পালে লেগেছে নব উদ্যমের হাওয়া। নির্ভীক নাবিক দেখাচ্ছেন পথ, তরুণ টগবগে রক্ত বইয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিশাল এক বহর। উত্তাল সমুদ্রে দিকহারা দল খুঁজে পেয়েছে গন্তব্য। তবে ক’দিন আগেও অবস্থা তো এমন ছিলোনা। অথৈ জলরাশির মাঝে হাতরে তীর খোঁজার প্রচেষ্টা। এই পুরো চিত্রপটে বেঁধে ফেলা যায় স্পেনের ঐতিহ্যবাহী ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনাকে।
এই তো ক’দিন আগে অবধি বার্সেলোনার খেলার মান কিংবা ধরণ সবকিছু নিয়েই কতশত কথা হলো। কোচ রোনাল্ড কোম্যানের ভুলভাল সিদ্ধান্ত। হুটহাট খেলোয়াড় কেনা-বেঁচা। পরিকল্পনার অভাব দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। যাচ্ছেতাই অবস্থার সমাধান তো করা দরকার। কর্তারা ঠিক করলেন ফিরিয়ে আনবেন ক্লাবের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় এবং কিংবদন্তি মিডফিল্ডার জাভিকে। এনে দায়িত্ব দেবেন দল পরিচালনার।
এই এক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখা গেলো। ২০২১ এর নভেম্বর মাসের ছয় তারিখে মধ্যপ্রাচ্যের এক ক্লাবের দায়িত্ব ছেড়ে জাভি ফিরলেন তাঁর গৃহে। সব পাখি উড়ে বেড়ায় সন্ধ্যা হলেই ফেরে নীড়ে। তবে যখন তিনি এলেন তখন দলের অবস্থা বেশ বেগতিক। লিগ টেবিলে অবস্থান সপ্তম অবস্থানে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও বেগতিক অবস্থান। দলের ইনজুরি সমস্যাও রয়েছে গুটিকতক।
সেই সাথে পর্যাপ্ত খেলোয়াড় সংকটও বেশ প্রকট। এমন অবস্থায় জাভি ফিরলেন বার্সেলোনার পুরনো টোটকায়। তাকালেন লা মাসিয়া থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়দের দিকে। ভরসা করলেন তাঁদেরকে, সুযোগও দিলেন। তরুণ সব খেলোয়াড়। বয়স কেবল পেরোয়নি ২৩ এর গণ্ডি। এমন সব খেলোয়াড়দের বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা এক ক্লাবের দায়িত্ব দিয়ে দিলেন নির্দ্বিধায়।
আর ফলাফল এখন সবার চোখের সামনে। গেলো ১১ ম্যাচ ধরে অপরাজিত বার্সেলোনা। ভাবা যায়! অথচ এবারের মৌসুম শুরু হওয়ার আগে অবধি এই বার্সার রক্ষণের নিন্দায় যেন ঢোকা যেতো না সোশ্যাল মিডিয়ায়। সংবাদ মাধ্যমগুলোও একেবারে ধুয়ে ফকফকা সাদা কাপড় নেড়ে দিতেন রোদে। সেখান থেকে গত ১১ লিগ ম্যাচে মাত্র ১২টি গোল হজম করেছে। পক্ষান্তরে বার্সেলোনার আক্রমণ রয়েছে দারুণ ছন্দে।
প্রতিপক্ষের জালে আঘাত হেনেছে ২৫ বার। গত তিন ম্যাচের হিসেবটা যদি টেনে আনা হয় তবে গোলের সংখ্যার অনুপাত দাঁড়ায় ১০:০২। সংখ্যার বিচারে অন্তত বোঝা সম্ভব যে ঠিক কোন দিকে রয়েছে বার্সেলোনা নামক জাহাজ। তাছাড়া চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ থেকে বাদ পড়া দলটা দাপট দেখাচ্ছে ইউরোপা লিগে। ইতালির ক্লাব ন্যাপোলিকে দুই লেগ মিলিয়ে ৫-৩ ব্যবধানে হারিয়ে চলে গেছে দ্বিতীয় রাউন্ডে।
পরিসংখ্যান দিয়ে আসলে বার্সেলোনার সার্বিক উন্নতির ক্রিস্টাল চিত্র পাওয়া বেশ দুষ্কর। মাঠের খেলায় সেই বার্সার সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটছে। ইয়োহান ক্রুইফ যেই টিকিটাকার দীক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন সেটা যেন রোনাল্ড কোম্যান ভুলেই গিয়েছিলেন। তবে জাভি তো লা মাসিয়া থেকেই ধারণ করেন সেই দীক্ষা। নিজের খেলোয়াড়ি জীবনে তিনি সেটা বয়ে বেড়িয়েছেন। কাতারের ক্লান আল সাদকে সে দীক্ষাতেই বানিয়েছিলেন অপ্রতিরোধ্য।
সেই ত্ত্বত তিনি আবার খাটাচ্ছেন তাঁর বর্তমান শীর্ষ্যদের উপর। তবে বিতর্ক এক হয়েছিলো। তাঁর অধীনে কেনা কিছু খেলোয়াড় নিয়ে। সেইখানে সাবেক বার্সা তারকা ডানি আলভেসকে পুনঃরায় ফিরিয়ে আনা নিয়ে নানান সমালোচনা হয়েছে। সেই সাথে আরেক সাবেক খেলোয়াড় অ্যাডামা ত্রাওরেকে দলে ভেড়ানোয় শুনতে হয়েছে কটু কথা। সেই কটু কথার জবাব মাঠের খেলাতেই দিয়েছেন জাভি।
আলভেস এবং ত্রাওরে প্রতিনিয়তই তাঁদের সর্বোচ্চটা দিয়ে প্রমাণ করছেন তাঁদেরকে দলে নিয়ে এসে কোন ভুল করেননি জাভি।
তবে ফেরান তোরেসের মতো একজন তরুণ, উদীয়মান খেলোয়াড়কে ম্যানচেস্টার সিটি থেকে বাগিয়ে নিয়ে আসায় জাভির প্রশংসা যে হয়নি তাও নয়। সব মিলিয়ে মিশ্র এক সময় পার করেছেন জাভি, তাঁর শৈশবের ঘরে পুনঃরায় নতুন দায়িত্বে ফিরে।
তবে তিনি যে ঠিক পথে হাটছেন সে বিষয়ে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। তাঁর নেতৃত্বে লিগে সপ্তম স্থান থেকে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে বার্সেলোনা। তাছাড়া মাঠের খেলায় দাপট দেখাচ্ছে তাঁর তরুণ শীর্ষ্যরা। রক্ষণে তরুণ রোনাল্ড আরাউহো বার্সার দূর্গে পরিণত হচ্ছেন এই জাভির সময়কালেই। আবার মধ্যমাঠের পূর্ণ দখল থাকছে ফ্রাঙ্কি ডি জং, পেদ্রি, নিকো, গাভি আর সার্জিও বুসকেটসদের পায়ে। আর আক্রমণে প্রতিপক্ষের বুকে কাপন ধরাচ্ছেন ফেরান তোরেস, পিয়েরে-এমরিক আউবামিয়াংরা।
একটা খারাপ সময় পার করে ক্রমশই আবার স্বরুপে ফিরছে বার্সেলোনা। সময়ের সাথে বার্সেলোনা আবারও দাপট দেখাবে পুরো ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে। এই জাভিই হয়ত তাঁদের নিয়ে যাবেন সেপথে। খেলাটা আসলে সময়ের।