বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কটা যেমন মধুর ঠিক তেমনি খেলার মাঠে লড়াইটাও হয় নানা সমীকরণের মধ্যে। ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবলেও দুই দেশের জাতীয় দল একে অপরের মুখোমুখি হলে উত্তেজনার পারদটা বাড়তে থাকে। যেমন করে এবার এএফসি কাপের প্লে অফের খেলায় ঢাকা আবাহনী লিমিটেড ও এটিকে মোহনবাগানের খেলার আগে সেই পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
দুই দেশের দুই ক্লাবের এশিয়ান ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম সেরা এই লড়াইয়ে মাঠে নামছে। সন্ধা সাড়ে সাতটায় বিশ্বভারতী যুব স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হবে আবাহনী-মোহনবাগান। মূলত প্লে অফের এই লড়াই ছাপিয়ে এটি এখন বাংলাদেশ-ভারতের লড়াইয়ে রুপ নিয়েছে। টুর্নামেন্টে টিকে থাকতে হলে জয়ের কোন বিকল্প নেই। অর্থাৎ যে দল জিতবে তারা চলে যাবে চুড়ান্তপর্বে। আর পরাজিত দলকে এই বছরের জন্য টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিতে হবে। জাতীয় দলের পাশাপাশি দুই দেশের ক্লাব দলের মধ্যে লড়াইটা জমজমাট হলেও জয় হয়েছে ভারতেরই। স্বাধীনতার পর থেকেই দক্ষিন এশিয়ান ফুটবলে বাংলাদেশ-ভারত দু’দেশই পরাশক্তি হিসেবে মূল্যায়িত হচ্ছে।
পাশাপাশি দুই দেশের ম্যাচ মানেই অন্যরকম একটা উত্তেজনা থাকে। আর সেটা শেষবার দেখা গেছে ২০১৯ সালে সল্ট লেকের যুব ভারতীতে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে। যে ম্যাচে সাদ উদ্দিন গোল করে ৬০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার স্টেডিয়ামটি স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন। এরপর ম্যাচের একেবারে শেষ দিকের গোলে হার এড়ায় ভারত। সেই সল্ট লেকে আজ সন্ধ্যায় কলকাতার ফুটবলের ঐতিহ্যর ধারক-বাহক এটিকে মোহনবাগানের মুখোমুখি হবে আবাহনী।
ম্যাচটি দুই দলের জন্য অনেকটাই ‘ফাইনাল’ ম্যাচের মতো। যে দল জিতবে তাদের মিলবে এএফসি কাপের গ্রæপ পর্বে খেলার টিকিট। এএফসি কাপের প্লে অফ ওয়ানে অবশ্য লংকান ক্লাবটির বিরুদ্ধে মাঠে নামার আগেই এগিয়েছিল মোহনবাগান। ম্যাচে ব্যবধান অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আবাহনীর বিরুদ্ধে লড়াই পেতে চলেছে ভিন্ন মাত্র। দুই বাংলার ক্লাব দলের ম্যাচটা ঘিরে তাই দারুণ উন্মাদনা চলছে কলকাতার ফুটবলাঙ্গনে।
বিশেষ করে করোনাকালীন সমস্যা কাটিয়ে ওঠে আবারো দর্শকরা সরাসরি গ্যালারীতে বসে খেলাটি দেখতে পাবে। এর আগে গত সপ্তাহে শ্রীলংকার ক্লাব ব্লুস্টারের বিপক্ষে মোহনবাগানকে সমর্থন দিতে মাঠে এসেছিলেন ৩০ হাজারেরও বেশি দর্শক। তাদের নিরাজ না করে কলকাতার দলটি জিতেছিল পাঁচ গোলের ব্যবধানে। আজকের ম্যাচের জন্য আবাহনীর বিপক্ষে ৪০ হাজার টিকিট এরই মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে।
দুই বাংলার ফুটবল লড়াই ঘিরে কতটা উন্মাদনা বইছে ওপার বাংলায়, তা তো টিকিট বিক্রির সংখ্যাতেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। এর আগে ২০১৫ সালে সল্ট লেকেই আইএসএলে চেন্নাইনের বিপক্ষে নজরকাড়া গোল করেছিলেন অ্যাথলেটিকো ডি কলকাতার (বর্তমানে মোহনবাগান) রাফায়েল অগাস্তো। সাত বছর পর সেই মাঠে মোহনবাগানকে হারানোর মন্ত্র নিয়ে মাঠে নামবেন রাফায়েল! তার হাতেই যে এখন আবাহনীর আর্মব্যান্ড, সে কারণে রোমাঞ্চিত এ ব্রাজিলিয়ান তারকা আজ সন্ধ্যায় সল্ট লেককে স্তব্ধ করে দিতে মরিয়া হয়ে আছে। এর আগে ২০১৭ সালে এএফসি কাপের ম্যাচে কলকাতায় আবাহনী ১-৩ গোলে হেরেছিল মোহনবাগানের কাছে। এরপর ফিরতি ম্যাচে ঢাকায় ১-১ গোলে ড্র করে দুদল। এবার সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই মাঠে নামছে দু’দল।
