ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) ১৪ তম আসরে চড়া মূল্যে বিক্রি হয়ে যেনো আলোচনা-সমালোচনার ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিলেন প্রোটিয়া অলরাউন্ডার ক্রিস মরিস। ডেথ ওভার স্পেশালিষ্ট আর লোয়ার-মিডল অর্ডারে আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের জন্যই বেশ পরিচিত মরিস। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পারফরম্যান্সের বিচারে বেশ সাদামাটা একজনই তিনি। ট্যালেন্টেড তকমা নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এলেও সেটির ছিটেফোঁটাও দেখাতে পারেননি এই অলরাউন্ডার। ইনজুরি আর অধারাবাহিকতায় ক্যারিয়ারে পাড়ি দিতে পারেননি লম্বা পথ।
জন্ম ৩০ এপ্রিল, ১৯৮৭। স্কুল জীবন থেকেই ক্রিকেটে মননোনিবেশ করেন মরিস। স্কুল ক্রিকেট থেকেই উঠে আসেন প্রোফেশনাল ক্রিকেটে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেছেন খানিকটা দেরীতেই। ২২ বছর বয়সে ২০০৯ সালে নর্থ ওয়েস্টের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন মরিস। বাবা উইলিও ছিলেন একজন ক্রিকেটার। নর্দান ট্রান্সভালের হয়ে খেলেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেকের পর থেকেই বেশ দাপুটে পারফরম করছিলেন মরিস। বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবেই পেয়েছিলেন পরিচিতি।
২০১১-১২ মৌসুমে ঘরোয়া ক্রিকেট টি-টোয়েন্টিতে ১২.৬৬ গড়ে ২১ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হন তিনি। পরের বছর ২০১২ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগে লায়ন্সকে ফাইনালে তুলেন তিনি। ওই বছরই ডারবানে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে অভিষিক্ত হন তিনি। অভিষেকেই ১৯ রানে শিকার করেন ২ উইকেট। পরের বছর ২০১৩ সালে আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে দল পান মরিস।
পরবর্তীতে ২০১৩ আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির স্কোয়াডে ডাক পান তিনি। এরপর পাকিস্তানের বিপক্ষে এজবাস্টনে ওয়ানডেতে অভিষিক্ত হন মরিস। অভিষেকেই ২৫ রানে ২ উইকেট শিকার করেন এই পেসার। ওই টুর্নামেন্টে তিন ম্যাচে বেশ ইকোনোমিক বোলিং করেন তিনি। পরের সিরিজেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই ম্যাচে আশানুরূপ সাফল্য পাননি তিনি। এরপর পায়ের গোড়ালির ইনজুরিতে দেড় বছর তিনি ছিলেন দলের বাইরে।
২০১৫ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে আবারো দলে ফিরেন তিনি। সেখানেও বল হাতে নিজের সেরাটা দিতে পারেননি মরিস। এরপর ভারতের বিপক্ষে সিরিজেও ২ টি-টোয়েন্টি আর ১ ওয়ানডেতে সুযোগ পান তিনি। তবে বল হাতে মরিস ছিলেন অনেকটাই সাদামাটা, আর ব্যাট হাতে নিজেকে প্রমাণের যথাযথ সুযোগও পাচ্ছিলেননা।
এরপর ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজেও বল হাতে যাচ্ছেতাই পারফরম্যান্স করেন মরিস। তবে ব্যাট হাতে ওই সিরিজে ৩৮ বলে ৬২ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস উপহার দেন তিনি। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে সেটিই ছিলো মরিসের একমাত্র ফিফটি। ওই সিরিজেই টেস্টে অভিষিক্ত হন এই পেস অলরাউন্ডার!
আর নিজের অভিষেক ইনিংসেই খেলেন ৬৯ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। ওই সিরিজে ২ টেস্টে ইনিংস প্রতি মাত্র ১ উইকেট করে মোট ৪ উইকেট পান মরিস। পরের সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বল হাতে জ্বলে না উঠতে পারলেও ব্যাট হাতে ২৬ বলে ৪০ রানের অসাধারণ এক ক্যামিও খেলেন তিনি।
টি-টোয়েন্টিতেও পারছিলেন না নিজেকে প্রমাণ করতে। ওই বছর ৭ ম্যাচে ৯.১২ ইকোনমিতে মাত্র ৯ উইকেট শিকার করেন তিনি! তবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২৭ রানে ক্যারিয়ার সেরা ৪ উইকেট নিয়েছিলেন মরিস।
পরের বছর ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঘরের মাটিতে দুর্দান্ত বোলিং করেন মরিস। ওই সিরিজের পঞ্চম ম্যাচে মাত্র ৩১ রানে ক্যারিয়ার সেরা ৪ উইকেট নেন তিনি। ঠিক পরের সিরিজেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই ৬২ রানে শিকার করেন ৪ উইকেট। অবশ্য ওই সিরিজের বাকি ম্যাচগুলোতে ছিলেন বেশ খরুচে!
