ইডেন গার্ডেন্স। অনেকের মতে ‘রোমের কোলোসিয়ামকে ক্রিকেটের উত্তর’। প্রায় দেড়লাখি এই মাঠ এখন আগের থেকে বদলে গেছে অনেকটাই। বাবা কাকার মুখে শোনা ইডেন গার্ডেন্সের বর্ণনা এবং নিজের চোখে এবং চেখে দেখা ইডেনের ফারাক বিস্তর।
কিন্তু, ওই ক্রিকেট রোমান্টিসিজম টা বোধহয় ভারতের আর কোনো মাঠে ততটা নেই, যতটা ইডেনে আছে। তা সে যতই ব্র্যাবোর্ন, ওয়ানখেড়ে, চিপক স্বমহিমায় বিরাজ করুক। বা যতই নতুন ভাবে সজ্জিত মোতেরা ভারতের শ্রেষ্ঠ ও বৃহত্তম মাঠ হয়ে আবির্ভূত হোক। জানিনা এই একচোখোমি কিছুটা বাঙালি হবার সৌজন্যেও কিনা।
এমিলি ইডেনের নামে নামাঙ্কিত এই ঐতিহ্যমন্ডিত মাঠ নিয়ে আজ একটু চর্বিত-চর্বন করতে মন চাইছে। আসলে শীতের আমেজ, নতুন গুড়, পৌষ মেলার মাসটায় বাঙালির আরেকটি আকর্ষণ তো হাইকোর্টের উল্টো দিকে, গঙ্গার ধারের মাঠটিই।
আমার প্রথম ইডেন যাওয়ার গল্পটা বেশ মজার। এর আগে বারকয়েক ইডেন যাবার উপক্রম করেও, শেষ অব্দি আর যাওয়া হয়নি। সেটা ২০০৯ এর ডিসেম্বর মাস। শ্রীলঙ্কা এসেছে ভারতে খেলতে। ইডেন সেবার ২০১১ বিশ্বকাপের উপযুক্ত হয়ে ওঠার লক্ষে অর্ধভগ্ন অবস্থায়। তখনও প্লাস্টিকের চেয়ার হয়নি।
সিমেন্টের চাতালই ছিল। সেবার সাধারণের জন্যে টিকিট প্রায় নেই। ওই সব সদস্য ও ক্লাবের লোকেদের। তবুও মা কিভাবে জানি দুটি টিকিট জোগাড় করে আনলো। ডি-ব্লকে। একেবারে ম্যানুয়াল স্কোরবোর্ডের পাশেই। আমি আর বাবা যাবো। যাঁরা ইডেন গেছেন এবং ডি ব্লকের একেবারে টঙে বসেছেন, তাঁরা জানবেন ওখান থেকে খেলোয়াড়দের এক্কেবারে পুচকি দেখায়।
কিন্তু, ম্যানুয়াল স্কোরবোর্ডের একেবারে পাশে বসায়, ওখানে একইসাথে টিভিতেও খেলাটা দেখা যায়। লাইভ টিভিতেও যে খেলাটা মিনিটদেড়েক দেরি করে আসে, সেটা ওই প্রথম বার জেনেছিলাম। শ্রীলংকা ইনিংসের একেবারে শেষের দিকে একবার আলো নিভে যায়। ইডেনে তখন প্রায়ই এরকমটা হতো।
সেই ম্যাচটি হয়তো এখন অনেকেরই মনে নেই। কিন্তু সেটিই ছিল বিরাট কোহলির ৭০টি সেঞ্চুরির প্রথম সেঞ্চুরি। শ্রীলংকা প্রায় ৩২০ মতো করে দেয়। উপুল থারাঙ্গা সেঞ্চুরি করেন। সচিন সেহওয়াগ তাড়াতাড়ি আউট হয়ে যাবার পর ভারতকে টানেন গম্ভীর ও কোহলি। গম্ভীর ১৫০ করেন। এবং এখনও মনে আছে, ম্যাচের সেরার পুরস্কারটা কোহলিকে দিয়ে যান।
এরপর ইডেন যাওয়া ২০১০ সালের একটি আইপিএল ম্যাচে। বেঙ্গালুরু বনাম কে.কে.আর। সৌরভের ডেল স্টেইন কে মারা কভারের ওপর দিয়ে একটি ছক্কা ছাড়া আর সেরকম কোনো স্মৃতি সেই ম্যাচের নেই। প্রথম টেস্ট দেখা ২০১২ সালে। টেস্ট ম্যাচের টিকিট তখন খুব সহজে পাওয়া যায়।
সেরকম কাড়াকাড়ি, যার জন্যে ২০০৪-০৫ ও ২০০৭ এর টেস্ট ম্যাচ গুলো যাওয়া হয়নি। দিনটি ছিল শনিবার, ম্যাচের চতুর্থ দিন। ইংল্যান্ডের সাথে টেস্ট। প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ড বিশাল লিড নিয়েছে শ’দুয়েক রানের। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতেই শেবাগ-গম্ভীর যা শুরু করলেন তাতে মনে হচ্ছিলো ওই দুশো রান কম হয়ে গেছে।
