পুরো ইউরোপের ফুটবলের বাতাসে এই মৌসুম আগেও একটা কথা বেশ ভেসে বেড়ত। হোসে মরিনহো নাকি শেষ। না মানে তিনি মারা যাননি। তার ফুটবলীয় ধীশক্তির নাকি অন্ত হয়েছিল। এমন গুঞ্জন উঠার কারণও আছে বেশ। তিনি তো পারছিলেন না তার ক্লাবকে কোন শিরোপা জেতাতে।
শিরোপা খরায় মানুষ প্রশ্ন তুলছিল ‘দ্য স্পেশাল ওয়ান’ খ্যাত মরিনহোর দিকে। অথচ এই মানুষটা একটা সময়ে ইউরোপের সব ক্লাবকে পেছনে ফেলে ইন্টার মিলানকে জিতিয়েছিলেন ‘ট্রেবল’। মৌসুমের তিন খানা শিরোপা ঘরে তুলেছিল ইন্টর। আর তার বিরুদ্ধেই নাকি প্রশ্ন ওঠের প্রদীপের জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ার। তবে তিনি যে শেষ হয়ে যাননি তার প্রমাণটই যেন আবার দিলেন ইতালিয়ান ক্লাব এএস রোমার হয়ে।
রোমা ধুকছিল, রোমার সমর্থকেরা ক্রমশ আস্থা হারিয়ে ফেলছিল। গেল তিন দশকে একবারও রোমা উঠতে পারেনি কোন ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে। সমর্থকদের নিরাশ হওয়া যেন ছিল অবধারিত। আর সে নিরাশা কাটিয়ে পুন:রায় সমর্থকদের, খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করবার দায়ভারটা নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন হোসে মরিনহো।
গেল মৌসুমের শুরুর দিকে তাকে নিযুক্ত করা হয় রোমার নতুন কোচ হিসেবে। এতে অবশ্য সমালোচনা হয়েছিল। তাকে নিয়ে মূল সমস্যা তিনি নেতিবাচক ফুটবল খেলেন। আসলে তিনি ফুটবল খেলেন শিরোপা জয়ের জন্যে, তিনি মাঠের বাইরে থেকে কলকাঠি নাড়েন সমর্থকদের কোন একটা কিছু উদাযাপন করতে দেওয়ার জন্যে। মরিনহো সে কাজটাই করেন।
তাইতো তিনি রোমাকে নিয়ে এসেছেন উয়েফা কনফারেন্স ক্লাবের ফাইনাল অবধি। শুধু নিয়ে এসেই ক্ষান্ত হননি। জিতিয়েছেন শিরোপা। এই শিরোপা যেন কত সহস্র বছরের আক্ষেপ ঘোচালো রোমা সমর্থকদের। অথচ শেষবার নিজ দলকে ফাইনালের ওঠানোর দায়েই হয়ত তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।
কোন কারণ ছাড়াই টটেনহাম হর্টস্পার্স কর্তৃপক্ষ মরিনহোকে দলের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন। তাও আবার ফাইনালের ঠিক আগে। তবে এবার তেমনটা ঘটেনি। কেননা রোমা তার উপর ভরসা রেখেছে এবং তিনি তার প্রতিদান দিয়েছেন।
মরিনহো যখন দলের দায়িত্ব পান তখন রোমার স্কোয়াড খুব একটা শক্তপোক্ত ছিল না। তবুও তিনি সেই দলকে নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত করেছেন। আর দলকে নিশ্চয়ই কোন এক অমৃত শুধা খাইয়েছেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ইউরোপা লিগ জেতা মরিনহো এখন অনন্য এক ব্যক্তিগত রেকর্ডের । কনফারেন্স কাপ জিতে তিন ভিন্ন ইউরোপিয় শিরোপা জয়ী একমাত্র কোচ বনে গেছেন তিনি।
সেটা না হয় এক মরিনহোর ব্যক্তিগত অর্জন। তবে সে অর্জন ছাপিয়ে তিনি গোটা একটা শহরের মানুষদেরকে আবার আনন্দের বন্যায় ভাসিয়েছেন। আবারও রোমাকে ইউরোপিয়ান কোন এক শিরোপা জেতাতে তিনি পেরেছেন। দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছরের অপেক্ষার অবসান অন্তত হয়েই গেল। আবেগি মরিনহো, ফুটবলকে বড্ড বেশি ভালবাসেন বলেই কেঁদেছিলেন রোমার সেমিফাইনাল জয়ে।
এই আবেগের সঞ্চার তিনি করে দিতে পেরেছেন পুরো দলের মাঝে। তিনি কেমন করে যেন এক সুরে বেঁধে ফেলতে পারেন পুরো দল ও তাদের সমর্থকদের। গানটা তিনি যেখানেই যান না কেন, তা এক ও অভিন্ন। শিরোপা জয়। দলের প্রতিটি খেলোয়াড়কে তিনি সাহয্য করেন নিজের সেরাটা উজার করে দিতে। তাইতো তিনি ‘স্পেশাল ওয়ান’।
বিগত কয়েকটা বছর কত বঞ্চনা সইতে হয়েছে তাকে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের খারাপ সময়েও তিনি তাদের হয়ে ইউরোপা লিগ জিতেছিলেন। ইন্টার ও পোর্তোর হয়ে ছুয়ে দেখেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। তবুও তাকে যেন বিন্দুমাত্র সম্মান দিতে পারেনি ইংলিশ ক্লাবগুলো থেকে শুরু করে তাদের কর্তা-সমর্থকেরা।
তবে সে ভালবাসা তিনি আবার অর্জন করে নিয়েছেন ইতালিতে। তিনি তার প্রাপ্য সম্মানটুকু আদায় করে নিয়েছেন আবার। নেতিবাচক ফুটবল খেলেই হোক, কিংবা নতুন করে স্বপ্ন দেখার সারথী হয়ে। তিনি যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন – ‘স্পেশাল ওয়ান ইজ স্টিল অ্যালাইভ’ কিংবা ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়!’