ম্যাথিউস ফুটবল সংস্কৃতি

সালটা ১৯৯১ বা ১৯৯২ হবে বোধহয়। তার আগে ইতালিতে বিশ্বকাপ জেতা হয়ে গেছে পশ্চিম জার্মানির ( তখনো দুই জার্মানি এক হয়নি ) এবং তখন আপনি বছর আঠারো – উনিশের এক কিশোরের কাছে এক এবং একমাত্র ফুটবল ‘আইকন’।

গ্রামের ক্লাবে সবে বড়দের সঙ্গে খেলার ছাড়পত্র পেয়েছি। বর্ধমানের স্পোর্টস অ্যান্ড গেমস নামের দোকান থেকে জার্মানির জার্সি কিনলাম, সঙ্গে কালো প্যান্ট আর মোজা, সাদার ওপরে কালো, লাল, হলুদের বর্ডার। তখন প্রতিটা বিকেলে গ্রামের মাঠে আমি মনে মনে লোথার ম্যাথিউস হয়ে যাই। কেলোদা, কালিপদ, শুকোদা বা বিমলকে আটকাই আর সামনে আপনার ছবিটা ভাসে – নিজের জার্সির দিকে তাকাই, নিজের প্যান্ট বা মোজার দিকে – একটা শিহরণ খেলে যায় শরীরে।

এই রঙের জার্সি, প্যান্ট, মোজা পরে ওই লোকটাও খেলে! আমার স্বপ্নের রাজপুত্র! লোথার হারবার্ট ম্যাথিউস!

পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি উচ্চতা! আন্তর্জাতিক স্তরে সর্বোত্তম পর্যায়ে খেলার জন্য উচ্চতাটা খুব বেশি নয়। বিশেষ করে আপনি যে পজিশন এ খেলতেন এবং যে ভূমিকা পালন করতেন, তার জন্য তো নয়ই। আপনার এক পূর্বসূরি ছিলেন জার্মান ডিফেন্সে। হান্স পিটার ব্রিগেল। বিশাল চেহারার খেলোয়াড়কে দেখলে নিশ্চয়ই বিপক্ষ ফরোয়ার্ডের বুক কাঁপতো।

না, আপনার চেহারার মধ্যে ওই রকম ব্যাপার ছিল না। কিন্তু মাঠের মধ্যে আপনার ওই সাবলীল বিচরণ, শরীরের এবং হয়তো মনের ও সমস্ত ওজন মিশিয়ে এক, একটা ট্যাকল! যে জানতো সে ই জানতো।লোথার, আপনাকে নিয়ে লিখতে বসলেই এক ভদ্রলোকের লেখা কয়েকটা লাইন মনে পড়ে। সেই ভদ্রলোক আপনার থেকেও চার ইঞ্চি ছোট ছিলেন , পাঁচ ফুট পাঁচ।

আর্জেন্টিনার লানুসের পলিক্লিনিকো এভিতা হসপিটালে জন্মানো সেই ভদ্রলোকও ফুটবল টা খেলতেন। এবং আপনার সময়েই খেলতেন। বিদ্বজ্জনেরা বলে থাকেন যে সেই ভদ্রলোকের থেকে ভালো ফুটবল আর কম মানুষই খেলেছেন। নিজের বই , Soy el Diego তে তিনি আপনার সম্বন্ধে বলেছেন, ‘মাঠে আমার সেরা প্রতিদ্বন্দ্বী। আমার মনে হয় লোথারের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।’

খেলোয়াড় জীবনে অনেক প্রাপ্তি আপনার, একবার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন, দুবার রানার আপ, আট বার বুন্দেসলিগা জেতা, ব্যালন ডি অর, ফিফা প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার। এবং এমন আরো অনেক, অনেক পুরস্কার। কিন্তু আমার মনে হয় লানুসের ওই পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির, ওই যে আপনাকেই সেরা প্রতিদ্বন্দ্বী বলে চিহ্নিত করে দেওয়া – ওটাই আপনার সেরা প্রাপ্তি দিনের শেষে। কারণ ভদ্রলোকের নাম দিয়েগো আরমানদো মারাদোনা! আর এক ভদ্রলোক ও নিজের দেখা সেরা খেলোয়াড়দের তালিকায় প্রথম সারিতেই আপনাকে রেখেছেন। এই ভদ্রলোকের নাম পেলে!

