একটা সুন্দর যুগের অবসান হয়ে গেল। মনে রাখার মত সময়। রাজত্ব শেষ হল এক মহারাজার। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের দল চেন্নাই সুপার কিংসের অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। ভারতের সবচেয়ে সফলতম অধিনায়ক তো তিনি অবশ্যই। তাছাড়া আইপিএলের অন্যতম সফলতম অধিনায়ক ছিলেন ধোনি।
নতুন দিনের সূচনা হচ্ছে রবীন্দ্র জাদেজার হাত ধরে। তবে শিরোপার বিচারে ধোনি হয়ত সেরাদের একজন। তবে মাঠের ক্রিকেটে বুদ্ধির প্রদর্শন করা খেলোয়াড়দের তালিকায় কোন ধরণের সন্দেহ ছাড়াই তিনি থাকবেন উপরের সাড়িতে। সেই ২০০৮ সাল থেকেই চেন্নাই সুপার কিংসের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন ধোনি।
মাঝে বছর দুয়েক দল নিষিদ্ধ থাকায় তাঁর অধিনায়কত্বের মুন্সিয়ানা দেখার আক্ষেপ সৃষ্টি হয়েছিল। এই দীর্ঘ পথচলায় বেশ কিছু ‘আউট অব দ্য বক্স’ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ধোনি। খেলার গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সে সকল সিদ্ধান্ত পালটে দেয় ম্যাচের গতিপথ। এমনকিছু সিদ্ধান্তের সম্ভার থাকছে আজ।
- কাইরন পোলার্ডকে আটকে ফেলা (২০১০)
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে পেশির জোরের কদর জগতজোড়া। সেই পেশিশক্তি রয়েছে এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড় কাইরন পোলার্ড অন্যতম। ২০১০ সালের আইপিএল ফাইনালে চেন্নাইয়ের শিরোপা জয়ের জন্যে ৩৩ রান আটকে রাখাটা বেশ জরুরি হয়ে পড়ে। হাতে তখনও দু’ওভার বাকি। অন্যদিকে ব্যাটার সেই মারকুটে কাইরন পোলার্ড।
শেষের আগের ওভারে ২২ রান নিয়ে ফলাফলকে রীতিমত পেন্ডুলামে পরিণত করে ফেলেন পোলার্ড। ঠিক তখনই খানিক ব্যতিক্রম এক ফিল্ডিং পজিশন সাজিয়ে ফেলেন ধোনি। শর্ট ফাইন-লেগে থাকা ম্যাথু হেইডেনকে নিয়ে গেলেন মিড-অফে। তবে পিচ বরাবর খুব কাছাকাছি একটা জায়গায়। পরিকল্পনা ছিল আলবি মরকেল অফ স্ট্যাম্পের বেশ বাইরে ইয়োর্কার করবেন। যাতে পেশিশক্তির পূর্ণ ব্যবহার করতে না পারেন পোলার্ড।
আর সাধারণত হার্ডহিটার ব্যাটাররা সুইপ কিংবা রিভার্স সুইপ খেলেন না। তাঁরা সোজা ব্যাটে সজোরে খেলতেই বেশি পছন্দ করেন। তাই ধোনি সে পরিকল্পনা থেকেই হেইডেনকে সরিয়ে নেন মিড-অফে। তাতে কাজও হয়। মরকেলের ফুল লেন্থের বলে ঠিকঠাক টাইমিং করতে না পারা পোলার্ড আউট হন হেইডেনের হাতে ক্যাচ দিয়ে। আর তাতেই নিশ্চিত হয়েছিল চেন্নাই সুপার কিংসের প্রথম শিরোপা।
- বিশৃঙ্খল তত্ত্ব (২০১৮)
২০১৮ সালের আইপিএলে পাঞ্জাব কিংসের বিপক্ষে পাঁচ ওভারের মাঝেই তিন উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়ে যায়। স্কোরবোর্ডে তখন রান কেবল ২৭ অথচ ১৫৪ রানের টার্গেটে ব্যাট করছিলো চেন্নাই। তখন নিজের বিশৃঙ্খল তত্ত্ব নিয়ে হাজির হন মহেন্দ্র সিং ধোনি। ডোয়েন ব্রাভো, রবীন্দ্র জাদেজা ও নিজের আগে তিনি পাঠিয়ে দেন হারভজন সিং ও দীপক চাহারকে।
