অজি বীরত্বের সোনালি বালক

১.

বাউন্সি পিচে ব্যাট করছেন এক অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান। একের পর এক বাউন্সার তাঁর দিকে ছোড়া হচ্ছে আর তিনিও মনের আনন্দে পুল বা হুক করছেন। আউট হওয়া নিয়ে মোটেও কোনো চিন্তা নেই।

২.

আবারও পেসারের মোকাবেলা হচ্ছে। এবার ব্যাটসম্যান ডাউন দ্য উইকেটে এসে একেবারে স্ট্রেইট ড্রাইভ করছেন বা লফটেড শট।এবারের ব্যাটসম্যানও অস্ট্রেলিয়ান।

৩.

মিড অফ দিয়ে একের পর এক কাভার ড্রাইভ করছে ডানহাতি এক অজি। মাঝেমধ্যে লেইট কাট করছেন মনের খোরাকে। এক-দু পা সামনে এগিয়ে স্পিনকে মনের ইচ্ছানুযায়ী হয়তো মিড অনের দিকে নতুবা মিড অফে বা বোলারের মাথার উপর দিয়ে মারছেন।

৪.

ম্যাচের শুরু থেকেই আগ্রাসী ব্যাটিং করে যাচ্ছেন বোলার কে তা বিবেচনাতেও নেই। এই ব্যাটসম্যানও অস্ট্রেলিয়ান।
উপরে চারজন ব্যাটসম্যানের পছন্দের শট কিংবা ব্যাটিং স্টাইল নিয়ে একটু করে লিখলাম।উত্তরগুলাও বলে দিচ্ছি আমি।যদিও এরা কেউই আসল উত্তর নয় – রিকি পন্টিং, ম্যাথু হেইডেন, ডেমিয়ান মার্টিন, মার্ক ওয়াহ কিংবা,অ্যাডাম গিলক্রিস্ট।

যাদের কথা বললাম, পারতপক্ষে এদের কথাই মাথায় আসে। অন্তত আমার মাথায় আসে শুরুতে বলা ঘটনার সাথে। কিন্তু না আমি মোটেও এদের কারও কথা বলিনি। যে চারটি দৃশ্যের কথা বলেছি সবগুলোই একজনের মধ্যেই ছিল। তবে পন্টিং-হেইডেনদের সাথে মিল একটাই, তিনিও অজি ক্রিকেটার।

অনেকেই এখনও বুঝতে পারেননি কার কথা আমি বলছি। আসলে সবাই ওকে ভুলে গিয়েছে, ভুলে যায়। যার থাকার কথা ছিল ব্র্যাডম্যান-পন্টিং-গ্রেগ চ্যাপেল-বোর্ডার-স্টিভ ওয়াহদের কাতারে কিন্তু সে রয়েছে শুধু কিছু রোমান্টিকদের অলস মস্তিষ্কে।

ভিভ রিচার্ডসের ছিল উদ্যম আর মনের জোর, গ্রেগ চ্যাপেলের ছিল চারুত্ব বা সৌন্দর্য্য আর ডেভিড গাওয়ারের সিল্কি বাটারফ্লাইয়ের মত সফট টাইমিং। কিন্তু খুব ছোট একটা পিরিয়ডের জন্য কারও খেলাই এত রোমাঞ্চকর কিংবা ব্যাকরণগতভাবে বিশুদ্ধ ছিল না যেমনটা ছিল কিমবার্লি জোন্স হিউজের। এক হাঁটুর উপর বসে কিম হিউজের কাভার ড্রাইভ ছিল ক্রিকেটের সবচেয়ে সুন্দর শট।

অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গারের বয়স তখন মাত্র ১০। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ব্যাট করছে হিউজ আর গ্যালারিতে ল্যাঙ্গার। হিউজের ওই বিশেষ কাভার ড্রাইভ শুধু মনে না মাথায়ও গেঁথে গেল তার। এরপর সেই বয়স থেকে শুরু করে একবারও পারেননি এক শটের জন্যও হিউজ হতে।

কিম হিউজকে নিয়ে লেখা বই ‘গোল্ডেন বয়’ ক্রিকেট নিয়ে লেখা অন্যতম সেরা বই। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটকে বদলে দেয়া সময়ও বলা চলে যেই সময়কে কেন্দ্র করে লিখা হয়েছে এই বই। বদলে দেয়া বললে অনেকেই ভ্রু কুচকাতে পারেন কিন্তু কথা সত্যি। কিম হিউজের পরে অস্ট্রেলিয়ায় অধিনায়ক হয় অ্যালান বোর্ডার, যার হাত ধরে আসে সংক্ষিপ্ত ক্রিকেটে অজিদের প্রথম বিশ্বকাপ।

