সাল ১৯৫৬। সেবার ভারত সফরে এলো নিউজিল্যান্ড দল। মাদ্রাজে ভারতের বিপক্ষে সিরিজের পঞ্চম টেস্ট। প্রথম ইনিংসে ভারতীয় ওপেনারদের সামনে অসহায় হয়ে পড়ছিলেন নিউজিল্যান্ডের বোলাররা। দুই ওপেনারকে আউট করতে কোনো কৌশলই কাজে আসছিল না ব্ল্যাকক্যাপদের।
ভিনু মানকড়ের সাথে ওপেনিংয়ে ছিলেন চশমা চোখে, হেলমেটহীন খালি মাথায় নিপাট এক ভদ্রলোক। মানকড়ের সাথে জুটি বেঁধে এই ভদ্রলোক শাসন করছিলেন নিউজিল্যান্ডের বোলারদের। দেড়শো পেরিয়ে তখন ডাবল সেঞ্চুরির দিকে তিনি; প্রথম বাঙালি ক্রিকেটার হিসেবে দুইশো রানের মাইলফলকে পা দেওয়ার হাতছানি।
মাঝে পানি পানের বিরতিতে একটা উড়া খবর শুনলেন – ‘দ্রুতই ইনিংস ঘোষণা করবে ভারত, মেরে খেলতে হবে।’ ভদ্রলোক এবার তাড়াহুড়ো শুরু করলেন; ডাবল সেঞ্চুরির স্বপ্নটা পূরণ করতেই হবে। কিন্তু পারলেন না! দ্রুত রান তুলতে গিয়ে ম্যাট পোরের বলে বোল্ড হলেন ব্যক্তিগত ১৭৩ রানে।
২৭ রানের জন্য ডাবল সেঞ্চুরির আক্ষেপ নিয়ে ফিরলেন ড্রেসিং রুমে। পরবর্তীতে জানতে পারলেন ইনিংস ঘোষণার কোনো পরিকল্পনাই তখন ছিল না ভারতের! যা শুনেছেন সেটি স্রেফ এক গুজব। ব্যাস, আক্ষেপের পাল্লাটা এবার আরও ভারী হল। চশমা চোখের সেই ভদ্রলোক ডাবল সেঞ্চুরি না পেলেও সেদিন মানকড় ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন। ওপেনিংয়ে দু’জনে মিলে গড়েন ৪১৩ রানের অনবদ্য রানের জুটি।
ওই সিরিজের আগে দল থেকেই বাদ পড়েছিলেন তিনি। কলকাতা টেস্টের আগে কি ভেবে আবার দলে ফেরানো হল; করলেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। এরপর মাদ্রাজ টেস্টে মানকড়ের সঙ্গে ওপেনিংয়ে গড়লেন অসাধারণ এক রেকর্ড।
চশমা চোখে ব্যাট করতেন, মাথায় টুপিও পড়তেন না সচরাচর। অবশ্য নিউজিল্যান্ড সিরিজের আগে তিনি চশমা ছাড়াই খেলতেন। এরপর হঠাৎ চোখে সমস্যা দেখা দিল, সেখান থেকেই নিয়মিত চশমা ব্যবহার শুরু। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বল চোখে দেখবেন কি-না – সে নিয়েও অনেকে উপহাস করেছিলেন। এরপর তো সেই স্মরনীয় সেঞ্চুরি আর জুটির রেকর্ডে নাম লেখালেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪১৩ রানের সেই জুটি অক্ষত ছিল ৫৩ বছর!
