রুপকথার গল্পগুলো কলমের কালিতে মলাটে মোড়ানো বইয়েই থাকে না সীমাবদ্ধ। এই ধরণীতে বারেবারে রুপকথা লেখা হয়। এবারের রুপকথা লিখলেন বাংলাদেশের দুই তরুণ ক্রিকেটার আফিফ হোসেন ও মেহেদী হাসান মিরাজ। কি এক মহাকাব্যিক জুঁটি! কি এক দ্রোহের কবিতা!
আফগানিস্তানের বিপক্ষে চট্টলার মাটিতে বছরের প্রথম ওয়ানডে সিরিজ। প্রথম ম্যাচে নতুন এক বাংলাদেশ দলের আভাস মিলেছে একাদশ ঘোষণার শুরু থেকে। তিন পেসার নিয়ে শুরু। তিন পেসারেই শেষ আফগানিস্তানের ইনিংস। মুস্তাফিজুর রহমান, তাসকিন আহমেদ ও শরিফুল ইসলামের ঝুলিতে সাত উইকেট। এ তো নতুন বাংলাদেশের জয়গান।
না তখনও তারুণ্যের কবিতা লেখা বাকি। তখনও তারুণ্যের কাব্য করা বাকি। দলের চার অভিজ্ঞ ব্যাটার স্বাভাবিকভাবেই ব্যাটিং অর্ডারে এলেন খানিকটা উপরে। কিন্তু আজকের দিনেই সবাই ব্যর্থ। ব্যর্থ আরেক তরুণ ইয়াসির আলী চৌধুরি। তিনি ফিরেছেন শূন্য রানে, মাথা নুইয়ে ফিরেছেন প্যাভিলনে। কিন্তু সেই প্যাভিলনেই আরেকজন বুক চিতিয়ে লড়াই করার সাহস সঞ্চার করছিলেন।
ছেলেটা আফিফ হোসেন ধ্রুব। দলের অন্যতম সেরা তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের প্রস্থানে বাইশ গজে হাজির আফিফ। তখনও তাঁর সঙ্গী আরেক অভিজ্ঞ খেলোয়াড় মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। তাঁকে নিয়ে লড়াই করবেন ভেবেই হয়ত এসেছিলেন আফিফ। মাহমুদউল্লাহ পরীক্ষিত, তিনিই তো সাইলেন্ট কিলার। কিন্তু না তরুণ আফিফকে হতাশ করে রিয়াদ ফিরে গেলেন শীতাতপের বাতাসে নিজেকে ডুবিয়ে দেবেন বলে।
আফিফের নামের মতোই তাঁর সংকল্প রইলো ধ্রুব। তিনি যেন আজ দেখাবেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত তাঁরা। এবার যোগ্য এক সঙ্গী হিসেবে পেলেন মিরাজকে। দলের অবস্থা তখন বেজায় খারাপ। ৪৫ রানে নেই ছয় উইকেট। লক্ষ্যমাত্রা ২১৬। বড্ড দূর মনে হতে লাগলো। সেই পরিস্থিতি থেকে আসলেই বড্ড বেশি দূর!
তবু দ্রোহের চেতনায় বুদ আফিফ মিরাজকে হয়ত বললেন ভাই চলেন আমরা ক্রিকেটটা খেলি। কতদূর যেতে হবে সে চিন্তা মাথায় আনার খুব বেশি প্রয়োজন নেই। মিরাজকে সাথে নিয়ে আফিফ ক্রিকেটটাই খেললেন। অসাধারণ! অদ্ভুত! দৃষ্টিনন্দন! দুইজনে মিলে বিপর্যয় সামলে শুধু ক্রিকেটটাই খেললেন শেষ অবধি।
অন্যদিকে রশিদ খান, মোহাম্মদ নবী, মুজিব-উর রহমানদের মতো অভিজ্ঞ এবং পরীক্ষিত বিশ্বমানের স্পিনাররা চোখ রাঙ্গাচ্ছেন, ভয় দেখাচ্ছেন। তবে চট্টলার বাইশ গজে যে আজ আফিফ হবেন বাংলাদেশের দূর্গের কারিগরতা হয়ত কল্পনাতেও ভাবেননি আফগান ক্রিকেটাররা। সেই আফিফ বিপর্যয় সামলালেন, নিজের ইনিংসটা বড় করলেন। তাঁর থেকেও বড় বিষয় দলকে এনে দিলেন এক অপ্রত্যাশিত জয়।
আফিফ খেললেন ১১৫টি বল। যে বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে নাভিশ্বাস উঠে যাবার উপক্রম সাকিব, রিয়াদদের তাঁদের বিপক্ষেই খেললেন ১৮৭ মিনিট। সাবলীল ক্রিকেটটা খেললেন আফিফ। কোন অপ্রয়োজনীয় আক্রমণ নয়, কোন অহেতুক শট নির্বাচন নয়। একেবারে সোজাসাপ্টা ব্যাটে খেললেন। তবে বুদ্ধিমান আফিফ প্রতিটা বলের আগে ফিল্ডিংটা দেখে নিয়ে বেশ কয়েকটা ঝুকিপূর্ণ শট খেলেছেন ঠিক।
তবে তাতে খুব একটা ক্ষতি হয়নি দলের। ঐ যে বুদ্ধিমান ক্রিকেটার। দলের বিপর্যয় সামলে ইনিংসটা ধরে খেললেন, সেই সাথে রান করলেন। ৯৩ রানে ছিলেন জয় নিশ্চিতের আগ পর্যন্ত বাইশ গজে। মাঠের চারিপাশে এগারো খানা চারের সাথে একবার শুধু উড়িয়ে বল সীমানা ছাড়া করেছেন। শান্ত-শিষ্ঠ, বুদ্ধিদীপ্ত, সময়োপযোগী দূর্দান্ত এক ইনিংস। এই ইনিংস খেলে আবারও আফিফ প্রমাণ করলেন ইনিংস কি করে বিল্ডআপ করতে হয় তা তিনি খুব ভাল করেই জানেন।
তিনি জানেন কি করে সামাল দিতে হয় দলের বিপর্যয়। তরুন আফিফ এটাও জানেন দলকে কি করে নিয়ে যেতে হয় জয়ের দিকে। আফিফ যে তাঁর ব্যাটিং অর্ডারে আরো একটু উন্নতি পাওয়ার যোগ্য আজকের এই ১৮৭ মিনিটে, ১১৫ বল খেলে ৯৩ রান করা ইনিংসটি বলে দেয়। তিনি যে কোন কালেই একজন ফিনিশার না তাও আর বোঝার খুব একটা বাকি থাকে না। তবুও হয়ত আফিফ একজন ফিনিশারের তকমা গায়ে জড়িয়ে খেলে যাবেন ছয় কিংবা সাত নম্বরে।