নির্বাসিত রয় স্তব্ধ সময়

ভারতীয় ক্রিকেট বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত ও কঠিনতম প্রতিযোগিতার এক মহামঞ্চ। প্রায় বছর জুড়েই নানা রকম ক্রিকেট টুর্নামেন্টে যুক্ত থাকে দেশের অভ্যন্তরীণে থাকা প্রতিটি ক্রিকেট খেলোয়াড়। প্রত্যকটা খেলোয়াড়ের মনে স্বপ্ন এক ও তা ক্যারিয়ার জুড়েই ধ্রুব।

জাতীয় দলের হয়ে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা। তবে ভারতীয় ক্রিকেটে পথটা বেশ কঠিন। সত্যিকার অর্থেই কঠিন কেননা প্রায় বিলিয়নের বেশি জনগণের দেশে ক্রিকেট প্রতিভার তো আর শেষ নেই। ঘরোয়া লিগে তো আর দর্শক থাকে না সাথে থাকে না মিডিয়া কাভারেজ। তবুও নিজেদের শানিত করে নেওয়ার উত্তম মাধ্যম তো সেই ঘরোয়া লিগ।

তবে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) ভারতীয় খেলোয়াড়দের জন্যে তৈরী করে দিয়েছে নতুন এক সম্ভাবনার দাঁড়। আইপিএলে রয়েছে যেমন দর্শক, তেমনি মিডিয়া কভারেজ। তার সাথে অঢেল অর্থের ছড়াছড়ি ছাড়াও বিশ্বব্যাপী তারকা খেলোয়াড়দের সাথে কিংবা বিপক্ষে খেলার সুযোগ। এই সুযোগটাই ভারতীয় খেলোয়াড়রা লুফে নিতে চায় খুব করে। আর এই আইপিএলকে কাজে লাগিয়ে যেতে চায় জাতীয় দলে। হার্দিক পান্ডিয়া, রুতুরাজ গায়কড়রা তো তাই করলেন।

গতবারের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হার্শাল প্যাটেলের স্বপ্নও হয়ত বাকি সব খেলোয়াড়দের স্বপ্ন থেকে ব্যতিক্রম নয়। যদিও তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তবে বোধকরি তিনি নিজেকে প্রমাণ করতে বেশ দেরি করে ফেললেন। । সেই ২০১৫ সালে আইপিএলে ১৭ উইকেট নিয়ে একেবারে হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি হার্শাল।

তারপর ঘরোয়া বিভিন্ন ক্রিকেটেও ছিলেন প্রায় নিষ্প্রভ। সেই ২০১৫ এর পর থেকে তিনি পরবর্তী পাঁচ বছরে কেবল ১৮টি আইপিএল ম্যাচে অংশ নিতে পেরেছিলেন তিনি। এর পেছনে তাঁর ধারাবাহিকতার অভাব প্রধান কারণ। যদিও তিনি বেশ ভাল একটা ইকোনমি রেটে বল করেছিলেন তবুও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে খানিক বেশি রান খরচার প্রবণতা ছিল তাঁর। সেই কারণেও হয়ত খুব একটা বেশি সুযোগ পাননি হার্শাল।

একটু যদি ঘরোয়া লিগে হার্শাল প্যাটেলের পারফর্মেন্সে ঢুঁ মারলে বোঝা যাবে ২০২১ সালের আগে তাঁর আড়ালে থেকে যাওয়ার কারণ। ২০১৭/১৮ রঞ্জি ট্রফিতে মাত্র আট উইকেট নিয়েছিলেন হার্শাল। যার মাশুল দিয়েছিলেন ২০১৮ সালে কোন আইপিএল ফ্রাঞ্চাইজি তাঁকে দলে ভেড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি।

সেই আক্ষেপ থেকে নিজেকে এবং নিজের পারফর্মেন্সের উন্নতির এবং ধারাবাহিকতা প্রাপ্তির লক্ষ্যে অনুশীলন রেখেছিলেন অব্যাহত। তবুও ভাগ্য় পরিবর্তনে ব্যর্থতাই ছিল তাঁর সঙ্গী। ২০১৮/১৯ রঞ্জি মৌসুমে হারিয়ানার অধিকাংশ ম্যাচে অধিনায়কত্ব করা সত্ত্বেও তাঁর উইকেট সংখ্যা ছিল কেবল ২৩টি। পরবর্তী বেশিরভাগ ঘরোয়া লিগ তিনি মিস করেছেন ইনজুরির কারণে।

