মাহেলাকে মুরালির চিঠি

প্রিয় মাহেলা,

অনেক অনেক অভিনন্দন আইসিসির হল অব ফেমে জায়গা করে নেওয়ার জন্য। ক্যারিয়ারে দীর্ঘদিনের অর্জনে এটা যেকোনো ক্রিকেটারের জন্যই খুব সম্মানের। আমরা ক্রিকেটাররা এটা পাওয়ার জন্য মরিয়া থাকি। আমরা সত্যি ভাগ্যবান যে পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে আমরা কিছু করতে পেরেছি যেটা আমরা ভালোবাসি এবং অনুরাগী ছিলাম। গ্রেট ক্রিকেটারদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করাটা সত্যি অবিশ্বাস্য এবং অন্যতম সেরা অর্জন।

এটা আজীবন সম্মাননা পুরস্কার এবং বছরের পর বছর তুমি তোমার বন্ধু, প্রতিদ্বন্দ্বী এবং আইসিসি থেকে যে সম্মান অর্জন করেছো এটা তারই প্রতিচ্ছবি। তোমার নাম এই তালিকায় দেখে খুব ভালো লাগছে। আমার জন্য যদি বলি আমি সত্যি অবাক হয়েছিলাম প্রথম শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটার হিসেবে হল অব ফেমে জায়গা পেয়ে। এখন তুমি, আমার বন্ধু জায়গা পেয়েছো এই তালিকায়। আমার গর্ববোধ হচ্ছে কারণ আমি জানি তুমি শ্রীলঙ্কা এবং বিশ্বক্রিকেটে দীর্ঘ সময় ধরে কতটুক দিয়েছো।

তোমার ক্যারিয়ারে ফিরে তাকালে সেগুলোর অনেক হাইলাইটস পাওয়া যাবে। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে তোমার সেই দুর্দান্ত হার না মানা সেঞ্চুরি। যদিও আমরা ট্রফি জিততে পারিনি তবে, সেটা বিশেষ একটা ইনিংস ছিলো তোমার জন্য। আমার আরেকটা ইনিংস মনে পড়ে তোমার ২০০৮ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে একটা টেস্ট; ১৬৬ রান করেছিলে সেই ম্যাচে। এটা স্মরণীয় একটা ইনিংস কারণ দ্বিতীয় ইনিংসে যখন ব্যাট করা কঠিন ছিলো, উইকেটে টার্ন ছিলো – তখন তুমি সেঞ্চুরিটি করেছিলে।

তুমি ক্যারিয়ারে অনেক অসাধারণ কিছু ইনিংস খেলেছো এবং দলে থাকতে পারলে সবসময়ই তুমি বেশ খুশি থাকতে, অনেক রানও পেয়েছো। উইকেট নিতেও আমার উপর চাপ কম থাকতো, কারণ তুমি ভালো রান পেলে আমার জন্য সেটা সহজ হয়ে যেতো। যার কারণে তুমি শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণদের মাঝে একজন। ক্রিকেটের বাইরেও তুমি মানুষ হিসেবে অসাধারণ। খুব নরম মনের। মাঠের মধ্যে তোমার সামর্থ্য ছিলো নিজেকে যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার, তুমি অসাধারণ একজন ব্যক্তি যার সাথে আমি খেলেছি।

তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি শান্তপ্রকৃতির। তুমি জানো আমি খুব বেশি কথা বলি এবং আরো অনেকেই ছিল ড্রেসিং রুমে যারা খুব কথা বলতো, তবে তুমি খুব শান্ত ছিলে। তুমি সবসময়ই খেলা নিয়ে ভাবতে, খেলার প্রতি মনযোগ দিতে। ড্রেসিং রুমেও তুমি ম্যাচ নিয়েই ভাবতে! যখন তুমি অধিনায়ক হলে, তুমি খুবই শান্তভাবে ছিলে! অনেকেই এমন কিছুতে অতিউৎসাহী হয়ে পড়ে। তুমি ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারতে, কিন্তু ঠান্ডা মেজাজে থাকার কারণে সবসময়ই এটা তোমাকে সঠিক পথ দেখায়। আমি মনে করি এই কারণেই তুমি কোচ হিসেবে দুর্দান্ত কাজ করছো।

এটা শুধু নির্দিষ্ট কোনো মূহুর্তের জন্য না যে তোমাকে হল অব ফেমে নেওয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটকে দীর্ঘদিন ধরে যা দিয়েছো, এটা তোমার পুরষ্কার। সবকিছুই বিবেচনা করা হয় যখন ভাবা হয় এই তালিকায় কাকে নেওয়া হবে এবং আইসিসি ভেবেছে তুমিই পরবর্তী লঙ্কান ক্রিকেটার যাকে কুমার সাঙ্গকারা এবং আমার সাথে এই তালিকায় যোগ করা যায়। তুমি নির্বাচিত হয়েছো কারণ অধিনায়ক হিসেবে তুমি সফল। ব্যাটার এবং ফিল্ডার হিসেবেও ধারাবাহিক পারফরমার ছিলে। তুমি অনেক ক্যাচ ধরেছো, অনেকের চেয়েই বেশি। শ্রীলঙ্কার মান উঁচুতে নিতে তুমি সবকিছুই করেছো।

