ট্যাকটিকের রাজা, কথার রাজা

সাফল্য আর বিতর্ক - দুটো জিনিসই যেন হোসে মরিনহোর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কখনো সাফল্য এসে লুটিয়ে পড়েছে, আবার কখনো নিজেকে স্পেশাল ওয়ান ঘোষণা দিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। মোদ্দাকথা যে দেশেই গিয়েছেন, মরিনহো ছিলেন টক অফ দ্য টাউন।

সাফল্য আর বিতর্ক – দুটো জিনিসই যেন হোসে মরিনহোর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কখনো সাফল্য এসে লুটিয়ে পড়েছে, আবার কখনো নিজেকে স্পেশাল ওয়ান ঘোষণা দিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। মোদ্দাকথা যে দেশেই গিয়েছেন, মরিনহো ছিলেন টক অফ দ্য টাউন। সংবাদকর্মীরা রীতিমতো মুখিয়ে থাকতেন মরিনহোর সংবাদ সম্মেলন কাভার করার জন্য। আসুন দেখে নেয়া যাক মরিনহোর মজার কিছু সংবাদ সম্মেলনের ঘটনা।

  • শ’র শরীর, আমার বুদ্ধি

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কোচ থাকাকালীন ওল্ড ট্রাফোর্ডে এক ম্যাচে এভারটনের সাথে ১-১ গোলে ড্র করার পর এই মন্তব্য করেছিলেন দ্য স্পেশাল ওয়ান। ডাগআউট থেকে দেয়া তার নির্দেশের জন্যই নাকি ভালো খেলেছিলেন ২১ বছর বয়সী ইংলিশ লেফটব্যাক।

মরিনহো বলেন, ‘শ নি:সন্দেহে ভালো খেলেছে। মাঠে সে খেললেও মাথাটা ছিল আমার। মাঠের সকল সিদ্ধান্ত তার হয়ে আমিই নিচ্ছিলাম। কখন চার্জ করতে হবে, কখন প্রেস করতে হবে, কোথায় থাকা লাগবে- সবকিছু আমিই ঠিক করছিলাম।’

এরপর শ আর মরিনহোর সম্পর্ক রূপ নেয় তিক্ততায়। মরিনহো ইউনাইটেড ছাড়ার পরও থামেননি। গত ইউরোতেও শ’র নেয়া কর্নার ‘অত্যন্ত বাজে’ বলে মন্তব্য করেন মরিনহো। ক্রমাগত এই ধরনের মন্তব্য শোনার পর ত্যক্তবিরক্ত লুক শ গণমাধ্যমে বলেন, ‘বারবার আমার সম্পর্কে তার মন্তব্য আমার অদ্ভুত লাগে। সতীর্থরাও আমাকে জিজ্ঞেস করে, তার সমস্যাটা কি এবং সে কেন এসব করছে। তার মুভ অন করা উচিত।’

  • শুভ সকাল, ক্লাওডিও

ইন্টার মিলানের কোচ থাকাকালীন সময়ে মরিনহো প্রায়ই সংবাদ সম্মেলনে আসতেন না। এই নিয়ে তৎকালীন জুভেন্টাস কোচ ক্লাওডিও রানিয়েরি মন্তব্য করলে তার জবাব দিতে দেরি করেননি মরিনহো।

তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিদিন পাঁচঘণ্টা করে ইতালিয়ান শিখছি যেন খেলোয়াড়, সমর্থক এবং সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা বলতে পারি। রানিয়েরি পাঁচ বছর ইংল্যান্ডে কাজ করার পরও ঠিকমতো গুড মর্নিং, গুড আফটারনুন বলতে পারে না। আমাকে সে পরামর্শ দেয় কি করে?’