বোর্ডার একনিষ্ঠ সমর্থন পেয়েছিল বোর্ড থেকে। আর সেটাই অজি ক্রিকেট দলের আধিপত্যের অন্যতম কারণ। এর সাথে কিম হিউজের সম্পর্ক হল সে ছিল অনেকটা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মত, যুগ-সন্ধিক্ষণের কবি (পড়ুন অধিনায়ক)। সেদিকে আমি যাচ্ছি না। আগ্রহী পাঠক গোল্ডেন বয় অথবা কিম হিউজের অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কত্ব নিয়ে পড়ে দেখুন।

আমার একটা বাজে অভ্যাস আছে। রাতের বেলা ঘুম না আসলে আমি ইউটিউবে আগের যুগের ক্রিকেট দেখি। বিশেষ করে ৭০-৮০ দশকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর অ্যাশেজ। এভাবে একরাতে আবিষ্কার করলাম কিম হিউজকে। অ্যান্ডি রবার্টসকে ছক্কা মারলেন। ওই একটা শটেই তাঁর ব্যাটিংয়ের প্রেমে পড়ে গেলাম।

এরপর দেখলাম ভারতের বিরুদ্ধে করা একটা ডাবল সেঞ্চুরির ইনিংস। কপিল দেবের সুইঙ্গি ডেলিভারিগুলাকে অনায়াসে কাভার ড্রাইভ করছে। স্পিনারদের ১-২ পা এগিয়ে মারছেন মাঠের যে কোনে ইচ্ছা। বাউন্সে পুল শট খেলছেন একেবারে মনের আনন্দে। কাভার ড্রাইভের মত পুলশটেও হিউজ ছিলেন দুর্দান্ত। পন্টিং-ভন থেকেও ভাল।

ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে একবার সেঞ্চুরি করেছিলেন যেখানে বাকি কেউ করতে পারেনি ২১ এর বেশি। ওই ম্যাচে হিউজ খেলেছিলেন কিছু অসাধারণ লেইট কাট শট। চোখ জুড়ানো লেইট কাট। টেস্ট ক্রিকেটের শততম ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছিলেন লর্ডসে।সেটাও ছিল দেখার মত ব্যাটিং। ভিডিও ছেড়ে সিদ্ধান্ত নিলাম বই পড়ার।

গুটি গুটি পায়ে পড়েও ফেললাম। হিউজকে যেভাবে সব সময় অপদস্ত করেছে লিলি-মার্শ-হগ ত্রয়ী ব্যাপারটা ভীষণ কষ্টের। গ্রেগ চ্যাপেলও যোগ দিত আর ইয়ান চ্যাপেল করত তুমুল সমালোচনা। গোল্ডেন বইতে খুব চমৎকারভাবে এসব তুলে ধরা হয়েছে। বইটা সকল ক্রিকেট ভক্তদের পড়া উচিত।

হিউজের ব্যাটিং নিয়ে আমি শুরুতেই বলেছি। ছেলেটা বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। মাত্র ১৫ বছরে ডাক পেয়েছিলেন রাজ্যদলে। হিউজের তখনকার কোচ ফ্র্যাংক প্যারি হিউজকে সব সময় বলতেন যে তুমি শুধু ব্যাটিং দিয়ে নয় অধিনায়ক হিসেবেও অজিদের প্রতিনিধিত্ব করবে। ব্যাপারটা হিউজকে তখন থেকেই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। অজিদের ইতিহাসের সবচেয়ে ট্যালেন্টেড ব্যাটসম্যান হিউজ সেই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

মানুষ হিসেবেও সে ছিল নরম মনের,আবেগী। একের পর এক ব্যর্থতার পরে দলের অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিতে এসে নিজের পদত্যাগপত্র পড়তে পারলেন না, কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কিমের সেই অশ্রুভেজা ছবি জায়গা করে আছে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট ফোকলোরে। ২৬ জানুয়ারি এই গোল্ডেন বয়ের জন্ম। সেদিনই আবার জাতীয় অস্ট্রেলিয়া দিবস। নাহ, বেশ ভাল একটা কাকতালীয় ব্যাপার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link