আশির দশকে যখন প্রথম তিনি কর্ণাটকের নির্বাচকদের নজরে আসেন, তখনও ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পায়নি যে ভারত তাঁর ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা পেসারকে পেয়ে গিয়েছে। বরং, ব্যাঙ্গালোরিয়ান্সদের দাপটে যাতে প্রশ্ন না ওঠে, তাই একটা মফস্বলের ছেলে সুযোগ পেল – এমনটাই ধরে নিয়েছিল সকলে। অনেকে তো প্রশ্নই ছুঁড়েছিল, এই মিষ্টভাষী ভেজিটেরিয়ানের মধ্যে কি আদৌ উইকেট নেওয়ার ক্ষুধা আছে?
তিনি হলেন জাভাগাল শ্রীনাথ। তাঁর প্রথম অধিনায়ক রজার বিনি বলেন, ‘ও আসলে একজন ইন-স্যুইং নির্ভর বোলার ছিল। কিন্তু, পরিশ্রম করে আউট-স্যুইংটাকে নিজের উইকেট টেকিং ডেলিভারিতে পরিণত করে। ওর প্রচুর স্ট্যামিনা ছিল, কখনোই হাল ছাড়তে চাইতো না।’
ব্রিটিশ সরকারের দেয়া ‘শের-ই-মহিশুর’ কিংবা ‘মহিশুরের বাঘ’ উপাধিতে ভূষিত টিপু সুলতান ভারতীয় ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে। মহিশুর থেকে উঠে এসে বিশ্ব ক্রিকেট মঞ্চে মহিশুরের নাম চির অমর করে লিখে রেখে গিয়েছেন জাভাগাল শ্রীনাথ।
বৈচিত্রময় ইনকাটার, ইন স্যুইঙ্গার আর গতিময়তার জন্য ‘দ্য মাইশোর এক্সপ্রেস’ খ্যাত জাভাগাল শ্রীনাথ। ভারতীয় ক্রিকেটে অসামান্য অবদান রাখায় ভারত সরকার যাকে দিয়েছিল ‘অর্জুন’ পদক।
যদি প্রশ্ন করা হয় ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনের পর দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানদের মাঠের খেলায় সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছেন কোন বোলার। শেন ওয়ার্ন, মুরালিধরন কিংবা ম্যাকগ্রা নয়, কোন প্রোটিয়া ক্রিকেট ভক্ত চোখ বন্ধ করে কপালে ভাঁজ রেখেই উত্তরটা বলে দিবেন – জাভাগাল শ্রীনাথ।
ভারতীয় পেস বোলিং ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা সুন্দরতম বোলার হিসেবে বিবেচিত জাভাগাল শ্রীনাথ জন্মেছিলেন কর্ণাটকের মহিশুরে। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি প্রবল আকর্ষণ থাকা শ্রীনাথের ১৯৯১ সালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে একদিনের ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে।
পেস বোলিংটা যদি শিল্প হয় নিঃসন্দেহে জাভাগাল শ্রীনাথ ছিলেন সে শিল্পের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের তারকা ব্যাটসম্যান কিথ আথারটনকে তিনি যে ডেলিভারিতে ক্লিন বোল্ড করেছিলেন, ক্রিকেটের বর্ণিল দেয়ালে তাকে ছবি বানিয়ে ঝুলিয়ে রাখা যাবে হাজার বছর ধরে।
লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে পিচ করে মিডল অফস্ট্যাম্পে আঘাত হানা তার সে ডেলিভারিকে নি:সন্দেহে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সুন্দরতম ডেলিভারি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সমগ্র ক্যারিয়ারেই আগ্রাসী বোলিং আর দুর্দান্ত গতির ঝড়ে বল হাতে প্রতাপ ছড়িয়েছিলেন শ্রীনাথ, তার সময়ে ব্যাটসম্যানদের মাথার উপর রীতিমতো ছড়ি ঘুরিয়েছিলেন।
১৯৯৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ঘন্টায় সর্বোচ্চ ১৫৬ কিমি বেগে গতির ঝড়ে তুলেছিলেন শ্রীনাথ। ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকা বিপক্ষে ছয় টেস্টের সিরিজটিতে ৩৬ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব গড়েন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকানদের কাছে তাই বরাবরই তিনি অন্যরকম মর্যাদা পান।
