দ্য কিংস গ্যামবিট

ভারতীয় ক্রিকেটের অভ্যন্তরীণ অবস্থা যেন হঠাৎ করেই কালো মেঘে আষ্টেপৃষ্টে আছে। হুট করেই ওয়ানডে অধিনায়ক পরিবর্তন, বিরাট কোহলির সাথে বোর্ড সভাপতি ও সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির কথার অমিল সব মিলিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটে যেনো অস্থির এক অবস্থা। অভ্যন্তরীণ কোন্দল সেভাবে প্রকাশ না পেলেও বিরাটের এক বার্তায় গাঙ্গুলির মানক্ষুন্ন হয়েছে সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কে ঠিক কে ভুল সেটির চেয়ে বেশি আলোচনায় বিরাটের সাহকসিতা।

বিরাট কখনোই নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি কিংবা নিজের সিদ্ধান্ত ভুলও ভাবেননি। অধিনায়ক হিসেবে নিজের প্রথম টেস্টেই অভিজ্ঞ রবিচন্দ্রন অশ্বিনের স্থলে অভিষেক করিয়েছিলেন লেগ স্পিনার করণ শর্মাকে। ওই টেস্টে ৪ উইকেট শিকারের পর আর কখনোই দলে সুযোগ পাননি করণ!

যদি অশ্বিনকে খেলানো হতো তাহলে কি এর চেয়ে খারাপ পারফরম করতো? কিংবা করণকে কি আরো পরিপক্ক হবার পর দলে আনা যেতো না? করণের ক্যারিয়ার কি অল্পতেই থমকে গেলো না! এসব প্রশ্ন আপনার মনে আসতেই পারে। তবে কোহলি একবার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটি নিয়ে আর ভাবেননা। তিনি নিজের সিদ্ধান্তকেই সবসময় উপযুক্ত মনে করেছেন। বিরাটের মনে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধায় থাকা মানেই মাঠে ভুলের পর ভুল করা। তাই যে সিদ্ধান্ত তিনি নিতেন সেটাই সবসময় তার কাছে সেরা।

পুরো ক্যারিয়ারেই কোহলি সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে কখনোই পিছপা হননি। এমন সিদ্ধান্ত নিতে প্রায়শই অনেক চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে বিরাটকে। দলের জন্য যা সেরা সিদ্ধান্ত মনে হয়েছে সেটিই গ্রহণ করতেন তিনি। সাবেক কোচ অনিল কুম্বলের কথাই মনে করুন। বিরাট সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন কুম্বলের সাথে তিনি কাজ করতে চান না! অন্য কোনো অধিনায়ক পূর্বে এমন সাহস দেখিয়েছেন?

সে সময় ভারতের ক্রিকেট পরামর্শক কমিটিতে থাকা সৌরভ গাঙ্গুলি ও ভিভিএস লক্ষ্মণ বিরাটের এমন বার্তায় অসম্মতি জানিয়েছিলেন। বিরাট একাই নিজের সিদ্ধান্তকে রুপ দিয়েছিলেন বাস্তবে! দলের প্রয়োজনে তিনি বরাবরই সাহসী পদক্ষেপ দেখিয়েছেন। ২০১৮-১৯ সালে পার্থে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চারজন পেসার খেলান বিরাট, ওই ম্যাচে হেরেও যায় ভারত। ওই টেস্টের পর বিরাটের কাছে জানতে চাওয়া হয় অশ্বিনের পাশাপাশি জাদেজারও ইনজুরি ছিল কি না?