দুই বছর পর ২০১৯ সালের এএফসি কাপে আবাহনী চেন্নাইয়িন এফসি ও মিনার্ভা পাঞ্জাবকে হারিয়ে গ্রæপসেরা হয়েছিল। সব মিলিয়ে এএফসি কাপে ২১ ম্যাচে আবাহনীর সাতটি জয়ের বিপরিতে হেরেছে ১০টি ম্যাচে। বাকি চারটি ম্যাচ ড্র’য়ে শেষ হয়। এবার ঢাকা আবাহনীর একটি জয় তিনটি প্রাপ্তি এনে দিতে পারে। এছাড়া সাথে যোগ হবে সান্ত¡নাও। কারণ নতুনভাবে প্রবর্তিত এএফসি কাপে এখন পর্যন্ত গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের দুই ক্লাবের একসঙ্গে খেলা হয়নি। ২০১৮ সালে সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব, ২০২০ এবং ২০২১ সালে ঢাকা আবাহনী সুযোগ হাতছাড়া করার ফলে লাল-সবুজদের একটি ক্লাবের উপস্থিতি অব্যহত রয়েছে।
আবারো দুই বাংলাদেশি ক্লাবের গ্রুপ পর্বে খেলার সুযোগ সামনে এসেছে। আগেই চুড়ান্তপর্ব নিশ্চিত হয়ে যায় বসুন্ধরা কিংসের। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন দলটির সঙ্গী হতে হলে আজ মোহনবাগানের বিপক্ষে জিততে হবে ঢাকা আবাহনীকে। এএফসি কাপের প্লে-অফের এই ম্যাচ জিতলে আগামী মে মাসে গ্রুপ পর্বে বসুন্ধরা কিংসের সঙ্গী হবে আবাহনী। সাথে ২০১৭ সালে কলকাতার মাঠে মোহনবাগানের কাছে হার আর আবাহনীকে জরিমানা করানোর প্রতিশোধও নেয়া হবে আকাশি-নীল জার্সি ধারীদের। গত আসরে শেষ মুহুর্তের গোলে বসুন্ধরা কিংসের সাথে ড্র করে কলকাতার ক্লাবটি গ্রæপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এবার তাদের প্লে-অফেই ছিটকে ফেলার সুযোগ এসেছে।
এদিকে কলকাতার এটিকে মোহনবাগানের আজ মাঠে নামার আগে দুই সুবিধা পেয়েছে। একে তো নিজ মাঠে খেলা তাদের, তার ওপর আবাহনীর বিপক্ষে খেলার আগে প্রিলিমিনারি রাউন্ড ২ পার করে এসেছে শ্রীলংকার ব্লুস্টার ক্লাবকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে। সেখানে বাংলাদেশী ক্লাবটি কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ না খেলেই কলকাতায় নামতে হচ্ছে। এর আগে আর্থিক সঙ্কটে প্রিলিমিনারি রাউন্ডের ম্যাচ খেলতে বাংলাদেশে আসেনি মালদ্বীপের ক্লাব ভ্যালেন্সিয়া। তাই সে ম্যাচে বাংলাদেশি ক্লাবটির জুটেছে ওয়াকওভার।
ফলে, বিপিএল খেলে তাদের আজ ভারতীয় অন্যতম সেরা ক্লাবের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এর বাইরে সাথে যোগ হয়েছে ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার ডরিয়েলটনের হঠাৎ করে ইনজুরিতে পড়া। বসনিয়ার নেদো তুর্কোভিচ কতটো সে শুণ্যতা কতটা পূরণ করতে পারবেন সেটিই আজকে দেখার বিষয়। আবাহনীর কোচ মারিও লেমস ম্যাচের আগেরদিন জানান, ’জয় ছাড়া যেহেতু কোন বিকল্প নেই, তাই আজকে জয়েই চোঁখ থাকবে আমার দলের। আমরা এই ম্যাচ জয়ের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস রয়েছি’। আবাহনী ও মোহনবাগান, দুই দলেরই চার জন করে ৮ বিদেশীর উপস্থিতি থাকবে এ ম্যাচে। তবে হাইলাইটসটা আবাহনীর ড্যানিয়েল কলিনড্রেসের ওপরই থাকবে।
২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলা এই কোস্টারিকানের সাথে আলোচনায় রয়েছে কলকাতার দলটির ফিনল্যান্ড জাতীয় দলের সাবেক সদস্য জনি কাউকো। ২০২০ ইউরো চ্যাম্পিয়নশীপের দলেও ছিলেন এই ফরোয়ার্ড। অঅগের ম্যাচে ব্লুস্টারের বিপক্ষে জোড়া গোল ছিল তার। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার ডেভিড উইলিয়ামস, স্পেনের হুয়ান লুইস, মরক্কোর হুগো বাউমোস মোহনবাগানের অন্যতম শক্তি হিসেবে ধরা হচ্ছে। সঙ্গে আছেন ইনফর্ম স্ট্রাইকার মানভির সিং। তারও জোড়া গোল ছিল প্রিলিমিনারি রাউন্ডে। ইনজুরি কাটিয়ে ফিরতে পারেন গোলরক্ষক আমরিন্দার সিং ও মিডফিল্ডার লিস্টন কোলাসো। অন্যদিকে আবাহনীর ব্রাজিলিয়ান রাফায়েলও হতে পারেন কলকাতাবাসীর জন্য দুশ্চিন্তার নাম। সব মিলিয়ে লড়াইটা কেমন হয় সেটার পাশাপাশি জয়ের প্রত্যাশা নিয়ে বাংলাদেশি দর্শকরা টিভি সেটের সামনে বসবেন।