রশিদ খানের বয়স নিয়ে আপনি ট্রল করতেই পারেন। কিন্তু তিনি যে বর্তমানে বিশ্বের সেরা লেগ স্পিনার তা নিয়ে আশা করছি দ্বিমত থাকবে না। আফগানিস্তানের হয়ে খেলার জাতীয় দলের হয়ে এখনও অর্জনের খাতাটা খালি বলা চলে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিশ্বকাপের মঞ্চ ছাড়া আফগানিস্তান এখনও বড় দলগুলোর বিপক্ষে তেমন একটা খেলার সুযোগ পায় না বললেই চলে।
তবে, ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের হট কেক রশিদ খান। বিশ্বের নানা প্রান্তে খেলে বেড়ান তিনি। লেগ স্পিন ম্যাজিকে বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যাটারদেরও মাত দিচ্ছেন তিনি। বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তিনি ব্যাটারদের জন্য যমদূত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
প্রতি আসরের মত এবারের আসরের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগেও (আইপিএল) বল হাতে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন রশিদ। কিপটে বোলিংয়ের পাশাপাশি উইকেটও নিজের ঝুলিতে পুরছেন। রশিদ খানের বোলিং সামর্থ্য, তাঁর ম্যাজিকেল লেগ স্পিন নিয়ে আলোচনা কম হয় না। তবে বোলিংয়ের আড়ালে ব্যাট হাতেও তিনি যে কম যান না তার প্রমাণ দিয়েছেন বেশ কয়েকবার। লোয়ার অর্ডারে ব্যাট হাতে ক্যামিও খেলতে বেশ পটু তিনি। কব্জির জোরও অনেক। যার কারণে কব্জির ব্যবহার করে সহজেই বলকে গ্যালারিতে আছড়ে ফেলতে পারেন এই আফগান তারকা।
সাম্প্রতিক সময়ে বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিং দিয়েও নজর কাড়ছেন রশিদ খান। নান্দনিক শটে দৃষ্টি কাড়ছেন তিনি। লোয়ার অর্ডারে রশিদের ব্যাটে দেখা মিলছে দুর্দান্ত কিছু শটের। ব্যাট হাতে সম্প্রতি আইপিএলে নিজের সামর্থ্যটা জানান দিচ্ছেন এই আফগান তারকা।
‘ জীবনে সফল হতে চাইলে দু’টি জিনিসের প্রয়োজন; জেদ আর আত্মবিশ্বাস ‘ – জগৎ বিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েনের এই উক্তি শতভাগ সত্যি। জেদ আর আত্মবিশ্বাস না থাকলে আপনি চাইলেও সফল হতে পারবেন না। সমালোচনা হবেই, সেই সমালোচনা পাশ কাটিয়ে সেরা হবার যে মাহাত্ম্য তা আর কিসে মিলবে?
মার্ক টোয়েনের সেই বিখ্যাত উক্তিটা হয়ত মনে প্রাণে ধারণ করেন আফগান তারকা স্পিনার রশিদ খান। ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস আর সফল হবার জেদ সবটাই আছে। বল হাতে তো তিনি সেরাদের একজন। কিন্তু ব্যাট হাতে ছিলেন শূন্যতার বেড়াজালে। শূন্যতা কাটিয়ে জেদ আর আত্মবিশ্বাস দিয়েই দিনে দিনে ব্যাট হাতেও পরিণত হয়ে উঠছেন তিনি। এর প্রমাণ আরও একবার মিলল গেল রাতে আইপিএলে।
সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য এক জয় এনে দেন গুজরাট টাইটান্সকে। ১৯৬ রানের লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে ১৪০ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ব্যাকফুটে গুজরাট। সেখান থেকে তেওয়াতিয়া, রশিদের ব্যাটে শেষ ওভারে জয়ের জন্য গুজরাটের প্রয়োজন ছিল ২২ রানের। স্ট্রাইকে ছিলেন রাহুল তেওয়াতিয়া আর অপরপ্রান্তে ছিলেন রশিদ খান। বল হাতে প্রস্তুত মার্কো জেনসেন।
