ভাবুন একজন ভাড়াটে খুনি গোপনে খুব রবীন্দ্রানুরাগী। খুব আশ্চর্য তো? এবার ভাবুন একজন সাড়ে ’ছ ফুটের দৈত্যাকার ফাস্ট বোলার পেশাগত ভাবে একজন জ্যাজ স্যাক্সোফোন বাদক। একেবারেই বানানো গপ্পো না। এক্কেবারে নির্জলা সত্য।
ভদ্রলোক যে সময়ের লোক, তখন শুধু ক্রিকেট খেলে পেট চালানোর উপায় ছিল না। বেশির ভাগ খেলোয়াড় ক্রিকেট খেলতেন খেলাটার প্রতি অদম্য প্রেমে। এঁদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু জীবিকা ছিল। এঁদের বলা হতো অ্যামেচার। কিন্তু পেশা আর নেশার মধ্যে এতটা ফারাক খানিক আশ্চর্যেরই। তাঁর পেশা মানুষকে সুরের মাদকতায় আনন্দ দেওয়া, অথচ নেশা প্রতিপক্ষকে চরম দু:খ দেওয়া।
ভদ্ৰলোক সারের হয়ে খেলতেন। প্রতিপক্ষ নটিংহ্যামের প্রবাদ প্রতিম অধিনায়ক আলফ গোভার নাকি একবার এই উপরিউক্ত ভদ্রলোকের বাউন্সারে গড়াগড়ি খাওয়ার পর, সারের অধিনায়ক পার্সি ফেন্ডারকে বলেন, ‘ভাই পার্সি, এভাবে ক্রিকেট খেলা কি ঠিক?’ ভদ্রলোকের নাম মরিস আলম। জন্মেছিলেন ২৩ মার্চ, ১৯০৬ সালে।
আলম মাত্র পাঁচটি টেস্ট খেলেছিলেন। তার মধ্যে একটিমাত্র টেস্টে এমন তিনটি রেকর্ড করেছিলেন, যা আজও অবধি খুব কম লোকে ভাঙতে পেরেছেন।
সালটা ১৯৩০। এক অদ্ভুত ক্রিকেট সিজন। তৎকালীন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কনফারেন্স ঠিক করে, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার বাইরেও টেস্ট ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দিতে হবে।
তা, যেমন ভাবা তেমনই কাজ। এমসিসি ঠিক করলো, একই সাথে ক্যারিবীয়ান দ্বীপপুঞ্জ ও নিউজিল্যান্ডে দল পাঠাবে। এবার গোল বাঁধলো একটা জায়গায়। ১৯২৮-২৯ এ অস্ট্রেলিয়া সফর করে আবার ১৯৩২-৩৩ এর অস্ট্রেলিয়া সফর ও ১৯৩০-৩১ এর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের কথা ভেবে, অনেক প্রথম সারির খেলোয়াড়, আনকোরা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নিউজিল্যান্ডে টেস্ট খেলতে যেতে রাজি হলেন না।
তখন তো আর আজকের দিনের মতো সফর হতো না। জাহাজ-ট্যুর ম্যাচ-দীর্ঘদিন পরিবারকে ছেড়ে থাকার ক্লান্তি মিলিয়ে আধ বছরের সফর হতো। কাজেই, হব্স দের ছুটি নেবার কারণ যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। এবং ঠিক এই কারণেই হয়তো নিউজিল্যান্ড সফরের টিকিট পেয়েছিলেন মরিস আলম। এর আগে ১৯২৭ এবং ১৯২৮ সালে তিনি কেমব্রিজের ব্লু হন। সময়টা তাঁর মন্দ যাচ্ছিলো না। তবে দ্বিতীয় কোভিড ঢেউয়ের গ্রাফের মতো তাঁরও ক্যারিয়ার গ্রাফ একটি মাত্র দিনেই ধাঁ করে সমতল থেকে মহাকাশের দিকে পাড়ি দেয়।
দিনটি ছিল ১০ জানুয়ারি ১৯৩০। স্থান ক্রাইস্টচার্চ। এর ঠিক একদিন পর থেকে আরেকটি ইংল্যান্ড দল ফ্রেড ক্যাথর্পের নেতৃত্বে ওয়েস্টইন্ডিজে টেস্ট খেলবে। অর্থাৎ একইদিনে দুই পৃথক গোলার্ধে একটি দল একসাথে টেস্ট খেলবে। এর আগে বা পরে কখনোই ওই ঘটনা আর ঘটেনি। তবে সে অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ।
ফেরা যাক মরিস আলমের কথায়। হ্যারল্ড গিলিগানের নেতৃত্বাধীন দলের সদস্য হিসেবে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে অভিষেক করেন তিনি। নিউজিল্যান্ডেরও সেটা অভিষেক টেস্ট ছিল এবং অভিষেকেই হ্যাটট্রিক নেন। তাঁর অষ্টম ওভারের প্রথম বলে রজার ব্লান্ট একটি লেগ বাই নেন। স্ট্রাইকে আসেন স্টিউই ডেম্পস্টার। ওভারের দ্বিতীয় বলেই ডেম্পস্টার বোল্ড।
এরপর ক্রিজে আসেন কিউই অধিনায়ক টম লাউড়ি। প্রথম বলে বিট হন। পরের বলেই তিনি এল বি। পরের দুই ব্যাটার কেন জেমস ও টেড ব্যাডকক (নিশ্চিত রূপেই খানিক মুচকি হাসির উদ্রেককারী নাম! যেমন কানিস !) পরপর দু বলে আউট। অর্থাৎ পাঁচ বলে চার উইকেট। হ্যাটট্রিক। তাও অভিষেকে।
এই দুটো রেকর্ড টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম করেন তিনিই। তাঁর পরেও করেছেন মাত্র দুজন করে। অভিষেকে টেস্ট হ্যাটট্রিক ক্লাবের বাকি দুই সদস্য পিটার পেথেরিক ও ডেমিয়েন ফ্লেমিং। ৫ বলে চার উইকেট ক্লাবের বাকি দুই সদস্য হলেন আকরাম ও ওল্ড।
এই টেস্টের পরে আলম খেলেছিলেন আর মাত্র চারটি টেস্ট। উইকেট পান ১৪। তার মধ্যে প্রথম টেস্টেই আটটি। যদিও কাউন্টি ক্রিকেটে সম্ভ্রম জাগিয়েছেন। খানিক আমাদের বাংলার শুটে ব্যানার্জির মতো, বাঘা বাঘা ব্যাটারদের আউট করার প্রবণতা ছিল আলমের। স্বয়ং ব্র্যাডম্যানকেও বার দুয়েক প্যাঁচে ফেলেছেন তিনি। যদিও তা টেস্ট ম্যাচে নয়। খেলা ছাড়ার পর সারের প্রেসিডেন্ট হন।
মৃত্যুর সময় অবধি এমসিসির বর্ষীয়ান সদস্য ছিলেন। বাসিল ডি’ অলিভিয়েরা খ্যাত ১৯৭০ এর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সময় তিনিই ছিলেন সেক্রেটারি । তাঁর পুত্রও সারের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলেছেন। ওয়ান টেস্ট ওয়ান্ডার টেস্ট ক্রিকেটে প্রচুর রয়েছেন। মরিস আলমও সেই দলেরই এক আজীবন সদস্য হয়ে থেকে যাবেন, পাঁচটি টেস্ট খেলেও।