লোথার ম্যাথিউস আসলে কেমন খেলোয়াড় ছিলেন ? তাঁর ঘরানাটা কেমন? তথাকথিত বল প্লেয়ার না হয়েও ম্যারাডোনা বা পেলেদের ফেবারিটের তালিকায় কী করে এত স্বচ্ছন্দে ঢুকে যান তিনি ? এটা বোঝার জন্য আপনাকে ম্যাথিউসের খেলা দেখতে হবে। না, ইউটিউবের ওই পাঁচ – সাত মিনিটের ঝলক গুলো নয়।

হ্যাঁ, ওতেও আপনি মাথাউসের ট্রেডমার্ক ট্যাকল দেখতে পাবেন, তিরিশ চল্লিশ গজের মাপা পাস দেখতে পাবেন, মাঝে মাঠ থেকে একাধিক প্লেয়ারকে কাটিয়ে গোল দেখতে পাবেন, বিপক্ষ বক্সে সতীর্থের সঙ্গে ওয়ান – টু খেলে নিখুঁত প্লেসিং এ গোল দেখতে পাবেন। ভাববেন , এই তো আপনার মাথাউস কে দেখা হয়ে গেল এবং ভুল ভাববেন। লোথার ম্যাথিউসকে বুঝতে গেলে পর, পর বেশ কয়েকটা খেলা দেখতে হবে এবং পুরো নব্বই মিনিট ধরে।

তাহলেই হয়তো আপনি বুঝবেন একজন খেলোয়াড় তথাকথিত ফুটবল শিল্পী না হয়েও , কয়েকজন সাধারণ মানের ( ক্লিনসমানের মত দু একজনকে ছেড়ে ) লড়াকু যোদ্ধাকে নিয়ে তখনকার সেরা দলগুলোর শ্রদ্ধা আদায় করে নিতেন। সেই জার্মানি এমন একটা দল ছিল, যাদের বিরুদ্ধে খেলার দু তিন মিনিট আগেও, দু গোলে এগিয়েও আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন না যে আপনি জিতছেন! এই হচ্ছে ম্যাথিউস ফুটবল সংস্কৃতি।

কোনো, কোনো ফুটবলারের হাতে ক্যাপ্টেনস আর্ম ব্যান্ড না থাকলেও তিনি ই অঘোষিত নেতা থাকেন। লোথার হারবার্ট মাথাউস ওই গোত্রের ছিলেন। শুধু বল পায়ে নয় , বল ছাড়া মাঠে তাঁর দৃপ্ত পদচারণা, তাঁর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ চোয়াল সহযোদ্ধাদের মধ্যে বিশ্বাসের বীজ ছড়িয়ে দিত। বরাবর।

লোথার, আপনি খেলা ছেড়ে গেছেন, বহু বহু বছর। তবু চোখ এখনো জার্মান মাঝমাঠে ঘোরে । খোঁজে একজনকে। পায় না। আপনার দলের সেই লড়াই ও আজকাল বিলুপ্ত প্রায়, এই জার্মান দলের মধ্যে । আপনি চলে যাবার পর জার্মান মাঝমাঠে একজনের মধ্যেই সেই নাছোড় লড়াই দেখেছিলাম। সেই ট্রেডেমার্ক জার্মান লড়াই। তাঁর নাম বাস্তিয়ান সোয়েনস্টেইগার! ব্যাস, তারপরে শুধুই শূন্যতা।

তাও জার্মানির খেলা থাকলেই বসি টিভির সামনে। ওটা যে লোথারের দল । লোথারের জন্যই জার্মান সাপোর্টার হওয়া আমার! লোথার , এমন একটা রাজ্যে আমি থাকি যেখানকার মানুষ স্বভাবগত ভাবে শিল্পীদেরই বেশি প্রাধান্য দিয়েছে বরাবর, যে কোনো খেলাতে। আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের ভিড়ে কিছু মানুষ এখনো রয়ে গেছেন আমার মত!

চোখ বুজলেই আপনার সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে যে চলে যাওয়া দেখতে পাই তাঁর সঙ্গে ওই একটা প্রাণীরই তুলনা চলে! ভালো থাকবেন লোথার মাথাউস। আমার ফুটবল আইকন। আজও। এবং আজীবন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link