সাবেক প্রোটিয়া অধিনায়ক শন পোলক একবার বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় ভারতের হয়ে শ্রীনাথ যে পরিমান কৃতিত্ব দেখিয়েছে, সেই সম্মানটা ওকে দেখানো হয় না।’ কথাটা ভুল নয়, ইতিহাসের পাতায় তিনি যার পর নাই আন্ডাররেটেড।
তার সময়ে ভারতীয় ক্রিকেট দলের পেস আক্রমণে নেতৃত্ব দেয়া শ্রীনাথ ১৯৯২, ১৯৯৬, ১৯৯৯ ও ২০০৩- এই চারটি বিশ্বকাপ আসরে অংশ নিয়ে জহির খানের সঙ্গে যৌথভাবে বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ ৪৪ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব দেখান। ভারতের কিংবদন্তী ক্রিকেটার কপিল দেবের পর ক্রিকেট ভারতীয় পেস বোলার হিসেবে দুইশত উইকেটের মাইলফলক ছোঁয়া শ্রীনাথ একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনশত উইকেট পাওয়া একমাত্র ভারতীয় ক্রিকেটার।
কথায় বলে- প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে নাকি একবার উচ্চ শিখায় জ্বলে ওঠে। সেই কথাকে নিজের বেলায় ঠিক ষোল আনাই সত্য করেছেন শ্রীনাথ। খেলেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, লড়েছেন, লড়াইয়ের প্রেরণা ছড়িয়েছেন। সৌরভ গাঙ্গুলির অনুরোধে অবসর ভেঙে ফিরে এসে ২০০৩ বিশ্বকাপে ভারতের অনভিজ্ঞ-আনকোরা বোলিং আক্রমণকে সম্মুখ যুদ্ধের বিশ্বস্ত আর অভিজ্ঞ সেনাপতি হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে।
শ্রীনাথ-জহির-নেহরা ত্রিমুখী পেস ব্যাটারির সামনে সেবার রীতিমতো খাবি খেয়েছিল বিশ্বের অভিজ্ঞ আর পরীক্ষিত সব ব্যাটিং লাইনআপ। ঐ টুর্নামেন্টে এক ফাইনাল বাদ মিলে পুরো টুর্নামেন্টেই তিনি ছিলেন হিরোদের হিরো।
১১ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৬৭ টেস্ট আর ২২৯ টি একদিনের ক্রিকেট ম্যাচ খেলে জাভাগাল শ্রীনাথ যেদিন থেমেছিলেন, তার আগে তিনি শুধু ভারতীয় নয়, বিশ্ব ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা পেস বোলারের তালিকায় লিখে রেখে গিয়েছিলেন নিজের নাম। মাঠের ক্রিকেট ছাড়লেও, ছাড়েননি ক্রিকেট। অবসরের পর আইসিসির ম্যাচ রেফারির দায়িত্ব নিয়ে রয়ে গিয়েছেন ক্রিকেটেই।
দিনের পর দিন, ম্যাচের পর ম্যাচের, বছরের পর বছর ক্রিকেট মাঠে প্রতাপের সাথে খেলে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন বিদায়ের আগে সে অভিজ্ঞতার আলোয় রাঙিয়ে গিয়েছেন তরুণ সতীর্থ জহির-নেহরাদের। তার অবসরের পরেও ভারতীয় দল তাকে কিভাবে মূল্যায়ন করেছিল তা বুঝতে যথেষ্ট ওই সময়ে আশিষ নেহরার দেওয়া একটা সাক্ষাৎকার।
তিনি বলেছিলেন, ‘যখন আমি বোলিং করার সময় কোন সমস্যার মুখোমুখি হবো আর মিড অনে শ্রীনাথকে খুঁজতে গিয়ে দেখবো তিনি নেই, তখন আমি তার ওই না থাকা প্রচণ্ডই মিস করবো।’ শুধু, নেহরা নয় পরের প্রজন্মের পেসাররা এমন পিতৃসুলভ একজনের ছায়া মিস করেছেন বরাবরই।
বলা হয়- জাভাগাল শ্রীনাথ যখন বল হাতে ধেয়ে চলতেন, তখন মনে হতো ক্রিকেট নয় যেন গতির ঝড়ে শিল্পের পসরা সাজিয়ে যাচ্ছেন কেউ একজন। ক্রিকেটের নিপাট ভদ্র লোক হলেও, প্রতিভা ও সামর্থ্যের তুলনায় তিনি ‘আন্ডার-অ্যাচিভার’ – পরিশ্রমের তুলনায় সাফল্য পেয়েছেন কম। তারপরও ইতিহাসে টিকে থাকবে জাভাগাল শ্রীনাথের নাম।
শ্রীনাথের এক কালের বোলিং পার্টনার ভেঙ্কটেশ প্রসাদ তাঁর ব্যাপারে সবচেয়ে মোক্ষম মন্তব্যটি করেন। তিনি বলেন, ‘আমার জ্ঞান বলে, ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে দ্রুত গতির বোলার হলেন তিনি (জাভাগাল শ্রীনাথ)। টেস্টে দিনের পর দিন ভারতীয় উইকেটে খেলে ২০০’র ওপর উইকেট পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এটা বিরাট একটা অর্জন। আমি তাঁকে (অ্যালান) ডোনাল্ড, (শন) পোলক কিংবা (গ্লেন) ম্যাকগ্রাদের জায়গাতেই রাখি।’