পাঁচ ঘণ্টা ২৪ মিনিটের মহাকাব্যিক লড়াইয়ের পর রাফায়েল নাদাল তার র্যাকেটটি এক পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লেন রড লেভার এরিনার শক্ত কৃত্রিম কোর্টের ওপর, যা তাঁর জন্য রবিবার রাতে মমতাময়ী বসুন্ধরার আর্দ্র ভূমির থেকে কোন অংশে কম ছিল না।
কারণ এই জমিই তো তাঁর অতিমানবিক ক্যারিয়ায়ের শ্রেষ্ঠ সাফল্য এলে দিল তাঁর টেনিস সফরের সায়াহ্নে।
কিন্তু সায়াহ্নই বা বলি কী করে? চোট-আঘাত, এবং তারপর কোভিডে জর্জরিত, ৩৫ বছর বয়সী নাদাল এক সময় ভেবেছিলেন আর হয়ত যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাঁর ফেরা হবে না। খেলেননি ইউএস ওপেন, তার আগে ক্লান্তির কারণে উইম্বল্ডনের ঘাসের কোর্টেও নামা হয়নি তাঁর। সম্প্রতি করিয়েছেন সার্জারি। সেই খাদের কিনার থেকে প্রত্যাবর্তন করে, অস্ট্রেলিয় ওপেন জিতে নাদাল প্রমাণ করলেন এভাবেও ফিরে আসা যায়।
আমাদের প্রজন্মের তিন টেনিস নক্ষত্রের শাসন দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। রজার ফেদেরার যদি সেই ত্রয়ীর নিখাদ শিল্পী হন, নোভাক জকোভিচ আদ্যন্ত পারফেকশনিস্ট, তাহলে নাদাল এই দলের আদি ও অকৃত্রিম যোদ্ধা।
এবারের অস্ট্রেলিয় ওপেনের পুরুষ সিংলসের ফাইনালে তিনি ফেভারিট ছিলেন। তাঁর থেকে এক দশকের ছোট, রুশ তারকা দানিল মেদ্ভাদেভ নেক্সট জেন পুরুষ সিংলস প্লেয়ারদের মধ্যে উজ্জ্বলতম হয়ে উঠেছেন বিগত কয়েক মাসে, বিশেষ করে হার্ড কোর্টে।
জোকোভিচকে ইউএস ওপেন ফাইনালে প্রায় হেলায় হারিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এই ফাইনালেও তাই তাঁকেই এগিয়ে রেখেছিলেন বহু পণ্ডিত থেকে সাধারণ ভক্ত। প্রথম সেট অসাধারণ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে জিতে, এবং দ্বিতীয় সেটে ঘায়েল সিংহ নাদালের শক্ত চ্যালেঞ্জ টাই ব্রেকে অতিক্রম করে তিনি কোর্টে উপস্থিত সমস্ত নাদাল সমর্থককে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন।
মেদভেদেভ শুধু তরুণ নন, টেনিস মেধা এবং জেতার আকাঙ্ক্ষায় তিনি প্রায় অদ্বিতীয়। অথচ অস্ট্রেলিয় সমর্থকরা একবারও তাঁর পাশে দাঁড়াননি এবার। আলোকসম নাদালের সামনে তাঁকে একটি প্রায় অন্ধকার শক্তি হিসেবে চিত্রিত করেছিলেন ফাইনালে উপস্থিত ভক্তরা।
বিশ্বের দু’নম্বর তারকা এই অন্যায় চিত্রণে বিরক্ত হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন, হয়ত বা কোথাও গিয়ে তাঁর মনঃসংযোগও হারিয়েছেন, কিন্তু লড়ে গেছেন শেষ অবধি। কিন্ত রবিবার গভীর রাতে রাতে ইচ্ছাশক্তিতে তাঁকেও ছাড়িয়ে চলে গেলেন নাদাল।
যেভাবে প্রথমদিকের ভুলভ্রান্তি পেরিয়ে তিনি বেসলাইন থেকে তীক্ষ্ণ পাসিং শটের অপূর্ব নিদর্শন রাখতে শুরু করলেন, মেদভেদেভের ড্রপ শট কাউন্টার করতে বিদ্যুতের মতন ঝাঁপিয়ে পড়লেন নেটের ওপর্র,লড়াই না সূচাগ্র মেদিনী ছাড়তে রাজি হলেন না প্রতিপক্ষকে, তা কোন ইন্দ্রজালের কম ছিল না। মেদ্ভাদেভ হারার মত খেলেননি, বরং মতান্তরে জেতার মতই খেলেছিলেন। কিন্তু নাদালের অদম্য আকাঙ্ক্ষা, ফিটনেসের নিরবচ্ছিন্ন সাধনা, এবং রন্ধ্রে-রন্ধ্রে বইতে থাকা যোদ্ধার রক্ত তাঁকে পাঁচ সেটের শেষে নিয়ে গেল ফিনিশ লাইনের ওপারে।
অবিশ্বাস্য এই জয়ের ফলে নাদান রেকর্ড ২১ তম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতে তাঁর দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে টপকে গেলেন আপাতত। নাম লেখালেন আরেকটি এলিট ক্লাবে। এর আগে মাত্র তিনজন পুরুষ সব কটি মেজর একের বেশি বার জিতেছিলেন। কিন্তু এসবই নিরস নম্বরের খেলা। সেরা কি শুধু এগুলো দিয়েই বিচার করা যায়?
এক কালের ক্লে কোর্ট বিশেষজ্ঞ নাদাল? এই দলে নাম লেখানো রুপকথার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তার পেছনে লুকিয়ে আছে বহু বছরের পরিকল্পনা ও পরিশ্রম যা কোন নিভৃতে রচিত মহাকাব্যের কম নয়। বছরের পর বছর নিজের খেলাকে পাল্টেছেন, সব সারফেসে শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠার ক্ষমতা ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
ঘাসের জাদুকর ফেদেরার শক্ত কোর্টেও তাঁর শ্রেষ্ঠ ফর্মে অপরাজেয় হয়ে উঠতেন, ক্লেতে নাদালের কাছে অবশ্য তাঁকে বশ্যতা স্বীকার করতে হয়েছে বারংবার। ওপর দিকে জোকার নি:সন্দেহে অল-কোর্ট বিশেষজ্ঞ, যিনি তাঁর দিনে নাদালকেও সুড়কিতে মাত করতে পারেন। কিন্তু নাদাল নিজেকে সব সারফেসে সেরার জায়গায় নিয়ে গেছেন ধীরে-ধীরে, নিজের খেলাকে পরিণত থেকে পরিণততর করে।
এই তিন জন তারকাই নিজেদের-নিজেদের মত করে ক্রীড়াপ্রেমীদের জীবন পরিপূর্ণ করেছেন। তাই এঁদের মধ্যে কে গোট খোঁজার বৃথা চেষ্টা না করে এঁদের শেষ কিছুদিনের খেলা মনে-প্রাণে উপভোগ করাই হওয়া উচিৎ আমাদের লক্ষ্য। ভ্যাক্সিন কান্ডে জকোভিচ অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে না পারলেও ভবিষ্যতে তিনি নাদালকে আবার ছুঁতেই পারেন, টপকেও যেতে পারেন। কিন্তু রবিবার রাতটি নাদালের থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। যেমন বাকি দুই তারকার শ্রেষ্ঠ জয়ের রাতগুলিও অনন্য থেকে যাবে সময়ের শেষ অবধি। তাই তো তাঁরা তিনজনই সর্বকালের সেরা।