১৯৫১ সালে ভারতের জার্সিতে জাতীয় দলে অভিষেক। পুরো বাঙালি ক্রিকেটপ্রেমীরা সেবার তাকিয়ে ছিল তার ব্যাটে; কিন্তু ফিরে যান হতাশ করে। দিল্লীতে অভিষেক টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেললেন মাত্র ১২ রানের ইনিংস। সিরিজের প্রথম টেস্টে ভারত যথারীতি হেরে গেল।
ব্রাবোর্নের দ্বিতীয় টেস্টে আবার মাঠে দুই দল। আগের ম্যাচে হতাশাজনক ইনিংসের পরেও এবার দলে টিকে যান তিনি। এবার আর বাঙালদের হতাশ করেননি; সুযোগ পেয়ে করলেন বাজিমাত। ১৪০ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংসের পথে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টে দেখা পেলেন সেঞ্চুরি। বাঙালি ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য যেন এক ঐতিহাসিক দিন, আনন্দঘন মূহুর্ত।
ওই সিরিজের শেষ টেস্টে মাদ্রাজে আবারও সেঞ্চুরি করলেন। সেই সাথে প্রথমবারের মত ইংল্যান্ড বধের গল্পটাও ছাপা হয়ে গেল। শক্তিশালী ইংল্যান্ডকে হারিয়ে যেন রীতিমতো বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিল ভারত।
এই জয়ের পেছনের অন্যতম সেরা নায়ক ছিলেন পঙ্কজ রায়। হ্যাঁ, সেই চশমা পড়া ব্যাটার, হেলমেটহীন খালি মাথার নিপাট ভদ্রলোকের কথাই বলছি। বাংলার ক্রিকেটের এক অবিস্মরণীয় মহানায়ক। সুনীল গাভাস্কারের আগে তিনি ছিলেন ভারতের অন্যতম সেরা ওপেনার।
বাঙালি ক্রিকেটার হিসেবে ভারতীয় ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি নাম কামিয়েছেন সৌরভ গাঙ্গুলি; নিজেকে তিনি নিয়ে গেছেন সেরাদের কাতারে। সৌরভের আগে বাঙালি ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম ‘সুপারস্টার’ ছিলেন এই পঙ্কজ রায়।
পঞ্চাশের দশকে স্রেফ চশমা চোখে, খালি মাথায় তিনি তৎকালীন পেস দানবদের বিপক্ষে খেলে গেছেন। সেরা সেরা পেসারদের বলে অনায়াসে রান করেছেন, প্রমাণ করেছেন শ্রেষ্ঠত্বের। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারতের হয়ে বাঙালি ক্রিকেটাররা সুযোগ পেত না বললেই চলে। বাঙালি ক্রিকেট খেলবে – এটা তখন হাসির খোরাক ছিল। গুটি কয়েকজন বাঙালি ক্রিকেটার থাকলেও তারা নিজের সাফল্যের পর্বত শৃঙ্গে নিতে পারেননি; পেরেছিলেন শুধু পঙ্কজ রায়।
১৯২৮ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন পঙ্কজ রায়। দুই ভাই নিমাই ও গোবিন্দ রায়ও ভারতের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলেছেন। পরবর্তীতে পঙ্কজের ছেলে প্রণব রায়ও ভারতের হয়ে জাতীয় দলে খেলেন। কুমারটোলিতে পঙ্কজদের বাড়িটা ‘ক্রিকেট পরিবার’ নামেই সবাই চিনতো। এই বাড়ি থেকেই পাঁচজন খেলেছেন পেশাদার ক্রিকেট।
রঞ্জি ট্রফিতে নিজের অভিষেক ম্যাচেই করেছিলেন সেঞ্চুরি। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু। সেখান থেকে বছর দশেকের মাঝে লর্ডস টেস্টে ভারতের হয়ে অধিনায়ক হিসেবে টস করতে নামেন তিনি। ১৯৫৯ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমবার অধিনায়ক হিসেবে মাঠে নামেন পঙ্কজ রায়। অবশ্য অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন দত্তাজিরাও গাইকড়। কিন্তু লর্ডস টেস্টের আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর তাতেই সহ-অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্বে থাকা পঙ্কজ নামেন অধিনায়ক হিসেবে।