হার্শাল প্যাটেল মুদ্রার অন্যপাশটা দেখা শুরু করেন বছর খানেক আগে থেকে। ২০২০ সালটা যেন এক আশীর্বাদে পরিণত হয় হার্শালের জন্যে। তাঁর জীবনের ঘুরে দাঁড়ানোর বছর হিসেবেও বছরটাকে বিশেষায়িত করা যায়। তিনি রঞ্জি ট্রফিতে তুলে নিলেন ৫২টি উইকেট মাত্র নয়টি ম্যাচ খেলে। যা কিনা  অবসান ঘটায় বহুকাল ধরে গড়ে রাখা এক রেকর্ডের।

ভারতীয় প্রথম শ্রেণি ক্রিকেট এক মৌসুমে হারিয়ানার হয়ে সর্বাধিক উইকেট শিকারের রাজেন্দ্র গোয়েলের দীর্ঘকালের রেকর্ড ভেঙে ফেলেন হার্শাল প্যাটেল। লিস্ট ‘এ’-তে পাঁচ ইকোনমি রেটে দশ উইকেট নিয়ে তাঁর ফর্ম অব্যাহত রাখেন সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতেও। সেখানে ১৫.৯৪ গড়ে সাতের খানিক বেশি ইকোনমি রেটে ১৯ উইকেট নিয়ে নিজের সেরা ফর্মের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন। 

নিজের এই পারফর্মেন্সের উন্নতির কৃতিত্ব তিনি দিতে চান অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি রিকি পন্টিং-কে। ২০১৯ সালে হার্শাল ছিলেন দিল্লী ক্যাপিটালসে, সে বছর দিল্লির প্রধান কোচ রিকি পন্টিং হার্শালকে দিয়েছিলেন টোটকা। সেই টোটকাতে উদ্বুদ্ধ হয়েই আজ হার্শাল রয়েছেন লাইমলাইটে।

পন্টিং- এর সেই বার্তা নিয়ে হার্শাল বলেন, ‘রিকি আমাকে বলেছিলো আমি অনুশীলনে বেশ ভাল করি কিন্তু মূল ম্যাচে ভাল করা প্রয়োজন। তাঁর সেই কথায় আমি বেশকিছু বিষয় বুঝতে পারি। তা হলো আমি ম্যাচে খুব বেশি আত্মবিশ্বাসী থাকি না। আমারও মাঝেমাঝে তাই মনে হতো। কেননা ম্যাচে আমি সবসময় আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারবো কিনা তা নিয়ে সন্দিহান থাকতাম।’

সেই অহেতুক চিন্তা থেকে নিজেকে কি করে দূরে রাখবেন সেই সঞ্জীবনী মন্ত্রও নাকি দিয়েছিলেন পন্টিং। সেই মন্ত্রের বিষয়ে হার্শাল বলেন, ‘সে আমাকে বলেছিলো ম্যাচে ঘটতে পারে এমন সকল পরিস্থিতির একটা পরিষ্কার ছবি মাথায় এঁকে নিতে। যেন কোন মুহূর্তে আমার কি করণীয় তাঁর স্পষ্ট ধারণা আগে থেকেই থাকে। এই পদ্ধতি আমাকে দুশ্চিন্তা মুক্ত থেকে সফল হতে সহয়তা করবে বলেও তিনি জানিয়েছিলেন।’ পন্টিং এর সেই সঞ্জীবনী মন্ত্রের প্রতিফলন তো সকলের সামনেই। ২০২০ সালের ভাল পারফর্মেন্সের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতেও পেরেছিলেন হার্শাল।

২০২১ আইপিএলে যখন হার্শাল আবার ফিরলেন রয়েল চ্যালেঞ্জার্সের ডাগ আউটে তখন তিনি ফিরেছিলেন এক অন্য হার্শাল প্যাটেল হয়েই। টুর্নামেন্ট সেরা বোলার হওয়ার পাশাপাশি দলকে প্লে অফে নিতেও বেশ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। একাই নিয়েছিলেন ৩২টি। তাছাড়া শেষের পাঁচ ওভারে সর্বাধিক রান খরচের একটা দুশ্চিন্তা থেকে হার্শাল দলকে করেছিলেন নির্ভার।

পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই তাঁর ইকোনমি রেট ছিলো বেশ সন্তোষজনক। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ানো হার্শালের টি-টোয়েন্টি উইকেট সংখ্যা এখন চার দুই ম্যাচ থেকে। আইপিএলের ভাল পারফর্মেন্স যে জাতীয় দলের দুয়াড় খুলে দিতে পারে তার আরো এক দৃষ্টান্ত রাখলেন তরুণদের সামনে। তাছাড়া হাল না ছেড়ে লড়াই করে যাওয়ার দীক্ষাও দিলেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link