  • ফেরারি এবং একটুখানি চিনি

ইন্টারের কোচ থাকাকালীন সময়ে নেরাজ্জুরিদের খেলার স্টাইল নিয়ে প্রায়ই সমালোচনার মুখে পড়তেন মরিনহো। বিশেষ করে তার রক্ষণাত্নক খেলার ধরণে বিরক্ত হতেন সবাই।

তিনি বলেন, ‘একটা রেসে যদি ফেরারি এবং একটা সাধারণ গাড়ি অংশ নেয়। তবে ফেরারিকে হারানোর একমাত্র উপায় হলো হয় গাড়ির হুইল ভেঙে ফেলা নইলে গাড়ির ট্যাংকে এক চামচ চিনি মিশিয়ে দেয়া।’

  • আমার কিছু বলার নেই

মরিনহো তখন দ্বিতীয় মেয়াদে চেলসির দায়িত্বে আছে। ইয়ুর্গেন ক্লপের লিভারপুলের সাথে এক ম্যাচে ৩-১ গোলে হারার পর মরিনহো সংবাদমাধ্যমে কিছুই বলতে চাননি। প্রশ্নকর্তার প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন এভাবে।

প্রশ্নকর্তা : দারুণভাবে ম্যাচটা শুরু করার পরও ৩-১ গোলে হার। কোন সময়টাতে ম্যাচের খেই হারিয়ে ফেলে চেলসি?

মরিনহো: আমার কিছু বলার নেই।

প্রশ্নকর্তা: ম্যাচ নিয়ে কিছুই বলার নেই?

মরিনহো: না, কিচ্ছু না। আমার কোনো কিছুই বলার নেই।

প্রশ্নকর্তা: কস্তার মারামারি নিয়ে?

মরিনহো: আমার কিছুই বলার নেই, আমি দু:খিত। আমার কিছু বলার নেই।

  • শান্ত মরিনহো

মাদ্রিদের হয়ে দায়িত্ব পাবার পর প্রথম ম্যাচে রায়ো ভায়োকানোর বিপক্ষে গোলশূন্য ড্রয়ের পর সংবাদমাধ্যম এবং সমর্থকদের মাঝে গুঞ্জন শুরু হয় মরিনহো বোধহয় ‘মাইডাস টাচ’ হারিয়ে ফেলেছেন।

তিনি বলেন, ‘দেখুন, আমি কোচ। আমি হ্যারি পটার নই। সে ম্যাজিক্যাল, কিন্তু বাস্তবে কোনো ম্যাজিক ঘটে না। ম্যাজিক হলো পরাবাস্তবতা আর ফুটবল হলো বাস্তব।’

পেপের সমস্যা হলো ভারানে

রিয়াল মাদ্রিদে থাকাকালীন সময়ে মরিনহো একবার ইকার ক্যাসিয়াসকে বেঞ্চে রেখে ডিয়েগো লোপেজকে স্টার্ট করানো শুরু করেন। তখন ক্লাবের পুরনো খেলোয়াড় হিসেবে পেপে কোচের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে চান। অন্যদিকে মরিনহো ভেবে বসেন উল্টোটা। তখন ক্লাবে আলো ছড়াচ্ছিলেন সদ্যই দলে আসা তরুণ ফরাসি ডিফেন্ডার রাফায়েল ভারানে।

মরিনহো ভেবেছিলেন সতীর্থের জায়গা হারানো দেখে পেপে সম্ভবত নিজের কথাটা বলবেন, ‘পেপের একটা সমস্যা আছে। সেই সমস্যার নাম হলো রাফায়েল ভারানে। ৩১ বছর বয়স্ক একজনের ১৯ বছরের এক তরুণের কাছে জায়গা হারানো সুখকর কিছু না। সমস্যাটা খুবই সাধারণ। পেপের জীবনটা বদলে গিয়েছে।’

  • কারভালহোর ডাক্তার দেখানো

মরিনহোর কোচিং ক্যারিয়ারে অন্যতম পছন্দের একজন ফুটবলার ছিলেন রিকার্ডো কারভালহো। এতটাই পোর্তো থেকে চেলসিতে আসার সময় বড় অংকের ট্রান্সফার ফি দিয়ে তাকে সাথে নিয়ে এসেছিলেন দ্য স্পেশাল ওয়ান। সেই কারভালহোও রেহাই পাননি মরিনহোর বাক্যবাণ থেকে। ২০০৫-০৬ মৌসুমে উইলিয়াম গালাসের কাছে জায়গা হারালে কারভালহো কিছুটা মনক্ষুণ্ণ হন।

