টি-টোয়েন্টির ধুমধাড়াক্কা ভাল, শেষ তিন ওভারে ব্যাটিং ঝড় ভাল। তবে শীতের সকালে কম্বল গায়ে দিয়ে ব্রেট লি বনাম শেবাগ-দ্রাবিড় আরও ভাল। প্রথমটা যদি হয় প্রেমিকার উদ্দাম আদর, দ্বিতীয়টা নিশ্চয়ই দিনশেষে একটা স্থায়ী আশ্রয় খুঁজে পাওয়ার শান্তি৷ টি-টোয়েন্টি যতই গ্ল্যামারাস হোক, টেস্ট ক্রিকেট স্থায়ী আশ্রয়।
ঠিক যেন মানুষের জীবনকেই তুলে ধরে দিনের নব্বইটা ওভার। সকাল সকাল নতুন বলে আগুন ঝরায় পেসাররা, ইনসুইং-আউটসুইংয়ে তখন প্রাণ ওষ্ঠাগত ব্যাটসম্যানের। ওঁৎ পেতে রয়েছে উইকেটরক্ষক, স্লিপ ফিল্ডাররা। কখন একটা ভুল হবে ব্যাটারের, ব্যাটের কানায় বল লেগে ক্যাচ উঠবে… সতর্ক থাকে ব্যাটসম্যানও। অফ স্টাম্পের বাইরে লোভনীয় হাফভলি ছেড়ে দেয়, কভার ড্রাইভের মায়া ত্যাগ করে দাঁতে দাঁত চেপে ইনস্যুইঙ্গার ডিফেন্ড করে।
বাবাকে বলতে শুনেছি, এই বল ছাড়াটাও একটা শিল্প। যে ব্যাটার যত বেশি বল ছাড়তে পারে, সে তত বিরক্ত করে তোলে বোলারকে, ভাগ্যে মারার বল জোটার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। আবার অধিনায়ক হিসেবেও বুঝতে হয়, কখন ইনিংস ডিক্লেয়ার করতে হবে৷ রানের পাহাড়ের মোহ ত্যাগ করে সঠিক সময় ইনিংস না ছাড়লে জেতার সম্ভাবনা কমতে শুরু করে।
আর এখানেই বুঝি ভুল করলেন ঋদ্ধিমান সাহা। সৌরভ গাঙ্গুলি পরবর্তী জমানায় ভারতীয় ক্রিকেটে বাংলার মুখ বলা চলে তাঁকে। ৪০ টি টেস্টে ভারতীয় দূর্গের অতন্দ্র প্রহরী তিনি। অনেকেই বলেন, ধোনি জমানায় না জন্মালে হয়ত ভারতের সর্বকালের সেরা উইকি হতেন তিনিই। বলার যথেষ্ট কারণও আছে অবশ্য।
উইকেটের পেছনে নীরবে সমস্ত অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করতেন ঋদ্ধিমান। এমন কতবার যে হয়েছে, ওয়াইড বলে নিশ্চিত বাউন্ডারি বাঁচিয়েছেন ঋদ্ধি, তার ইয়ত্তা নেই। ‘গল’ এর র্যাঙ্ক টার্নারে যেখানে শ্রীলঙ্কার উইকেটরক্ষক ভিরমি খাচ্ছিলেন, অশ্বিন-জাদেজার কাছে মুশকিল আসান হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের প্রিয় ‘সাহাদা’৷
কিন্তু ওই যে, প্রথমেই বললাম, ঋদ্ধি একেবারে বেসিকে ভুল করে বসেছেন৷ টেস্ট ক্রিকেট হোক বা জীবন… বল খেলার চেয়েও বেশি ছাড়াটা গুরুত্বপূর্ণ। ঋদ্ধি নিজেও জানতেন, ব্যাটে রান ছিল না গত দু’বছর ধরে। আধুনিক ক্রিকেটে শুধুমাত্র ধ্রুপদী উইকেটকিপার হলেই চলে না, পাশাপাশি ব্যাটের হাতটাও খাসা হতে হয়।
এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রথম শ্রেণীর উইকেটকিপারদের প্রত্যেকেই যথেষ্ট ভাল ব্যাটসম্যান। দীনেশ কার্তিক, পার্থিব প্যাটেলদের মাঝে মহেন্দ্র সিং ধোনির উত্থানও ঠিক এই কারণেই। পুনরাবৃত্তি ঘটল ২০১৮-১৯ থেকে। ধোনি পরবর্তী জমানায় টেস্টে ঋদ্ধি যখন অটোমেটিক চয়েস হয়েই উঠেছিলেন।
ধুমকেতুর মতো আগমন ঋষাভ পান্তের৷ বাঙালি আবেগ ঝেড়ে ফেলে একবার বলুন তো, এই মুহূর্তে কোন ক্রিকেটীয় যুক্তিতে পান্তকে বাদ দেওয়া যায়? শুরু থেকেই ব্যাট হাতে একের পর এক অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলেছেন দিল্লীর তরুণ। প্রথমে কিপিং নিয়ে যে সমস্যা ছিল, তাও কেটে গিয়েছে অনেকটাই। এই মুহূর্তে ঋষাভ ঠিক কোন কারণে খেলবেন না?
বয়সটাও তো আর ঋদ্ধির পক্ষে নেই। এখন সাইত্রিশ বছর বয়স তাঁর। যদি প্রথম একাদশে খেলতেন, তাহলে একটা কথা ছিল। রিজার্ভ বেঞ্চে তাঁর মতো একজনকে রেখে লাভটা কী? তাই টিম ম্যানেজমেন্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছে কে এস ভরতকে তৈরি করার। অবশ্যম্ভাবী সিদ্ধান্ত, আজ বাদে কাল এটা হতই।
তাই বঞ্চনা নয়, যা ঘটছে তা বাস্তব। এই বিষয়ে অন্তত বিসিসিআই কিংবা রোহিত-দ্রাবিড়কে প্রশ্ন করা চলে না। অভিযোগ থাকে না, অভিমানও থাকে না, থাকলে বেশ কিছুটা খারাপলাগা থাকতে পারে বরং। ২০১০ সাল থেকে টেস্ট খেলেও কিনা ‘ছাড়ার শিল্প’ আয়ত্ত করতে পারলেন না ঋদ্ধি? শেষের ক’বছর ব্যাটে একেবারে রান ছিল না, তবু পান্তের চোটের জেরে সুযোগ পেয়েছিলেন নিউজিল্যান্ড সিরিজ খেলার।
ঘাড়ে চোট নিয়ে ম্যাচ বাঁচানো ৬১ রানের ইনিংসও খেলেছিলেন৷ সেটাই তো আদর্শ সময় ছিল ছেড়ে দেবার। তেমনটা হলে হয়ত মহাকাব্যিক বিদায় ঘটত বঙ্গসন্তানের৷ সৌরভের হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ থেকে শুরু করে দ্রাবিড়ের পরামর্শ.. এত বিতর্কই দানা বাঁধত না।
ক্যারিয়ারের শেষে দলে সুযোগ পাইয়ে দিতে বাঙালি সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ির প্রয়োজন হত না বিশ্বসেরা উইকেটরক্ষকের।