১৯৯৭ সালে যখন তুমি দলের এসেছিলে, খুবই অল্প বয়সী ছিলে। আমি কয়েক বছর ধরেই তখন খেলছিলাম যখন তুমি প্রথম দলে আসলে। তুমি খুবই লজ্জাবোধ করতে এবং শান্ত প্রকৃতির ছিলে। কিন্তু প্রথম ম্যাচে তুমি যখনি সুযোগ পেয়েছো, সেরাটা দিয়েছো। এটাই মেধা এবং প্রত্যেকেই দেখেছে তোমার ব্যাটিংয়ে কি আছে এবং ভেবেছিলো তুমিই হবে লঙ্কান ক্রিকেটের ভবিষ্যত তারকা। আমরা এটা তখনি ভেবেছিলাম। আমার মনে আছে আমি চিন্তা করেছিলাম তুমি শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটার হবে। তুমি যেভাবে শুরু করেছিলে অবসরের আগ পর্যন্ত সেভাবেই চালিয়ে গেছো।

উপমহাদেশের অনেক খেলোয়াড়দের মধ্যে তুমি স্পিন খুব ভালো খেলতে, এই কন্ডিশন গুলোতে তোমাকে আউট করা খুব কঠিন ছিলো। ইনিংসের শুরুর দিকে পেসারদের জন্য তোমাকে আউট করার একটা সুযোগ থাকলেও একবার তুমি সেট হলে তোমাকে আউট করা ছিলো খুবই কঠিন। কারণ তোমার মধ্যে সেই মেধা, সামর্থ্য সবটাই ছিলো লম্বা সময় ব্যাট করার। যদি এই ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন তুলে তাহলে তাদের ২০০৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তোমার ৩৭৪ রানের ইনিংসটি মনে করা উচিত। যেটা প্রমাণ করে তুমি অন্যদের তুলনায় ক্রিজে অনেক বেশি সময় ব্যাট করতে পারো এবং বড় রান করার সামর্থ্য রাখো।

তুমি ফিল্ডিংয়ে দুর্দান্ত ছিলে, বিশেষকরে স্লিপে। তুমি সেখানে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকতে আর ক্যাচ ধরতে। যদিও তুমি সিলি পয়েন্টে খুব ভালো ফিল্ডিং করতে। আমি সত্যি অনেক কৃতজ্ঞ। আমি টেস্টে অনেক বল করেছি, আর তুমি আমার বলে অনেক ক্যাচ ধরেছো। আমার ক্যারিয়ারের শেষ উইকেটও তুমি ক্যাচ ধরেছো। আমাদের মধ্যে নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু ছিলো কারণ ‘ কট জয়বর্ধনে, বোল্ড মুরালিধরন ‘ – ব্যাপারটা যেকোনো বোলার-ফিল্ডার জুটির চেয়ে বেশি ঘটেছে টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে।

তোমাকে লঙ্কান অধিনায়ক হিসেবে তখন তাঁরা বাছাই করেছিলো কারণ তুমি খুব বিশেষ একজন ক্রিকেটার ছিলে। সেখানে অনেক সিনিয়র ক্রিকেটার থাকা সত্ত্বেও তোমাকে নেওয়া হয়েছিলো। কারণ তোমার ক্রিকেটীয় মেধা আর তুমি ফিল্ডিংয়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারো। তুমি ক্রিকেটের সেরা চিন্তকদের একজন – এটার কারণে তুমি এখন পর্যন্ত অসাধারণ একজন কোচ। ২০ বছর ক্রিকেটে থাকার পর তুমি জানো কোন পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিতে হবে। কোচ হিসেবে তোমাকে একজন অধিনায়কের মতো করে ভাবতে হয়। এটা তোমার জন্য খুব সহজ ব্যাপার, তাই এতে অবাক হওয়ারও কিছু নেই।

আমাদের মধ্যে মজার মূহুর্তেগুলোর দিকে যদি ফিরে তাকাই। আমি তোমার সাথে মাঠে ঝগড়াও করেছি অনেক। যখনি আমি উইকেট চাইতাম তোমাকে বলতাম আমাকে বল দাও। মাঝে মাঝে তুমি মনে করতে এটা সঠিক সময় নয় আমাকে আনার। তাই আমি তোমাকে বাধ্য করতাম এবং ঝগড়া করতাম আর চেষ্টা করতাম বোলিংয়ে আসার। এই জিনিসগুলা ক্রিকেটে হয় এবং প্রায় বোলারই এমন করে। তবে মজার ব্যাপার হলো, আমি সবসময়ই এই লড়াইয়ে জিততাম।

আমি তোমার ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা জানাই। এবং তোমাকে বলতে চাই এগিয়ে যেতে থাকো, হার মেনো না। তুমি খেলোয়াড় এবং কোচ হিসেবে যা অর্জন করেছো সত্যি অসাধারণ। শুধু এটা নিশ্চিত করো যে ক্যারিয়ার শেষে গ্রেট খেলোয়াড় হিসেবে আমরা যেভাবে তোমাকে মনে রেখেছি, কোচ হিসেবেও যেনো সেভাবেই মনে রাখতে পারি।

ইতি

– মুরালি

______________________

সদ্য প্রকাশিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থার (আইসিসি) ‘হল অব ফেম’ এর তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে তিনজনকে। সাবেক দক্ষিণ আফ্রিকান অলরাউন্ডার শন পোলক ও নারী ইংলিশ ক্রিকেটার জানেত ব্রিটিনের সাথে যুক্ত করা হয়েছে সাবেক লঙ্কান অধিনায়ক মাহেলা জয়াবর্ধনকে। মাহেলার এমন গৌরবময় অর্জনে শুভেচ্ছা জানিয়ে সাবেক কিংবদন্তি লঙ্কান তারকা মুত্তিয়া মুরালিধরন উপরের চিঠিটি লিখেছেন মাহেলাকে।

এর আগে প্রথম লঙ্কান ক্রিকেটার হিসেবে আইসিসির হল অব ফেমে জায়গা পান মুত্তিয়া মুরালিধরন। এরপর চলতি বছর এই তালিকায় যুক্ত হন আরেক লঙ্কান তারকা কুমার সাঙ্গাকারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link