ঘটনাটা মরিনহোর কানে যেতেই জবাব দিতে দেরি করেননি তিনি, ‘রিকার্ডো কারভালহোর সম্ভবত কোনো কিছু বুঝতে না পারার সমস্যা রয়েছে। তার বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা করানো দরকার। পত্রিকার মাধ্যমে আমি যা শুনতে পাচ্ছি তা মোটেই ভালো কিছু নয়। চার বছর আমার সাথে একদলে কাঁটানোর পর এসব কথা বলার কোনো মানেই হয় না। ওর সম্ভবত ডাক্তার দেখানো দরকার।’

  • খারাপ ডিম, বাজে ওমলেট 

২০০৭ সালে চেলসিতে প্রথম দফায় দায়িত্ব পালনের সময় দলের ট্রান্সফার বাজেট নিয়ে কথা উঠলে সংবাদমাধ্যমে এই বিখ্যাত মন্তব্য করেন মরিনহো।

তিনি বলেছিলেন, ‘এটা ডিম আর অমলেটের মতো। ডিম না থাকলে অমলেট হবে না, খারাপ ডিম থেকে বাজে স্বাদের অমলেটই তৈরি হবে। ডিমের মানের উপর নির্ভর করে অমলেটের স্বাদ। সুপারমার্কেটে সব ধরণের ডিমই আছে। আপনি যখন ভালো ডিম রেখে খারাপ ডিম কিনবেন, তখন বুঝতে হবে আপনার মাঝে সমস্যা আছে।’

  • গাধা এবং ঘোড়ারা

২০০০ সালে মরিনহো যখন প্রথমবারের মতো বেনফিকার কোচ হন, ক্লাব কর্মকর্তারা তখন তাঁর সহকারী হিসেবে জেসুয়ালদো ফেরেইরার নাম প্রস্তাব করেন। মরিনহো স্বভাবতই সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং কার্লোস মোজারকে সহকারী হিসেবে নেন। পর্তুগিজ মিডিয়া যখন মরিনহোর সাথে ফেরেইরার তুলনা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তখন আর নিজেকে সামলাতে পারেননি তিনি।

তিনি বলেছিলেন, ‘৩০ বছরের ক্যারিয়ারে একজন (ফেরেইরা) কিছুই জেতেনি, আরেকজন (মরিনহো) তিন বছরেই অনেক কিছু জিতেছে। ৩০ বছরের ক্যারিয়ারে যাকে কেউ কখনো মনে রাখেনি, রাখবেও না। অন্যদিকে তিন বছরের ক্যারিয়ারেই তাকে কখনো ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না।’

‘এটা একটা গাধার গল্প হতে পারে যে কিনা ত্রিশ বছর খেটেছে কিন্তু ঘোড়া হতে পারেনি।’, যোগ করেন তিনি।

  • কখনোই ভুল স্বীকার করো না

টানা প্রিমিয়ার লিগ এবং সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব জিতবার আগে কেভিন ডি ব্রুইনা চেলসিতে ছিলেন। মরিনহোর আমলে খেলার সুযোগ না পেয়ে ভলসবুর্গে পাড়ি জমান এবং সেখানেই আলো ছড়ান। জার্মান ক্লাবটির হয়ে মাত্র ৫০ ম্যাচেই ১৬ গোল এবং ২৮ অ্যাসিস্ট করেন তিনি। মরিনহো তাকে সে সময় ব্লুজদের হয়ে সুযোগ দিলে ব্রুইনা হয়তো নীল জার্সিতেই প্রিমিয়ার লিগ মাতাতেন।

‘ডি ব্রুইনার মতো ফুটবলার যদি প্রতিদিন দল ছাড়ার জন্য মাথা কুটে মরেন, তাহলে আপনাকে একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হবে। সে ছিল দু:খি একটা বাচ্চার মতো যে কিনা বিমর্ষ মুখে ট্রেনিং করতো। সে যদি ভলসবুর্গে না গিয়ে চেলসিতেই থাকতো তাহলে কখনোই এই পর্যায়ে আসতে পারতো না।’, ২০১৫ সালে সংবাদমাধ্যমকে এই কথা বলেছিলেন মরিনহো।