অত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এমন সিদ্ধান্ত সকলকে বিস্মিত করেছিল ঠিক। তবে তা কাজ করেছিল চেন্নাইয়ের জন্যে। প্রতিপক্ষ বোলারদের সাথে বুদ্ধির খেলায় জিতেছিলেন সেদিন ধোনি। প্রতিপক্ষ বোলারদের লাইন ও লেন্থ বিগড়ে দিতেই তিনি ব্যাটিং অর্ডারে অমন রদবদল করেছিলেন। আস্থা রেখে হরভজন ও চাহারকে পাঠিয়েছিলেন বাইশ গজে। তা কাজও করেছিল।
১৯ বলে ২২ রান করে নতুন বলের উজ্জ্বলতা নষ্টতে ভূমিকা রাখেন হরভজন। অন্যদিকে ১৯৫ স্ট্রাইকরেটে দারুণ এক ক্যামিও খেলেন দীপক চাহার। ২০ বলে ৩৯ রান করে চাহার প্রাথমিক বিপর্যয় সামাল দেন চাহার। এমন বিশৃঙ্খল তত্ত্ব চেন্নাই সুপার কিংসকে জয়ের বন্দরে নিয়ে গিয়েছিল।
- ঝোপ বুঝে পা ফেলা
২০১৮ সালে চেন্নাই সুপার কিংস অভিজ্ঞ অফ-স্পিনার হরভজন সিংকে দলে ভিরিয়েছিল। হয়ত কন্ডিশন বুঝেই একজন অভিজ্ঞ স্পিনার দলে রাখতে চাইছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। প্রতিদানও দিচ্ছিলেন তিনি। তবে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের বিপক্ষে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে হওয়া কোয়ালিফায়ার ম্যাচে হরভজনকে বোলিংই করাননি ধোনি। অথচ মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে এই ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে বহু ম্যাচ জিতিয়েছিলেন হরভজন।
তাছাড়া রবীন্দ্র জাদেজা ছিলেন দারুণ ছন্দে। তাই হরভজনকে আর প্রয়োজন পড়েনি। নিজের সিদ্ধান্তের পক্ষে ধোনি বলেন, ‘আমার বাসার গ্যারেজে অনেক গাড়ি ও বাইক পড়ে রয়েছে। আমি সবগুলো এক সময়ে চালাতে পারি না। ঠিক তেমনি যখন আপনার দলে ছয়-সাতজন বোলার থাকবে আপনি কন্ডিশন আর প্রতিপক্ষ এবং পরিস্থিতি বিচার করেই বোলার ব্যবহার করবেন।’
ফাইনালে সেই সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের বিপক্ষে হরভজনকে দলে না রেখে কর্ণ শর্মাকে দলে নেন ধোনি। অধিনায়ককে বিন্দুমাত্র হতাশ না করে প্রতিপক্ষ অধিনায়কের উইকেট তুলে নেন কর্ণ। ক্রিজ থেকে বের করে আনেন কেন উইলিয়ামসনকে। আর স্ট্যাম্পিং করতে তো ধোনি সিদ্ধহস্ত।
- ক্রিস গেইলকে নাস্তানাবুদ
রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুকে একা হাতেই সেবার টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন ক্রিস গেইল। মারকুটে এই ব্যাটার ২০১১ আইপিএল আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। অন্যদিকে চেন্নাই সুপার কিংস ছিল পরপর দুই শিরোপা জয়ের দ্বারপ্রান্তে। ফাইনালে মুরালি বিজয়ের ব্যাটে ভর করে ২০৫ রানের বিশাল টার্গেট দাঁড়া করায় সুপার কিংস। ভয় ছিল সেই গেইল।
তবে ধোনি তাঁর বুদ্ধির খনি থেকে বের করে নিয়ে এলেন নতুন বুদ্ধি। শুরুতেই গেইলের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে। অফ স্পিনারের স্পিন জাদুতে কাবু হয়ে মাত্র তিন বলে শূন্য রান করে ফিরে যান গেইল।
ব্যাস! আর তেমন কিছু করার ছিল না ব্যাঙ্গালুরুর। দ্বিতীয় দফা শিরোপা হাতে উল্লাসে মেতে উঠল সুপার কিংস ভক্তরা। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের খানিক বাউন্স করা বলে ব্যাটা খোঁচায় বল গিয়ে জমা পড়েছিল ধোনির দস্তানায়।