এইত কয়েক ম্যাচ আগেই পাঞ্জাবের বিপক্ষে শেষ দুই বলে ছক্কা হাঁকিয়ে অবিশ্বাস্য এক ম্যাচ জিতিয়েছিলেন তেওয়াতিয়া। তারই পুনরাবৃত্তি হয় কিনা সে নিয়েই সবাই ভাবছিলেন। প্রথম বলেই হাঁকালেন ছক্কা! এরপর সিঙ্গেল নিয়ে প্রান্ত বদল করলেন। স্ট্রাইকে তখন রশিদ খান। তেওয়াতিয়া স্ট্রাইকে না থাকায় গুজরাট সমর্থকরাও সম্ভবত আর জয়ের আশা করেনি। শেষ চার বলে প্রয়োজন ছিল ১৫ রানের। স্ট্রাইকে যেয়েই সোজা আম্পায়ারের মাথার উপর দিয়ে ছক্কা মারলেন রশিদ।
৩ বলে দরকার ৯ রানের। চতুর্থ বলটা ব্যাটেই লাগাতে পারলেন না রশিদ। ২ বলে ৯ রান রশিদের কাছ থেকে অবশ্যই অনেক উচ্চাভিলাষী প্রত্যাশা। গুজরাটের ডাগ আউট থেকে শুরু করে সমর্থকরাও হয়ত সেসময় তেওয়াতিয়াকে স্ট্রাইকে প্রত্যাশা করছিলেন। কিন্তু এরপরই জন্ম নিল আরেক রূপকথার গল্প। আরেক অবিশ্বাস্য, নাটকীয় ফিনিশিং।
পঞ্চম বলটা ওয়াইড ইয়র্কার করার চেষ্টা করলেন জেনসেন। তবে সেটা না হয়ে লো ফুলটাস হয়ে যায়। সেখান থেকেই উঠিয়ে মেরে কভারের উপর দিয়ে রশিদের দুর্দান্ত এক ছয়। ম্যাচে টান টান উত্তেজনা, হায়দ্রাবাদের ডাগ আউটে অস্বস্তিতে দেখা গেল কোচ মুরালিধরন, টম মুডিডের। রশিদের ব্যাটে তখন ম্যাচে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা।
১ বল থেকে প্রয়োজন ৩ রানের।
এবার লেগ স্টাম্পের উপর শর্ট বল করলেন জেনসেন। রশিদও সজোরে ব্যাট চালালেন। থার্ড ম্যানের মাথার উপর দিয়ে ছক্কা! রশিদ ম্যাজিকে অবিশ্বাস্য, নাটকীয় এক জয়!
তেওয়াতিয়ার ২১ বলে ৪০ ও রশিদে ৪ ছক্কায় ১১ বলে ৩১ রানের ক্যামিওয়ে রোমাঞ্চকর এক জয় তুলে নেয় গুজরাট।
এক ইনিংস আগেও রশিদ ছিলেন ব্যর্থতার চাদরে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছিল সমালোচনা। তরুণ অভিষেক শর্মার বেধরক পিটুনিতে ৪ ওভারে ৪৫ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকেন রশিদ। এরপরই শুরু সমালোচনার। কিন্তু ম্যাচ শেষে দেখা মিলল উলটো চিত্র। এক ইনিংসেই পালটে গেল পাশার দান। শূন্য থেকে রশিদ তখন ম্যাচ জয়ের নায়ক। সমস্ত সমালোচনা আর ট্রল রূপ নিলো প্রশংসার বাণীতে।
ব্যাট হাতে নিজের সামর্থ্যের জানান দিলেন আরও একবার। তাঁর দৃষ্টিনন্দন শট মুগ্ধ করছে ক্রিকেটপ্রেমীদের। দিনে দিনে ব্যাট হাতে তিনি আরও পরিণত হচ্ছেন।
রশিদ খানের ব্যাটিং মানেই সমর্থকদের একাংশের কাছে একশব্দে বলতে গেলে ‘ডাক’। হ্যাঁ, ডাক। কারণ ক্যারিয়ারে এরই মধ্যে তিনি অনেকবার ব্যাট হাতে ফিরেছেন শূন্য রানে। আইপিএল ইতিহাসে সর্বোচ্চ ডাকের রেকর্ডেও উপরের দিকেই আছেন তিনি! আইপিএলে ৮৪ ম্যাচে ৪০ ইনিংস ব্যাট করেছেন। আর এই ৪০ ইনিংসের ১১টিতেই তিনি আউট হয়েছেন শূন্য রানে।
যে কারণে ব্যাটিং নিয়ে সমালোচনায় ছিলেন প্রায়ই। তবে রশিদের কব্জির জোর যে অনেকটা বেশি সেটিও তিনি প্রমাণ করেছেন প্রায়ই বড় বড় ছক্কা হাঁকিয়ে। চলতি আসরে পঞ্চাশের বেশি রান করা ক্রিকেটারদের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ স্ট্রাইরেট রশিদের। লোয়ার অর্ডারে ঝড়ো ইনিংস খেলার সামর্থ্য যে তাঁর আছে সেটা স্পষ্ট।
রশিদকে নিয়ে ট্রল ব্যাপারটা নিতান্তই সাধারণ। বয়স নিয়ে ট্রল তো আছেই, ব্যাটে কিংবা বল হাতে এক ম্যাচে খারাপ করলেই নিন্দুকরা মেতে উঠেন সমালোচনায়। তবে রশিদ এসবের ধার ধারেন না। বরাবরই নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে নিন্দুকদের মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছেন তিনি। বোলার রশিদ কি তাহলে ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করছেন ফিনিশার হিসেবে? হয়ত আইপিএল দিয়েই ফিনিশার রশিদের উত্থান হচ্ছে।