ওই বছর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান মরিস। টি-টোয়েন্টিতে মাত্র ৩ ম্যাচে সুযোগ পেলেও ১১ ওভারে ৪.৭৩ ইকোনমিতে নেন ৫ উইকেট! টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে আবারো কামব্যাক করেন তিনি।
প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৩৮ রানে ৩ উইকেটের পর দ্বিতীয় ইনিংসে নেন ২ উইকেট। পরের টেস্টে ২ ইনিংস মিলিয়ে ৩ উইকেট নেন মরিস। ২ টেস্টে ৮ উইকেট শিকারের পরেও টেস্ট ক্যারিয়ারের যাত্রাটা শেষ সেখানেই। ক্যারিয়ারে চার টেস্টের সবক’টি খেলেছেন ইংলিশদের বিপক্ষে। সাদা পোশাকে মরিসের শুরু এবং শেষটা ছিলো ইংলিশদের বিপক্ষে!
২০১৮ সালে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি দুই ফরম্যাটেই খেলেছেন মোটে ৫ টি করে ম্যাচ। বল কিংবা ব্যাট হাতে ছিলেন একেবারেই নিষ্প্রভ। জাতীয় দলে তখন অধারাবাহিক এক মুখ মরিস। বাজে পারফরম্যান্সের কারণে ওয়ানডে দল থেকেও বাদ পড়েন তিনি।
তবে ঘরোয়া ক্রিকেটের পাশাপাশি খেলতেন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট। এরপর ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে সুযোগ পান মরিস। ৮ ম্যাচে ১৩ উইকেটও শিকার করেন। এরপরই তিনি আনঅফিসিয়ালি জানিয়েছিলেন জাতীয় দলে তাঁর ক্যারিয়ারটা শেষ। দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটের (সিএ) বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর ফিরছেন না এমনটাই জানিয়েছিলেন।
২০১৩ আসর থেকে আইপিএলে খেললেও খুব নজরকাঁড়া পারফরম্যান্স দেখাতে পারেননি মরিস। ২০২০ আইপিএলে ৯ ম্যাচে ৬.৬৩ ইকোনমিতে ১১ উইকেটই ছিলো তার ক্যারিয়ারের সেরা মৌসুম। এছাড়া ২০১৬ আইপিএলে দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের হয়ে ১৩ উইকেট শিকার করেন; যা দলের হয়ে সেবার সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি।
তবে সবশেষ ২০২১ আসরে ১৬ কোটি ২৫ লাখ রুপিতে রাজস্থান রয়্যালসে দল পাওয়ার পরই তিনি ভিন্নভাবে আসেন সমালোচনায়। জাতীয় দলে অধারাবাহিক আর আহামরি কোনো পারফরম ছাড়াই চড়া মূল্য পাওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। তবে ১১ ম্যাচে ব্যাট হাতে মাত্র ১৩ গড়ে ৬৭ রান আর বল হাতে ৯.১৭ ইকোনমিতে ১৫ উইকেট শিকারের পর যেনো আইপিএলে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আরো প্রশ্ন উঠে।
৪ টেস্টে নিয়েছেন ১২ উইকেট। ৪২ ওয়ানডেতে ৫.৫৬ ইকোনোমিতে আছে ৪৮ উইকেট। এছাড়া ২৩ টি-টোয়েন্টিতে ৮.৩৯ ইকোনমিতে নিয়েছেন ৩৪ উইকেট। ঘরোয়া ক্রিকেটে ৩৯৪ ম্যাচে নিজের ঝুলিতে নিয়েছেন ৬১২ উইকেট। ব্যাট হাতে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৩ ফিফটিতে করেছেন সাতশোর বেশি রান। আইপিএলে ৮১ ম্যাচে ২ ফিফটিতে ১৫৫ স্ট্রাইক রেটে ৬১৮ রান আর বল হাতে নিয়েছেন ৮ ইকোনমিতে ৯৫ উইকেট।
আইপিএল ছাড়াও বিগব্যাশ, কাউন্টি ক্রিকেট, পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল), ক্যারিবিয়ান লিগ (সিপিএল) ছাড়াও বিভিন্ন টি-টোয়েন্টি লিগে খেলেছেন এই অলরাউন্ডার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নয়, বরং ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের ক্ষণিকের হটকেক হয়েই তিনি টিকে রইবেন ক্রিকেটের ইতিহাসের পাতায়।