যার কারণে স্পিনার না নিয়ে চার পেসারকে খেলানোর সিদ্ধান্ত! বিরাট জানালেন, ‘না, এটা পরিকল্পনার অংশ।’ এরপরই সাবেক ক্রিকেটাররা বেশ সমালোচনা করেন বিরাটের। এর এক সপ্তাহ পর কোচ রবি শাস্ত্রী জানান জাদেজাকে খেলানো হয়নি কারণ সে ৬০-৭০% ফিট ছিলো! বিরাট সবসময়ই নিজের নেওয়া সিদ্ধান্তকেই সবার সামনে স্বীকার করেছে সেটি ভিন্ন কারণে হলেও নিজের উপরই দায় নিয়েছেন এই অধিনায়ক।

একজন ব্যাটার হয়েও ব্যাটারদের জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে তিনি কখনোই দু’বার ভাবেননি। তিনি প্রথম অধিনায়ক নন যে মাত্র পাঁচ ব্যাটার নিয়ে খেলেছে কিন্তু তিনি এটি ধারাবাহিক ভাবেই করে গেছেন! এমনকি নিজের খারাপ সময়েও প্রথম দিন থেকেই টার্নিং উইকেটে খেলতে আপত্তি করেননি।

ক’জন অধিনায়ক এর আগে নিজের সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে? সাবেক অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি ঘরের মাটিতে কালেভদ্রে নিজের পছন্দের উইকেট পেতেন। রাহুল দ্রাবিড় অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন বোর্ডের সিদ্ধান্ত ছাপিয়ে নিজের ইচ্ছা-সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়ন করতে না পেরে। তবে বিরাট ছিলেন অন্য পথে! নিজের কাছে যেটা সঠিক মনে হয়েছে সেটিই তিনি গ্রহণ করেছেন।

টেস্ট চ্যাম্পিয়শিপের ফাইনাল হার, ব্যাট হাতে বাজে সময় এরপরেও ভারতের অন্যতম বড় ম্যাচ উইনার অশ্বিনকে একাদশের বাইরে রাখতে কোনো দ্বিধা করেননি বিরাট। কারণ বিরাটের মনে হয়েছে একটা ভিন্ন কম্বিনেশন দলের অবস্থার আরো উন্নতি করতে পারে।

শচীনকে যখন অধিনায়কত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় তিনি এর বিপরীতে কিছুই বলেননি। তবে অবসরের পর তিনি এই নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়েন, কষ্ট পাওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন। দলে থাকাকালীন সাবেক অধিনায়করা কেউই বোর্ডের কথা কিংবা সিদ্ধান্তের বিপরীতে নিজের মতের প্রাধান্য দিতে পারেননি। সুনিল গাভাস্কারের পর বিরাটই ভারতীয় ক্রিকেটে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।

বিরাটের টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে গণমাধ্যমে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি ক্রিকেট বোর্ডের কেউই। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের আগে জানা যায় ওয়ানডে অধিনায়কত্ব থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বিরাটকে! কারণ বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই) চায় সাদা বলের ক্রিকেটে একজন অধিনায়ক থাকুক। একই সাথে বোর্ড সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলি জানান, টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব না ছাড়তে তিনি বিরাটকে অনুরোধ করেছিলেন।

তবে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের আগে প্রেস কনফারেন্সে এসে বিরাট জানালেন ভিন্ন কথা। ২০২৩ বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার পরিকল্পনাটা বিরাটের আগ থেকেই ছিলো। কিন্তু হুট করেই দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের দল ঘোষণার দেড় ঘন্টা আগে বিরাটকে জানানো হয় তাকে আর ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে বিবেচনা করছে না বিসিসিআই। একই সাথে বিরাট জানান, ‘টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব না ছাড়ার ব্যাপারে কেউই তাকে অনুরোধ করেনি!’

এরপরই বিরাট এবং গাঙ্গুলির মাঝে বোঝাপড়া নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয় গণমাধ্যমে। অধিকাংশের মতে কোহলি সত্যিটাই সবার সামনে প্রকাশ করেছেন। তবে ক্যারিয়ারে নিজের সবচেয়ে খারাপ সময়ে এসে বিরাটের এমন জবাব যেন আবারও পরিচয় দিলো সাহসিকতার। এখন পর্যন্ত বিরাটের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় গ্যামবিট এটাই – দ্য কিংস গ্যামবিট!

– ইএসপিএন ক্রিকইনফো অবলম্বনে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link