মুশফিক কি ছাড়বেন রিভার্স সুইপ!

এই তো ক’দিন আগের ঘটনা। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের দ্বিতীয় টেস্টের তৃতীয় দিনের খেলার মধ্যাহ্ন বিরতির আর খানিকক্ষণ বাকি। শেষ ওভার বিরতির আগে। ইনিংসে প্রথমবারের মত বোলিং করতে আসেন সাইমন হারমার। তাঁর করা প্রথম বলেই সুইপ শট খেললেন মুশফিকুর রহিম। এ যাত্রায় ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার অঞ্চল দিয়ে চার আদায় করে নিলেন অভিজ্ঞ মুশফিক আর সে সাথে পেরিয়ে যান ব্যক্তিগত অর্ধশতক রানের গণ্ডি।

বাইশ গজে তখন শেষ স্বীকৃত ব্যাটার জুটি, মুশফিক আর মিরাজের। লাঞ্চের তখন আর সর্বোচ্চ এক ওভার বাকি। পরিস্থিতি এমনও নয় যে বাংলাদেশের জয়ের জন্যে একটা বাউন্ডারির প্রয়োজন। তবুও হারমারের রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে করা বল রিভার্স সুইপ খেলেন মুশফিক। আর বিধিবাম। বল গিয়ে আঘাত করল তিন-তক্তায়। আর তখন কমেন্ট্রি বক্সে থাকা মার্ক নিকোলাস বলে ওঠেন, ‘হি ইজ কিডিং, ইসেন্ট হি?’

অর্থাৎ নিকোলাস বিশ্বাসই করতে চাইছেন না। একটা সেশন শেষ হয়েই যাবে, অন্যদিকে স্বীকৃত ব্যাটারদের শেষ জুটি। এমন এক পরিস্থিতিতে মুশফিকের সেই শটটা বড্ড বেশি দৃষ্টিকটুই লেগেছিল নিকোলাসের কাছে। অথচ খানিক আগেই এই নিকোলাসই প্রশংসায় ভাসিয়েছিলেন মুশফিক কে। পেশাদারিত্বের একটা ছাপ নাকি রয়েছে ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবলের’ মধ্যে।

মুশফিকের এমন কান্ডজ্ঞানহীন শট বাছাই সেটাই প্রথম ছিল তা নয়। ২০২১ থেকে এখন অবধি মুশফিক তাঁর সেই রিভার্স সুইপের কারণে সমালোচনার স্বীকার হয়েছেন বহুবার। নিন্দাও সহ্য করতে হয়েছে তাঁর। তবে তিনি যেন অনড় তাঁর অবস্থানে। তিনি সে শট যেন খেলবেনই যেকোন পরিস্থিতিতে। এমনটা তিনি অকপটে মিডিয়ার সামনেই বলেছিলেন। আর এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে মূল ধারার গণমাধ্যম সবখানেই নিন্দার ঝড় বয়ে যায়।

প্রশ্ন জাগে মুশফিক কি সে শট খেলা বাদ দেবেন? নাকি নিজের স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে দলকে প্রতিনিয়ত বিপদের মুখে ঠেলে দেবেন? এই নিয়ে অবশ্য অভিজ্ঞ কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম তাঁর নিজস্ব ভাবনার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘এটা আসলে পছন্দের বিষয়। সে (মুশফিক) নিজেও জানে সেই শটটা ঠিকঠাক মত খেলতে পারলে তা নিজের এবং দলের জন্যে ভাল হবে। যখন রান আদায়ের সহজ বিকল্পগুলো খোলা থাকে তখন সাধারণত ব্যাটাররা এমন রিস্কি শট খেলে না। কিন্তু যখন রান তোলার সহজ পথগুলো বন্ধ থাকে আর খেলোয়াড়টি অফফর্মের মধ্যে দিয়ে যায় তখন তাঁরা এমন শট খেলে চাপ থেকে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করে।’

নাজমুল আবেদীন ফাহিম মুশফিকের এমন শট খেলার পেছনে তাঁর অফফর্মের কথাই জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজ শুরুর আগেই মুশফিক ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কাছে আলাদা অনুশীলন করেছেন, শলা-পরামর্শ করেছেন তাঁর পরিস্থিতি নিয়ে। তাই নাজমুল আবেদীন ফাহিম বেশ আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমি আশা করছি সে তাঁর স্বাভাবিক খেলা খেলেই রানে ফিরবে। তাঁর রিভার্স সুইপের মত শটগুলো খেলার প্রয়োজন হবে না।’