  • ঈশ্বরের প্রিয় পুত্র

২০১১ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ঈশ্বর তাঁকে নিয়ে ভাবেন এবং তার এই পর্যায়ে আসার পেছনে ঈশ্বরের অবদান আছে, ‘তিনি নিশ্চয়ই ভাবেন আমি দারুণ একজন মানুষ। নিশ্চয়ই ভাবেন নচেৎ আমি জীবনে এতকিছু পেতাম না।  আমার সম্পর্কে তিনি অবশ্যই উঁচু মনোভাব পোষণ করেন।’

  • ছোট চাদর

২০০৭ সালে চেলসি যখন ফুটবলারদের নানাবিধ চোটজর্জর অবস্থায় মাঠে ভুগছে, সে সময়টাতে মরিনহো নিয়মিতই চাদরের উদাহরণ দিতেন। তিনি বলেন, ‘এটা অনেকটা বিছানার জন্য ছোট চাদর কেনার মতো। উপরের অংশ ঢাকতে গেলে পায়ের দিকটা বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি বড় চাদর কিনতে পারছি না কারণ সুপারমার্কেট বন্ধ। তবে আমি ভাবছিও না সে নিয়ে, কারণ চাদরটা ভীষণ দামি। এটা সাধারণ কোনো চাদর নয়।’

চাদর নিয়ে এই উদাহরণটা মরিনহো এতটাই পছন্দ করতেন যে ২০২০ সালে টটেনহ্যামের কোচ থাকাকালীন সময়েও ব্যবহার করেন, ‘এটা অনেকটা এরকম, তোমার বিছানায় একটা চাদর আছে। চাদরটা সামনে টানলে পায়ের দিকটা বের হয়ে যাচ্ছে। পা ঢাকতে গেলে উপরের অংশ খালি হয়ে যাচ্ছে।’

  • ফুটবল নয়, হকি খেলা

২০০৪ সালে মরিনহো তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী আর্সেনালের উপর তার বিখ্যাত বাক্যবাণ বর্ষণ করেন। আর্সেনাল তখন সদ্যই টটেনহ্যামের সাথে ৫-৪ গোলের এক হাইস্কোরিং ম্যাচ জিতে ফিরেছে।

মরিনহো বলেন, ‘৫-৪ ফুটবল খেলার স্কোর না, এটা হকির স্কোর।  প্রাকটিসে থ্রি সাইড ম্যাচে কেউ চার গোল হজম করলে তাদেরকে আমি ড্রেসিংরুমে ফেরত পাঠিয়ে দেই। কারণ তারা ডিফেন্ডিং জানে না। এগারোজনের খেলায় এরকম ফলাফল আসা হতাশাজনক।’

মজার ব্যাপার হলো, ২০২০ সালে মরিনহোর টটেনহ্যাম এভারটনের কাছে ৫-৪ গোলে হেরে এফএ কাপ থেকে বিদায় নেয়।

  • চেলসির অধ:পতন

২০১০ সালে চেলসি লুই ফেলিপে স্কলারিকে বরখাস্ত করার পর তৎকালীন ইন্টার মিলান কোচ মরিনহো দাবি করেন স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ থেকে তার বিদায়ের পরই মূলত চেলসির অধ:পতন শুরু হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমি চলে আসার পর থেকেই চেলসি কেন এতটা ভুগছে? কারণ আমি চলে এসেছি।’

  • জুডাস মরিনহো

২০১৮ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কোচ থাকাকালীন সময়ে অলরেডরা এক ম্যাচে চেলসির কাছে ১-০ গোলে হেরে যায়। সমর্থকরা রেগে গিয়ে মরিনহোকে প্রতারক, জুডাস বলে সম্বোধন করতে শুরু করে। এটা শোনার পর মরিনহো ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিলেন।

ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘তারা যা খুশি বলতে পারে। যতদিন না তারা চারবার প্রিমিয়ার লিগজয়ী কাউকে পাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত আমি নাম্বার ওয়ান। যখন তারা তা পেয়ে যাবে, তখন আমি হবো দুই নাম্বার। ততোক্ষণ না পর্যন্ত এই জুডাসই নাম্বার ওয়ান।’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...