বর্তমান ক্রিকেটে হুক শটটা প্রায়ই খেলেন ব্যাটাররা। পঞ্চাশের দশকে হুক শট খেলতেও বুকের পাটা লাগতো। আর সেসময়টাই হেলমেট ছাড়া দুরন্ত গতির পেসারদের বিপক্ষেও হুক শট খেলতেন পঙ্কজ। বল মিস হলে কি হতে পারে এ ব্যাপারে কখনো চিন্তা করেছেন বলেও মনে হয় না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের রয় গিলক্রিস্ট, চার্লি গ্রিফিথ, ওয়েসলি হলদের বিপক্ষে খেলেছিলেন নির্ভয়ে; বুক চিতিয়ে লড়াই করতেন ২২ গজে।
অভিষেক সিরিজে জয়ের পর ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে হতশ্রী পারফরম্যান্স দেখান পঙ্কজ। ওই সিরিজে পাঁচবার শূন্য রানে আউট হন তিনি। ১৯৫৯ সালে ইংল্যান্ডে লর্ডস টেস্টে অধিনায়কত্ব করার পর আর খুব বেশিদূর যেতে পারেননি তিনি। ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে মুম্বাইয় টেস্টের পর আর দলে জায়গা হয়নি এই বাঙালি তারকার।
১৯৭৫ সালে তিনি পদ্মশ্রী পুরষ্কার জেতেন। ক্রিকেট ক্যারিয়ারে স্মৃতিচিহ্ন বলতে তেমন কিছুই নেই। পঙ্কজ রায় এসব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। ব্যাট, প্যাড, স্টাম্পস – কেউ হয়ত নিয়ে গেছে নয়তো নষ্ট হয়েছে।
৪৩ টেস্টে ৩২.৫৬ গড়ে করেছেন ২৪৪২ রান; আছে ৫ সেঞ্চুরি ও ৯ ফিফটি। পরিসংখ্যান বিচারে আপনি নির্দ্ধিধায় বলতে পারেন এক শব্দে ‘সাদামাটা’। তবু এই পঙ্কজ রায়কে নিয়ে লিখতে গেলে যেন শব্দের কমতি অনুভব হয়। বাঙালি ক্রিকেটারদের ও ক্রিকেটকে তিনি এনে দিয়েছিলেন সম্মান। বাঙালি ক্রিকেটারদের সামর্থ্য তিনি প্রমাণ করেছিলেন বিশ্বসেরা বোলারদের সামনে।
কারো কাছে তিনি পঙ্কজ রায়, কারো কাছে পঙ্কজ দা তো কারো কাছে পঙ্কজবাবু। ফুটবলের প্রতি ঝোঁক বলাটা ভুল হবে, ফুটবল পাগল ছিলেন তিনি। খেলেছেন ডিভিশন ফুটবলও। ইস্ট বেঙ্গল সহ বিভিন্ন বড় বড় ক্লাবের বিপক্ষে খেলেছেন তিনি। কিন্তু এক ইনজুরিতে ফুটবল ছেড়ে পরবর্তীতে ছুঁটে আসেন ক্রিকেটে।
ক্রিকেটে আসলেও ফুটবলের প্রতি প্রেম-ভালবাসা কমেনি পঙ্কজের। সুযোগ পেলে ঠিক হয়ত ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলতে এই ডান হাতি ব্যাটার। ফুটবল ছাড়াও টেনিস ও সাতারে ছিলেন পারদর্শী। ক্রিকেটে বহু লাঞ্চনা-বঞ্চনা সহ্য করেছেন। বাঙালি ক্রিকেটারদের উদ্দেশ্য করে পঙ্কজ বলেছিলেন, ‘ভারতীয় ক্রিকেটে বাঙালিদের জন্য রাস্তায় কখনও গোলাপ বিছানো ছিল না। বরং সামলাতে হয়েছে কাঁটার আক্রমণ।’
কত অপমান, কত বঞ্চনা, উপেক্ষা সহ্য করেছেন। তবুও কোনো প্রতিবাদ তিনি করেননি। ক্রিকেট ইতিহাসে হয়ত তিনি সেরাদের কাতারে নেই, কিন্তু বাঙালি ক্রিকেটারদের জন্য তিনি সবসময়ই এক অবিস্মরণীয় কিংবদন্তি হিসেবেই থাকবেন।