অভিজ্ঞ জহুরির চোখ বলছেন মুশফিকের রিভার্স সুইপের দৃষ্টিকটু আউট গুলোর পিছনে অফ ফর্ম দায়ী। অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গো মুশফিকের রিভার্স সুইপের বিপক্ষে নন। বরং তিনি বলেছেন বেশকিছু বিষয় মাথায় রেখে সে শট খেলা উচিৎ মুশফিকের।

রাসেল ডমিঙ্গো বলেন, ‘যদি একজন ওপেনিং ব্যাটার কাভার ড্রাইভ খেলে আউট হয় তবে আপনি তো তাঁকে সে শট খেলতে বারণ করতে পারেন না। বরং দেখা যাবে সে মিডউইকেট দিয়ে খেলতে গিয়ে এলবিডব্লিউ আউট হয়ে ফিরে যাবেন। যদি আপনি একটি শটের উপর আস্থা রাখতে পারেন তখন সে শটটা খেলা দোষের কিছু নয় বরং সেটা একটা ভাল বিকল্প হতে পারে। আমার মতে সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কখন শটটি খেলবেন, কেন খেলবেন, উদ্দেশ্য কি।’

তাছাড়া ডমিঙ্গো মুশফিকের রিভার্স সুইপের প্রশংসা করে বলেছেন, ‘মুশফিক একজন দূর্দান্ত রিভার্স সুইপ খেলা খেলোয়াড়। সে অতীতে এই শট খেলে প্রচুর রান করেছে।’ হ্যাঁ, এ কথা সত্য মুশফিক রিভার্স সুইপটা খেলতে পারেন দারুণ। ২০১৪ সালের পর এখন অবধি তিনি টেস্টে দুইবার আউট হয়েছেন রিভার্স সুইপ খেলে। প্রথমটা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। দ্বিতীয়টা দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ ভুগতে দেখা গেছে মুশফিকুর রহিমকে। তিনি এই রিভার্স দুইপ খেলে তাঁর ক্যারিয়ারে ১০৭ বারের প্রচেষ্টায় ৩৮টি চার হাঁকিয়েছেন। আউট হয়েছেন কেবলই নয়বার। তবে মুশফিকের এই রিভার্স সুইপ নিয়ে হওয়া সমালোচনার কারণটাও বেশ যুক্তি সংগত। তিনি ২০২১ এর ফেব্রুয়ারির পর সব ফরম্যাট মিলিয়ে চার দফা আউট হয়েছেন এই রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে। ১৮ বারের প্রচেষ্টায় চার মেরেছেন কেবল দুইটি।

এই সময়ের আগে যেখানে এই রিভার্স সুইপ খেলেই তিনি রান করতে পেরেছেন প্রায় ৪০%। সেখানে বিগত ১৮ মাসে তাঁর রানের শতকরা হিসেব মাত্র ১১%। সুতরাং বোঝাই যায় ঠিক কতটা বাজে সময় পার করছেন তিনি। তবে কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিম বড় আশাবাদী, মুশফিক আর এমন দৃষ্টিকটু শটে আউট হবেন না বলেই তাঁর অভিমত। তিনি এবং মুশফিক মিলে মুশফিকের টেকনিকের উপর কাজ করেছেন। টেকনিক্যালি একটু ঝামেলার মধ্যে থাকলে খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি হয়। সেটাই কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন।

তবে মুশফিক কিন্তু চাইলেই নিজের এমন খারাপ সময়ে রিভার্স সুইপ খেলাটা বাদ দিতে পারেন। এমন নজির যে ক্রিকেটে নেই তা কিন্তু নয়। সিডনিতে শচীন টেন্ডুলকারের ঐতিহাসিক দ্বিশতকের ইনিংসে একটিও কাভার ড্রাইভ খেলেননি এই কিংবদন্তি ব্যাটার। আবার অস্ট্রেলিয়ার ‘ওয়াহ’ ভাতৃদ্বয় পুল ও হুক শট খেলা বাদ দিয়েছিলেন যখন দেখছিলেন তাঁদের জন্যে সে শটটা খুব একটা কার্য্যকর হচ্ছিল না। এখন সিদ্ধান্ত সত্যিই মুশফিকের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link