কে বলে টেস্ট বিরক্তিকর!

ফাস্ট বোলারদের মধ্যে সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক আর বর্তমান টেস্ট ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড়ের মালিকের মধ্যে প্রতিযোগিতা অবশ্যই একটি দারুণ উপভোগ্য ব্যাপার। কিন্তু যদি বোলারের হাতে থাকে ব্যাট আর ব্যাটসম্যানের হাতে বল, তাহলে কেমন হয়? সেটাই হলো, সিডনি টেস্টের শেষ দিনের শেষ ওভারে।

কম আলোর জন্যে ফাস্ট বোলারদের দিয়ে বল করানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় নাথান লিওঁর সাথে জুটি বেঁধে শেষ চার ওভারের খেলায় বল করতে এলেন বহুদিন বাদে – হ্যাঁ, বর্তমান খেলোয়াড়দের মধ্যে টেস্টের সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড়ের মালিক, স্টিভ স্মিথ। অন্যদিকে জিমি অ্যান্ডারসনকে খেলতে হবে ছয়টি বল।

আজকে তাদের ভূমিকাটা একদম উল্টো। সেরা ব্যাটসম্যানকে বল হাতে আউট করতে হবে সেরা বোলারকে। হাতে ছটি বল। ঘিরে ধরেছেন নয়জন ফিল্ডার।

একেকটি বল জিমি ডিফেন্ড করছেন, চারদিক থেকে উহহ আহহ আওয়াজ। তিন বলের পরে একটু সময় নেওয়া হলো, যাতে জিমির উপরে ম্যাচ বাঁচানোর চাপটা আরেকটু জাঁকিয়ে বসে। আবার স্টিভ স্মিথ রান আপে গেলেন। আরো বাকি তিনটি বল।

বেন স্টোকস আর দেখতে পারছিলেন না। বার বার হাত বা টি শার্ট দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলছিলেন আবার বল হয়ে যাবার পরে মুখ তুলছিলেন। আগে তিন উইকেট পড়ে যাবার পরে নেমে খেলেছেন একটা ম্যাচ বাঁচানো ৬০ রানের ইনিংস, কিন্তু কাজ শেষ করে আসতে পারেন নি। লিওঁর বলে স্লিপে ওয়ার্নারের হাতে ধরা পড়ে তাঁর সাংঘাতিক হতাশার প্রতিক্রিয়া বহুদিন মনে থাকবে।

মনে কি পড়ছিল হেডিংলি? একটাই জীবন, একটাই হেডিংলি, একটাই জ্যাক লিচের সাথে ঘটনাবহুল পার্টনারশিপ! কিন্তু আজকে তো তা হবার ছিলনা।

প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান বেয়ারস্টো যখন ১০৫ বলে ধৈর্যশীল ৪১ করে বোলান্ড এর বলে সিলি পয়েন্টে ধরা পড়লেন, তখনও প্রায় ১১ ওভার খেলা বাকি। সদ্য নতুন বল নেওয়া অস্ট্রেলিয়া ফুটছে। কোনো প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যান নেই, হাতে মাত্র দু’উইকেট যা বাঁচাতে হবে লিচ, ব্রড আর অ্যান্ডারসনকে নিয়ে।

অন্যদিকে প্যাট কামিন্স, স্টার্ক আর বোল্যান্ড আগুন ঝরাচ্ছেন নতুন বলে। কিন্তু রুখে দাঁড়ালেন জ্যাক লিচ, আবারও। ব্রডের সঙ্গে ৩৩ রানের অমূল্য পার্টনারশিপে কাটিয়ে দিলেন আরো ৯ টি ওভার। ৩৪ বলে ২৬ টা তখন বড়ো কথা নয়।

কিন্তু শেষবেলায় যখন ফাস্ট বোলারের বল করা নিষিদ্ধ হওয়ায় বল তুলে নিয়েছেন স্পিনার হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করে সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠা স্টিভ স্মিথ, বাকি মাত্র ২ ওভার, তখন স্মিথের তৃতীয় ওভারের শেষ বলে ধরা পড়ে গেলেন স্লিপে।

এরপর ব্রড কাটিয়ে দিয়েছেন লিওনের ছটি বল। এবারে স্মিথের শেষ ওভারে ইংল্যান্ডের ভাগ্য চল্লিশ ছুঁই ছুঁই জিমির হাতে।

হ্যাঁ, শেষ তিনটি বলেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে চারিদিকে দশজন ফিল্ডার কে নজরে রেখে ঠুকে ঠুকে কাটিয়ে দিলেন জিমি। অস্ট্রেলিয়া হয়তো চোদ্দো বছর আগের সিডনিতে শেষ মুহূর্তে মাইকেল ক্লার্কের হিরো হয়ে যাওয়ার পুনরাবৃত্তি আশা করেছিল, কেননা শেষ মুহূর্তেও ড্র বা হারের মুখ থেকে জয় ছিনিয়ে আনতে অভ্যস্ত তারা।

কিন্তু হল না। স্টিভ স্মিথ পারলেন না সবচেয়ে বড়ো বোলার কিন্তু দুর্বলতম ব্যাটার হিসেবে পরিচিত জেমস অ্যান্ডারসনকে আউট করতে। পাঁচদিনের ধুন্ধুমার লড়াইয়ের পরে সমান-সমান সম্মান নিয়ে হাত মেলাতে হলো যুযুধান দুই প্রতিপক্ষকে।
সেই অ্যাশেজ! সেই রোমাঞ্চ!

কে বলে টেস্ট ক্রিকেট বিরক্তিকর!

পর পর দু বছর সিডনির পিংক টেস্টের পরিণতি হলো দুটো পাঁচদিনের মরণপণ লড়াইয়ের পরে ড্র। গতবার ভারত চোট আঘাতে জর্জরিত হয়ে একটি ছেঁড়া হ্যামস্ট্রিং, একটি ব্যথাময় কোমর ও ড্রেসিং রুমে অপেক্ষা করা একটি ভেঙে যাওয়া বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ৪০ ওভার খেলে সিডনি টেস্ট ড্র করে। সেটাও ছিল এক অলৌকিক অ্যাচিভমেন্ট।

সিডনিতে পিংক টেস্ট মানে কিন্তু পিংক বল টেস্ট না। গ্লেন ম্যাকগ্রার প্রথম স্ত্রী জেন, ক্যান্সারে মারা যাবার পরে গ্লেন গড়ে তোলেন এক ক্যান্সার ফাউন্ডেশন। ২০০৮ সাল থেকে প্রতি বছর সিডনিতে টেস্ট ম্যাচ থেকে এই ফাউন্ডেশনের জন্য টাকা তোলা হয়, ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার উন্নতির জন্যে।

এই টেস্টে অস্ট্রেলিয়া সাদা পোশাকে খেললেও খেলোয়াড়দের নাম ও জার্সি নম্বর সবুজের বদলে গোলাপী রঙে লেখা থাকে। গোটা স্টেডিয়ামও সেজে ওঠে গোলাপী রঙে। আজকে শেষ হওয়া টেস্ট ম্যাচের তৃতীয় দিন অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড দু দলের খেলোয়াড়রা গোলাপী টুপি পরে খেলেন, ‘জেন ম্যাকগ্রা’ দিনটিকে মান্যতা দেবার জন্যে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link