এই পাখি একদিন উড়ে যাবেই

চট্টগ্রামে ক্রিকেট ফিরলেই বারবার একটা পরিবারের কথা ঘুরে ফিরে আসে। সেটা হচ্ছে তামিম ইকবাল, আকরাম খানদের বিখ্যাত খান পরিবার। তবে চট্টগ্রামে ক্রিকেটে মেলা বসলেই এখন নতুন একটা ছেলের নাম জোরেশোরে উচ্চারিত হয়। তিনি হলেন ইয়াসির আলী রাব্বি। রাব্বিদের বাসায় প্রায়ই ক্রিকেটারদের আড্ডা বসে, টিম হোটেলে সবার জন্য খাবারও যায় এই বাড়ি থেকে।

ইয়াসির আলী রাব্বিদের বাড়ির দরজা যেন সবার জন্য খোলা। জাতীয় দলের ক্রিকেটার থেকে আমাদের মত সাংবাদিকদের জন্যও। বিকালে রাব্বির বাসা থেকে একবার ঢুঁ মেরে আসার কথা ছিল। তবে সকাল সকাল রাব্বির বাবার সওকত আলী চৌধুরীর ফোন এলো। জানালেন বিকালে যাওয়া চলবেনা, দুপুরে তাঁদের সাথে খেতে হবে। তারপর যত ইচ্ছে আড্ডা দেয়া যাবে।

বাসাটা ফাঁকাই থাকে, মানুষ বলতে রাব্বির বাবা-মা দুজনই। আর একমাত্র ছেলে তো প্রায় সারাবছরই জাতীয় দলের সাথে থাকছে বছর তিনেক হয়ে গেল। ফলে আমাদের পেয়ে যেন নিজের ছেলেকেই খুঁজে পেলেন। খাওয়া দাওয়ার পর যে আড্ডা শুরু হলো সেটা প্রায় সন্ধ্য অবধি চললো। রাব্বির বাবা-মা’র মুখ থেকে একে একে বেড়িয়ে আসতে থাকলো একজন ক্রিকেটার তৈরি হওয়ার গল্প।

সেই চার বছর বয়স থেকে এই দুজন মানুষ কীভাবে রাব্বিকে ক্রিকেটার বানানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন তা বোঝা গেল। একটা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। রাব্বি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। স্কুল থেকে ফিরলেই মা একটু ভাত খায়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। দুপুর তিনটার দিকে বাবা নিজের ব্যবসার কাজ ফেলে এসে বাসায় চলে আসতেন। রাব্বি ঘুমিয়ে থাকা অবস্থাতেই মোজা পড়িয়ে দিতেন। তারপর এই ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে নিয়েই মাঠে চলে যেতেন। অনেক সময় মাঠে গিয়ে ঘুম ভাঙত রাব্বির। সেও ব্যাপারটার সাথে মানিয়ে নিয়েছিল। চোখ কচলাতে কচলাতেই রানিং করা শুরু করতেন।

এই হলো ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর স্বপ্ন দেখা রাব্বির বাবার পাগলামি। এমনকি নিজের ব্যবসাটাও ঠিকমত করেননি ছেলের ক্রিকেটের পিছনে ছুটে। ছেলেকে নিয়ে গিয়েছেন এই শহর থেকে সেই শহরে ক্রিকেট খেলার জন্য। একটা সময় আশাপাশে লোকজন বলেছে পাগল হয়ে গেলন নাকি। তাতে রাব্বির বাবা-মা থোড়াই কেয়ার করেছেন। রাব্বির যেদিন জন্ম হলো সেদিনই নাকি শওকত আলী তাঁর স্ত্রী সামিনা আল নাহারকে বলেছিলেন, ‘এই ছেলেকে আমি ক্রিকেটার বানাব, তুমি পাশে থেকো।’

রাব্বির মা সত্যিই পাশে থেকেছেন। এখনো ছেলে ব্যাট হাতে নামলে তাঁর হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। টিভির সামনে না থেকে প্রার্থনায় বসেন। পাশের রুম থেকে স্বামী যখন চিৎকার করে বলেন চার মারলো তখন এই মায়ের চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।

তবে রাব্বি তাঁর জীবনের অর্থ বুঝেছিলেন একদিন বাসে করে চট্টগ্রাম ফেরার সময়। আর বাবা সৈকত আলী বুঝেছিলেন এই ছেলে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। সেবার অনূর্ধ্ব ১৯ দলের ট্রায়ালে ডাকা হলো রাব্বিকে। যদিও তাঁর বয়স তখন মাত্র ১৪-১৫ বছর। বিকেএসপিতে তিন ম্যাচ খেলানো হয়েছিল ছেলেদের মধ্যে। সেখানে দুই মাচেই পঞ্চাশের বেশি রান করেছিল রাব্বি। কোচরাও তাঁর ব্যাটিং দেখে দারুণ খুশি হয়েছিল। ফলে ধরেই নেয়া হচ্ছিল অনূর্ধ্ব ১৯ দলে ডাক পাচ্ছেন তিনি।

তবে স্কোয়াডে তাঁর নাম আসলো না। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফেরা পথে পুরোটা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছিলেন রাব্বি। মাঝে বাসের স্পিকারে একটা গান বেজে উঠলো, ‘টুটা টুটা এক পারিন্দা এইসে টুটা, ফির জুর না পায়া। লুটা লুটা কিসনে উসকো এইসে লুটা, ফির উড় না পায়া।’ এই গান শুনে রাব্বি বাবাকে বলেছিলেন, ‘এটা আমার কথা বলছে বাবা।’ শওকত আলী সেই দু:খের দিনেও এটা ভেবে খুশি হয়েছিলেন যে তাঁর ছেলে বাস্তবতা বুঝতে শিখে গিয়েছে।

ইয়াসির আলী রাব্বি সত্যিই জীবনটাকে বুঝতে শিখেছেন। প্রায় তিন বছর জাতীয় দলের সাথে থেকে অভিষেক হয়নি তাঁর। তিনি ২০১৯ সালে ডাক পাওয়ার পর মাঝে ১৯ জন ক্রিকেটারের অভিষেক হয়েছে। এরপর গতবছর এই চট্টগ্রামেই পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক। তাও মাথায় আঘাত পেয়ে দারুণ একটা ইনিংস মাঝপথে থেমে গিয়েছিল। এরপর নিউজিল্যান্ড গিয়েও নিজেকে প্রমাণ করেছেন রাব্বি।

তবুও জাতীয় দলে এখনো তাঁর জায়গাটা পাকা না। মূলত টেস্টে সাকিবের বদলি হিসেবে খেলছেন। সাকিব ফিরলে আবার হয়তো তাঁর ডানাটা ভেঙে দেয়া হবে। তবুও রাব্বি উড়ার স্বপ্ন দেখা ছাড়ছেন না। কোনভাবেই এই ছেলেকে খাঁচায় বন্দী করে রাখা যাচ্ছেনা। খাঁচাটা ভেঙে এই পাখি একদিন উড়ে যাবেই।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link