শ্রীলঙ্কার গেল ঢাকা টেস্টের চতুর্থ দিনে খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন সাকিব আল হাসান। সেখানে সাংবাদিকদের সাথে সাকিবের খোলামেলা কথাবার্তা কিংবা হাসি-ঠাট্টা সবার নজর কেড়েছে। তবে সেই সংবাদ সম্মেলনেই সাকিব একটা কঠিন সত্য বলে গিয়েছিলেন। খুব সম্ভবত ওই একটা বাক্যই পরিষ্কার বলে দিয়েছিল যে এই মূহুর্তে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে ও টেস্ট অধিনায়কের অবস্থা কতটা নাজেহাল।
মুমিনুল হকের অধিনায়কত্ব ও ব্যাটিং ফর্ম নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সাকিব বলেছিলেন, ‘একজন অধিনায়কের জন্য এই সময়টা কঠিন। তবে আমাদের টেস্ট ক্রিকেটে যে অবস্থা তাতে এখন মুমিনুলের চেয়ে ভালো কোন অপশনও আমাদের হাতে নেই।’
এই বাক্যটাকে দুই দিক থেকেই দেখা যায়। এক, মুমিনুলই এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে যোগ্য টেস্ট অধিনায়ক। দুই, আসলে আমাদের টেস্ট দলের হাল যোগ্যরা ধরতে চাইছে না বলেই মুমিনুলকে দিয়ে চালিয়ে নেয়। একটু খেয়াল করে দেখলে নিশ্চয়ই আপনি দ্বিতীয়টার সাথে একমত হবেন।
কেননা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক হবার জন্য সবচেয়ে যোগ্য নাম সাকিব আল হাসান নিজেই। তবে তিনি এই ফরম্যাটটা নিয়মিত খেলেন না। তাই দায়িত্ব নেয়ার প্রশ্নও আসেনা। এছাড়া ওয়ানডে অধিনায়ক তামিমও হতে পারতেন টেস্ট অধিনায়ক। আর তরুণদের মধ্যে দলে একমাত্র নিয়মিত পারফর্মার আছেন মিরাজ। ফলে টেস্ট অধিনায়কত্ব নিবেন এমন চরিত্র দলে খুব বেশি নেই।
টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে মুমিনুল যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন তিনি আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলার কথা বলেছিলেন। এছাড়া আশা ছিল বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে সাদা পোশাকের ক্রিকেটটাকে তুলে ধরবেন তিনি। মুমিনুলের দল এই সময়টাতে আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে পেরেছে কি পারেনি সেই আলোচনা তোলা থাক। কেননা টেস্টে বাংলাদেশের যে সংস্কৃতি সেটা শুধু একজন অধিনায়কের পক্ষে পরিবর্তন করা সত্যিই কঠিন।
তবুও মুমিনুলের নেতৃত্ব বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট ম্যাচ জিতেছে। সেই ম্যাচে তরুণ ক্রিকেটাররা দারুণ পারফর্ম করেছিলেন। শরিফুল, এবাদতরা কিউই ব্যাটসম্যানদের চোখে চোখ রেখে লড়েছিলেন। সবই ঠিকাছে, তবুও তো দলটার অধিনায়ক ছিলেন মুমিনুল। ফলে কিছু কৃতিত্ব তো তাঁকেও দেয়া উচিৎ।
মুমিনুল হয়তো বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে সেভাবে কখনো প্রশংসিত হননি। তবে মুমিনুল শুধু অধিনায়কত্বের জন্য সেভাবে কখনো সমালোচিতও হননি। কারণ হিসেবে হয়তো সেই সাকিবের কথাটাকে একটু মনে করতে পারেন। আমাদের এখন মুমিনুলের চেয়ে ভালো অপশন নেই। ফলে মুমিনুলের উপর ভরসা রাখা ছাড়া কীই বা করার ছিল।
তবে মুমিনুল ব্যাটসম্যান হিসেবে মন্দের ভালো ছিলেন না। তিনি সাদা পোশাকের ক্রিকেটে আমাদের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন। এখনো এই ফরম্যাটে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির মালিক তিনি। তবে মুমিনুল যত বাগরা বাঁধিয়েছেন এই ব্যাট হাতেই।
গত দশ ইনিংসে মুমিনুলের দুই অংকের স্কোর করতে পেরেছেন মাত্র দুইবার। এই সময়ে তাঁর ব্যাট থেকে আসেনি একটিও হাফ সেঞ্চুরি। এমনকি শেষ সাত ইনিংসে দুই অংকের স্কোর ছুঁতে পারেননি একবারো। এমন পারফর্মেন্সের পর যেকোন ব্যাটসম্যানই দলে জায়গা হারাতে পারেন। তবে টেস্ট অধিনায়কই একাদশে না থাকলে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিবে কে?
শুধু এই শেষ দশ ইনিংস নয়। অধিনায়কত্বের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ব্যাটসম্যান মুমিনুল বেশ চাপে আছেন। এই সময়ে তাঁর ব্যাটিং গড়ও অনেকটা কমে এসেছে। টেস্ট অধিনায়ক হবার আগে মুমিনুল বাংলাদেশের হয়ে রান করেছিলেন প্রায় ৪২ গড়ে। এরপর গত ১৭ ম্যাচ ধরে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। এই সময়ে তাঁর ব্যাটিং গড়ে নেমে এসেছে মাত্র ৩২.৪৪ এ। এছাড়া সর্বশেষ সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন গতবছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই।
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবস্থা কখনোই খুব একটা সুখকর ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই মুমিনুলের সময়েও সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। আসলে টেস্ট ক্রিকেটের একটা সংস্কৃতি, কাঠামো গড়ে না উঠলে এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়াটাও কঠিন। ফলে অধিনায়ক মুমিনুলকে আমাদের যতনা প্রয়োজন তারচেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন ব্যাটার মুমিনুলকে।
ফলে যে করেই হোক ব্যাটসম্যান মুমিনুলকে ফিরে পাওয়া জরুরী। সেটা তাঁর কাছ থেকে অধিনায়কত্বে দায়িত্ব সরিয়ে হোক কিংবা ক্রিকেট থেকে তা কিছুদিনের বিশ্রাম দিয়ে হোক। খুব সম্ভবত মুমিনুল একটা চক্রের মধ্যে আঁটকে গিয়েছেন। তাঁকে সেখান থেকে বের করে আনার রাস্তা খোঁজাটাই জরুরী।