আরো শ’খানেক আরামসে করে দেবেন এঁরা দুজনেই। সেবার মা কে নিয়ে ইডেন যাই। মায়েরও ওটাই প্রথম ইডেন যাত্রা। সেবার বসেছিলাম ঠিক কাঁচের কর্পোরেট বক্সের ঠিক নিচেটায়। ওখানে বার্মি-আর্মির বেশ কিছু সদস্য ছিলেন। লাঞ্চের পর গুছিয়ে বসলাম। শেবাগ-গম্ভীর ঝড় দেখতে হবে তো।
কিন্তু, বদলে দেখলাম সোয়ান, পানেসারের ঘূর্ণি ঝড়, অ্যান্ডারসনের রিভার্স সুইং ও বার্মি আর্মির নাচগান। অশ্বিন সেদিন যা একটু খেলেছিলেন। মনে আছে, আমাদের সামনে এক ভদ্রলোক বসেছিলেন যিনি শচীন আউট হবার পর ক্রমাগত বলে যাচ্ছিলেন, ‘এবার রিটায়ার কর রে’। এই আবেগ ইডেন ছাড়া আর কোন মাঠে পাওয়া যায় জানা নেই। অবশ্য বাকি কোনো মাঠে বসে খেলা দেখার সৌভাগ্যও হয়নি এই অধমের।
এরপর টেস্ট ম্যাচ ২০১৬ সালে নিউজিল্যান্ড টেস্ট। তিরিশে সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া টেস্টের প্রথম দিন। সেদিন ইডেন এতটাই ফাঁকা ছিল যে দিব্যি ছাতা, জলের বোতল ইত্যাদি নিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম। এবং মাঝ দুপুরের পর আমার শেড বিহীন চেয়ার ছেড়ে কয়েক ধাপ ওপরে শেডের তলায় আশ্রয় নিতে হয়। এতো রোদ। সেদিন মহালয়া হওয়া সত্ত্বেও মাঠ এতো ফাঁকা কেন ছিল বুঝিনি।
তবে, ২০১৬ সালেই মার্চ মাসে গেছিলাম ভারত-পাক টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখতে একেবারে ভরা ইডেনে। আমি আর আমার এক বন্ধু। কিন্তু দুজনের টিকিট আলাদা ব্লকে। অনেক চেষ্টা করেও কারুর সাথে অদল-বদল করা যায়নি। টিকিটটাই পেয়েছিলাম অনেক কষ্টে। সেবার ইডেন থেকে ফেরার পথে বাসে এমন ভিড় হয় যে প্রাণ হাতে করে ফেরা ছাড়া উপায় ছিল না।
কিন্তু, হঠাৎ এসপ্ল্যানেড মেট্রোর খোলা দরজা দেখেই দুজনে পড়িমরি দৌড়। মেট্রোয় অনেক ভিড় দেখেছি। কিন্তু বার পাঁচেক চেষ্টা করেও দরজা বন্ধ হচ্ছে না, এটা সেই একবারই দেখা। কিন্তু ইডেন ফেরত খুশি জনতাকে সেবার ‘নিজের পায়ে দাঁড়ান’ এর বদলে, ‘দাদা, একটু কষ্ট করে নিন। হাজার হোক জিতিয়ে তো ফিরলাম।’ বলতে শুনেছিলাম।
এরপর চাকরি বাকরি ইত্যাদির ফলে কলকাতা ছাড়া বেশ কিছুদিন। ইডেনেও যাইনি। গোলাপি টেস্ট টাও মিস হয়ে যায়। কিন্তু ইডেনের সেই উন্মাদনা আর মুহূর্ত গুলো যেন ছবির মতো স্পষ্ট। তারিণীখুড়োর গল্পের সেই হ্যাপি বয় আইসক্রিম, কাঠের বেঞ্চি আর উল বোনার ইডেন ।
বাবার মুখে শোনা গাভাস্কারকে দেখতে ১৫০ কিমি দূর থেকে এসে ১৯৮৩ সালের টেস্টে একটি বলের জন্যেও ‘গুরুর’ ব্যাটিং না দেখতে পারার কষ্টের ইডেন। মুশতাক আলীর বাদ যাওয়ায় বিক্ষুব্ধ ইডেন, সৌরভ বাদ যাওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে সমর্থন করা ইডেন। আগুন লাগার ইডেন। আনন্দের মশাল জ্বলার ইডেন। ২০১১র ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট ম্যাচের শুরুতে ৮২ জন দর্শকের ইডেন। যান্ত্রিক যুগেও ক্রিকেট রোমান্টিসিজমের আঁতুরঘর-আমার ইডেন।