকে অপশন বলে গণ্যই করেন নি কোনোদিন। ঈশ্বর অপশনের ঊর্ধ্বে নন। দূর্বল চিত্তের মানুষের প্রার্থনার মধ্যেও একটা হ্যাঁ কিংবা না এর দোদুল্যমান ডঙ্কা থাকে – আপনি মানুষ!
একেবারে বছরে চারবার রক্ত দেওয়া, বাবার মদ্যপ জীবনকে ঘৃণা করে এক ফোঁটা মদ স্পর্শ না করা একজন কোশ-কলা-রক্ত-মাংসের মানুষ যিনি ইতিহাসের বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ মানুষের ক্যাপ্টেন।
ডিয়ার কমরেড,
কমরেড শব্দের অর্থ সহকর্মী। আপনি সহকর্মী পৃথিবীর সমস্ত মানুষের। যে মানুষেরা দেবতা নামের আড়ালে নিজের দূর্বলতা লুকিয়ে ফেলতে চায় আপনি তাদের অন্ধকার তেকাঠিতে সপাটে ফ্রি-কিক আছড়ে দেন। আপনি দেবতা হতে যাবেন কেন? কোনোদিন ১ নম্বর বা দেবতা হিসেবে আপনাকে কেউ মনে রাখুক তা হয়ত চাই ও না আমি।
তাতে মানুষ শব্দটার অপমান। আবার একবার দেবতা নামক অনিশ্চয়তার কাছে মানুষ নামক নিশ্চয়তার হেরে যাওয়া, মানুষের লড়াই-এর ইতিহাসে, সভ্যতার ইতিহাসে কোথাও দেবতা নেই। আপনি আছেন। মানুষ হিসেবে আছেন, বুকের বাম পকেটে কোনো হারতে থাকা মানুষের ছোট্ট রক্ষাকবচ হয়ে আছেন!
অনেক কথা বলা হয়ে গেল। এ কথা আমার নয়, এ চিঠি আমার হয়ে একটা আদিম জীব আপনাকে অভিবাদন জানালো, সেই জীব একদিন আগুন জ্বালিয়েছিল পাথর ঘসে আর আপনি তাঁদের প্রতিনিধি হয়ে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ভারী জার্সি বয়ে ইতিহাস লিখেছেন, বার্নাব্যুতে জিদান-রোনালদো-বেকহ্যাম পরবর্তী অধ্যায়ের ভারী ব্যাটন বয়েছেন একা আর এখন ইতালির ব্যাটন তুলেছেন স্বেচ্ছায়!
সুতরাং, আপনি পুড়তে পুড়তে নিজেই আগুন! আর এই আগুনে পুড়ে নিখাদ হচ্ছে একখানা সত্য, একখানা আদিম মিথ – ‘মানুষ, শুধু মানুষই ইতিহাস রচনা করে।’ এই স্প্রিন্টটা আরও লম্বা হোক!
ইতি,
একজন সামান্য ক্রীড়া কলমচি।